আয়রন (Iron) হলো একটি খনিজ উপাদান যা শরীরের জন্য সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হয় এবং বিভিন্ন খাবার থেকে আমরা তা পেয়ে থাকি। আয়রনের অভাবে যেমন শরীরের নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলীতে ব্যঘাত ঘটে তেমনি ভাবে শরীরে অতিরিক্ত আয়রনের উপস্থিতি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর তাই আমাদের শরীরের জন্য কতটুকু পরিমাণে আয়রন প্রয়োজন এবং তা কোন ধরনের খাবার গ্রহণের মাধ্যমে পাওয়া যায় সেই বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান থাকা জরুরি।

এই অনুচ্ছেদে শিশু, নারী ও পুরুষের জন্য দৈনিক কতটুকু আয়রন গ্রহণ করা উচিত এবং কোন কোন খাবার থেকে তা পাওয়া যেতে পারে সেই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার কাদের জন্য বিপদজনক হতে পারে সেই বিষয়ক তথ্যাবলী।

শরীরে আয়রন এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?

রক্তের হিমোগ্লোবিন (Hemoglobin) তৈরিতে আয়রনের প্রয়োজন পড়ে। আর হিমোগ্লোবিন হলো রক্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা ফুসফুস থেকে শরীরের প্রত্যেকটি কোষে অক্সিজেন পরিবহনের কাজ করে। হিমোগ্লোবিন উৎপাদন ছাড়াও শরীরের আরো যে সমস্ত কাজে আয়রনের ভূমিকা রয়েছে তা হলোঃ

  • শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ
  • কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম (Cellular functioning)
  • এনজাইম ও হরমোন উৎপাদনে সহায়তা করা (Synthesis of hormones and enzymes)

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ (NIH of US) এর তথ্য অনুযায়ী একজন প্রজননক্ষম নারীর জন্য পুরুষের তুলনায় অধিক পরিমাণে আয়রনের প্রয়োজন হয়ে থাকে। বয়স ও লিঙ্গ ভেদে দৈনিক আয়রন গ্রহণের মাত্রা সম্পর্কিত NIH প্রদত্ত নির্দেশনা সমূহ নিচে ছক আকারে তুলে ধরা হলো: (National Institiute of Health, 2021)

বয়সপুরুষ (মিলিগ্রাম)মহিলা (মিলিগ্রাম)
৭ থেকে ১২ মাস১১১১
১ থেকে ৩ বছর
৪ থেকে ৮ বছর১০১০
৯ থেকে ১৩ বছর
১৪ থেকে ১৮১১১৫
১৯ থেকে ৫০১৮
৫১ বা তার বেশি বছর

 

উল্লেখ্য গর্ভকালীন সময়ে শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণে আয়রনের প্রয়োজন হয়ে থাকে। আর তাই গর্ভবতী নারীদের জন্য দৈনিক সর্বনিম্ন ২৭ মিলিগ্রাম (27 mg) আয়রন গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। তবে শিশুকে বুকের দুধ পান করান এমন মায়েদের জন্য দৈনিক ১০ মিলিগ্রাম আয়রন গ্রহণ করাই যথেষ্ট।

কেননা এমন মায়েদের ক্ষেত্রে সাধারণত মাসিক বন্ধ থাকে বা অনেকের ক্ষেত্রে অনিয়মিত ভাবে মাসিক হতে পারে। বুকের দুধ উৎপাদনের জন্য শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণে প্রোলাক্টিন (Prolactin) হরমোন নিঃসরণ হয় যা এসময় মায়েদের মাসিক বন্ধ থাকার জন্য বা অনিয়মিত হওয়ার জন্য দায়ী (Cherney, 2016). ।

আর মাসিক বন্ধ থাকলে বা অনিয়মিত হলে শরীরে আয়রনের চাহিদা কম থাকে।‌ আর তাই বুকের দুধ পান করানো মহিলাদের জন্য NIH এর নির্দেশনা অনুযায়ী দৈনিক ১০ মিলিগ্রাম আয়রন গ্রহণ করাই যথেষ্ট।

উল্লেখ্য, গর্ভকালীন সময়েও মাসিক বন্ধ থাকে কিন্তু এই সময়ে বেশি পরিমাণে আয়রন গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কারণ এই সময়ে গর্ভস্থ ভ্রূণের জন্য মায়ের শরীরে অতিরিক্ত আয়রনের চাহিদা তৈরি হয়।

আয়রন এর অভাবে কি হয়?

