সহজলভ্য ও মজাদার একটি খাবার হলো মিষ্টি আলু (Sweet potatoes) যার অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বড় মানুষ, গর্ভবতী নারী, স্তন্যদায়ী মা সহ সবার জন্য মিষ্টি আলু নিরাপদ একটি খাবার। মিষ্টি আলু খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য নানাবিধ উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। 

এই অনুচ্ছেদে মিষ্টি আলুর পুষ্টি উপাদান সহ মিষ্টি আলু খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য কি কি উপকারিতা বয়ে আনতে পারে সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও মিষ্টি আলু খাওয়ার নিয়ম ও নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

মিষ্টি আলুর পুষ্টি উপাদান 

মিষ্টি আলুর প্রায় ৮০ শতাংশ হলো পানি আর বাকি অংশে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ফাইবার সহ বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলস রয়েছে। ১টি মাঝারি সাইজের মিষ্টি আলু (১২৪ গ্রাম) থেকে ১০৮ ক্যালরি সহ যেসব পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায় তা নিচে তুলে ধরা হলো। (Ware, 2019) 

পুষ্টি উপাদান  পরিমাণ 
কার্বোহাইড্রেট ১৮.৭ গ্রাম 
প্রোটিন ২ গ্রাম 
ফ্যাট ৩ গ্রাম 
ফাইবার ২.৪ গ্রাম 
আয়রন ০.৭ মিলিগ্রাম 
ক্যালসিয়াম ৫০.৮ মিলিগ্রাম 
ম্যাগনেসিয়াম ১৯.৮ মিলিগ্রাম 
ফসফরাস৫০.৮ মিলিগ্রাম 
পটাশিয়াম ২৫৯ মিলিগ্রাম 
সোডিয়াম ৩০৬ মিলিগ্রাম 
সেলেনিয়াম ০.৯ মাইক্রোগ্রাম 
ভিটামিন সি১২.৮ মিলিগ্রাম 
ফোলেট ৭.৪৪ মাইক্রোগ্রাম 
কোলাইন১৪.৪ মিলিগ্রাম 
ভিটামিন এ ৮২৩ মাইক্রোগ্রাম 
বিটা ক্যারোটিন৯৪৭০ মাইক্রোগ্রাম 
ভিটামিন কে ৫.১ মাইক্রোগ্রাম 
ভিটামিন বি৬ ০.২ মিলিগ্রাম  

এছাড়াও মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্ট (Antioxidants) উপাদান রয়েছে। সাদা বর্ণের মিষ্টি আলুর তুলনায় রঙ্গিন মিষ্টি আলুতে এন্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি থাকে। 

মিষ্টি আলুর উপকারিতা 

নিয়মিত মিষ্টি আলু খাওয়ার মাধ্যমে যেসব স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যায় তা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।‌ (Julson, 2023) 

১. পরিপাকতন্ত্রের জন্য উপকারী  

Stomach

মিষ্টি আলু ফাইবার সমৃদ্ধ একটি খাবার যা হজমে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।‌ যারা কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য নিয়মিত মিষ্টি আলু খাওয়া বেশ উপকারী হবে। বিশেষ করে পাইলসএনাল ফিশার প্রতিরোধ ও লক্ষণ নিরাময়ের জন্য কোষ্ঠকাঠিন্য যেন না হয় সেই ব্যাপারে খেয়াল রাখা জরুরী। 

মিষ্টি আলু মানুষের অন্ত্রে বসবাসকারী উপকারী ব্যাকটেরিয়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। আইবিএস (IBS- Irritable bowel syndrome) রোগীদের জন্য মিষ্টি আলু একটি উপকারী খাবার হতে পারে। এছাড়াও ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশন জনিত ডায়রিয়া প্রতিরোধ ও আইবিএস রোগের ঝুঁকি কমাতে মিষ্টি আলু সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

২. ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে 

যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন তাদের জন্য স্ন্যাকস হিসেবে ফাস্টফুডের পরিবর্তে মিষ্টি আলু দারুন একটি খাবার হতে পারে। সাধারণত ফাস্টফুডে লবণের পরিমাণ বেশি থাকে যা ব্লাড প্রেসার বাড়িয়ে দেয়। পক্ষান্তরে মিষ্টি আলুতে লবণের পরিবর্তে অনেক বেশি পরিমাণে পটাশিয়াম থাকে যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। 

মিষ্টি আলুতে কোনো ক্ষতিকর ফ্যাট থাকে না অর্থাৎ মিষ্টি আলু খাওয়া রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় না। এছাড়াও মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা হার্টের রোগ (স্ট্রোকহার্ট অ্যাটাক) প্রতিরোধে সাহায্য করে। 

৩. প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে 

মিষ্টি আলুর এন্টি-অক্সিডেন্ট উপাদানের প্রদাহ নাশক গুণাবলী শরীরের ফ্রি রেডিক্যালের (Free radicals) সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কোষের ক্ষতিগ্রস্ততা ঠেকায়। বিশেষ করে রঙ্গিন মিষ্টি আলুর প্রদাহ নাশক গুণাবলী সবচেয়ে বেশি। 

নিয়মিত মিষ্টি আলু খাওয়া প্রদাহজনিত বিভিন্ন রোগের উপসর্গ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যেমনঃ অ্যাজমা, বাত ব্যথা, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি। 

৪. ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায় 

মিষ্টি আলু ফাইবার সমৃদ্ধ একটি খাবার যা খাওয়ার মাধ্যমে টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। তবে ইতিমধ্যেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের জন্য পরিমিত পরিমাণে মিষ্টি আলু খেতে হবে। কারণ মিষ্টি আলুতে ফাইবার থাকলেও এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক বেশি। গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশি মানে হলো খাবারটি খাওয়ার পর তা রক্তে সুগারের মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দিতে পারে। 

৫. শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে 

যারা শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইচ্ছুক তাদের জন্য মিষ্টি আলু বেশ উপকারী একটি খাবার হতে পারে। মিষ্টি আলুতে থাকা ফাইবার দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে। বিশেষ করে স্ন্যাকস হিসেবে যেসমস্ত খাবার (ফাস্টফুড) খাওয়া হয় সেগুলো উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত হয়ে থাকে। স্ন্যাকস হিসেবে মিষ্টি আলু খাওয়া হলে তা কম ক্যালরি সরবরাহ করে এবং দীর্ঘসময় পর্যন্ত ক্ষুধার অনুভূতি হয় না।   

৬. দৃষ্টি শক্তি ভালো রাখে 

মিষ্টি আলুতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন এ রয়েছে যা দৃষ্টি শক্তি ভালো রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুদের জন্য নিয়মিত মিষ্টি আলু খাওয়া রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। আর বড়দের জন্য Macular degeneration নামক চক্ষু রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। এটি ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে হতে দেখা যায় যার ফলে দৃষ্টি শক্তি কমে যায়। 

৭. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় 

সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকা জরুরী। 

মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, এন্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান ইত্যাদি রয়েছে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তোলে। নিয়মিত মিষ্টি আলু খাওয়া রোগ জীবাণুর সংক্রমণ প্রতিরোধের মাধ্যমে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। 

৮. মস্তিষ্কের জন্য উপকারী 

Brain

মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে কোলাইন রয়েছে যা মস্তিষ্কের কোষের জন্য অনেক উপকারী।‌ বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে সহজেই শিখতে পারার সক্ষমতা এবং স্মৃতি শক্তি ভালো রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

মিষ্টি আলুতে বিদ্যমান এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী বয়সজনিত মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। যেমনঃ ডিমেনশিয়া (Dementia), আলজেইমার্স ডিজিজ (Alzheimer’s disease) ইত্যাদি। 

৯. ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে 

মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিয়মিত ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া হলে তাদের ক্ষেত্রে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। 

এছাড়াও মিষ্টি আলুর এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। যেমনঃ ফুসফুস, পাকস্থলী ও মূত্রথলির ক্যান্সার সহ পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যান্সার এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ক্যান্সার। 

১০. চুল ও ত্বকের জন্য উপকারী 

মিষ্টি আলু খাওয়া ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। মিষ্টি আলু শরীরে কোলাজেন (Collagen) উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কোলাজেন ত্বক ও চুলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। নিয়মিত মিষ্টি আলু খাওয়া ত্বকে বয়সের ছাপ ও চুলের রুক্ষতা দূর করতে সাহায্য করে। 

মিষ্টি আলু খাওয়ার নিয়ম 

মিষ্টি আলু খাওয়ার সবচেয়ে সহজ ও উত্তম উপায় হলো সিদ্ধ করে খাওয়া। সিদ্ধ করার পুর্বে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। কারণ মিষ্টি আলুর উপরিভাগে ময়লা ও ক্ষতিকর অণুজীব থাকতে পারে। ধোয়ার পরে একটি পাত্রে নিয়ে তাতে খানিকটা পানি যোগ করে ১৫ থেকে ২০ মিনিট জ্বাল দিতে হবে। পাত্রটি একটি ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখলে তাড়াতাড়ি সিদ্ধ হবে। সিদ্ধ হয়ে গেলে আর জ্বাল দেওয়া যাবে না। মনে রাখবেন, তাপে মিষ্টি আলুর পুষ্টিগুণ কমে যেতে থাকে।   

সিদ্ধ আলু উপরের চামড়া সহ খেলে বেশি ফাইবার ও পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। তবে চামড়া ছাড়িয়ে খেতে বেশি মজা লাগবে। স্বাদ বৃদ্ধির আলু পিষে এর সাথে দুধ যোগ করা যেতে পারে।‌ সিদ্ধ করা ছাড়াও বিভিন্ন মজাদার রেসিপি (রান্না করে) বানিয়ে মিষ্টি আলু খাওয়া যায়।   

একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য দৈনিক সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৪টি মিষ্টি আলু খাওয়া যেতে পারে। তবে ডায়াবেটিস আক্রান্তদের জন্য দিনে ১ টির বেশি খাওয়া উচিত নয়।

মিষ্টি আলু খাওয়ার তেমন কোনো ক্ষতিকর দিক অথবা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া যাবে না। কারণ এটি একটি শর্করা জাতীয় খাবার যা বেশি খেলে শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

শিশুদের জন্য মিষ্টি আলু 

শিশুর বয়স ছয় মাস হওয়ার পর মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি শিশুকে বিভিন্ন খাবার খেতে দেওয়া হয়। অনেকেই শিশুকে আলু সিদ্ধ করে খাওয়ান। সাধারণ আলুর তুলনায় মিষ্টি আলু বেশি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এবং মিষ্টি স্বাদের জন্য শিশুর কাছে খেতে বেশি সুস্বাদু মনে হবে। তবে অনেক বেশি পরিমাণে মিষ্টি আলু খাওয়ানো যাবে না।‌ বরং অল্প পরিমাণ আলু সরাসরি মুখে চুষে খেতে দিতে হবে অথবা আলু পিষে এর সাথে দুধ মিশিয়ে চামচ দিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। 

কাদের জন্য মিষ্টি আলু খাওয়া যাবে না? 

যারা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত বিটা ব্লকার (Beta-blockers) গ্রুপের ওষুধ সেবন করেন তাদের জন্য মিষ্টি আলু খাওয়ার ফলে রক্তে পটাশিয়ামের পরিমাণ অনেক বেড়ে যেতে পারে। আর তাই এই ধরনের ওষুধ সেবন করেন এমন ব্যক্তিদের জন্য মিষ্টি আলু বর্জন করতে হবে অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে অল্প পরিমাণে খেতে হবে। 

যাদের কিডনিতে সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য উচ্চ পটাশিয়াম যুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না। যেহেতু মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম রয়েছে। তাই কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য মিষ্টি আলু খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। 

Bibliography

Julson, E. (2023, March 14). 6 Surprising Health Benefits of Sweet Potatoes. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/sweet-potato-benefits

Ware, M. (2019, November 04). What’s to know about sweet potatoes? Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/281438

Last Updated on October 31, 2023