শরীরে আয়রনের অভাব হলে রক্তস্বল্পতার (Anemia) সৃষ্টি হয় যার লক্ষণ হিসেবে দেখা যায় দুর্বলতা, ক্লান্তি, মনোযোগ দিতে ব্যর্থতা, স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়া ইত্যাদি। এছাড়াও আয়রনের ঘাটতির ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং সহজেই ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। আর শিশুদের ক্ষেত্রে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হওয়া সহ মানসিক বিকাশে বিলম্ব ঘটে।

CBC (Complete blood counts) নামক একটি রক্ত পরীক্ষা করার মাধ্যমে রক্তে কি পরিমাণে হিমোগ্লোবিন রয়েছে তা দেখে রক্তস্বল্পতা নির্ণয় করা হয়। রক্তে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা হলো পুরুষদের জন্য ১৩ গ্রাম পার ডেসিলিটার (g/dL) এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ১২ গ্রাম পার ডেসিলিটার। সাধারণত এই মাত্রা ১০ গ্রাম পার ডেসিলিটার বা তার নিচে নেমে আসলে রক্তস্বল্পতা হয়েছে বলে ধরা হয়।

কাদের ক্ষেত্রে আয়রনের ঘাটতি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে? 

অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আয়রনের অভাব হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ দরিদ্র পরিবারে যেমন পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে না তেমনি ভাবে সচেতনতার অভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রেও উদাসীনতা দেখা যায়। পুষ্টিকর খাবারের অভাবে শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন গ্রহণ করতে পারে না। আবার স্বাস্থ্যবিধি না মানার ফলে কৃমির সংক্রমণ হয়ে থাকে যা শরীরে রক্তস্বল্পতা সৃষ্টির একটি প্রধান কারণ।

তবে এর বাইরেও আরো যে সমস্ত বিষয় বা রোগের সাথে শরীরে আয়রনের ঘাটতি হওয়ার বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে তা হলোঃ

  • মহিলাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিমাণে মাসিক হওয়া।
  • গর্ভকালীন সময় বিশেষত যারা কম বয়সে গর্ভধারণ করে থাকেন।
  • কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণকারী বাচ্চা। (low-birthweight)
  • যারা ঘন ঘন রক্ত দান করেন।
  • নিরামিষাশী।(vegetarians)
  • পাকস্থলীতে আলসার।
  • কোলন ক্যান্সার (Colon cancer) ইত্যাদি।

আয়রন কত ধরনের হয়ে থাকে?

অনেক বেশি পরিমাণে আয়রন রয়েছে এমন খাবার গুলোকে লৌহ জাতীয় খাবার বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে আয়রন সমৃদ্ধ বা লৌহ জাতীয় খাবার হিসেবে কি কি রয়েছে তা জানার পূর্বে আয়রনের ধরন সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। আয়রন (iron) মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে। যেমনঃ

Heme iron: প্রাণিজ উৎস থেকে প্রাপ্ত আয়রন কে heme iron বলা হয় যা শরীর খুব সহজেই গ্রহণ (absorb) করতে পারে।

Non-heme iron: এই ধরনের আয়রন উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে পাওয়া যায় যা শরীর সহজে গ্রহণ করতে পারে না। আর তাই শুধু নিরামিষ খাবার গ্রহণ করেন এমন মানুষদের ক্ষেত্রে শরীরে আয়রনের অভাব বা রক্তস্বল্পতা হওয়ার অধিক সম্ভাবনা দেখা যায়।

বাংলাদেশে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার

বাংলাদেশে heme এবং non-heme উভয় ধরনের আয়রন যুক্ত খাবার অনেক পাওয়া যায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি খাবার এবং তাতে বিদ্যমান পুষ্টিগুণ নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।

আয়রন যুক্ত খাবার এর তালিকা

  • কলিজা

কলিজা

গরু ও মুরগির কলিজা হলো আয়রনের একটি সেরা উৎস। প্রতি ১০০ গ্রাম মুরগির কলিজা থেকে ৯ মিলিগ্রাম আয়রন পাওয়া যায় যা একজন প্রজননক্ষম নারীর দৈনিক চাহিদার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পূরণ করতে পারে। অপরদিকে ১০০ গ্রাম গরুর কলিজা থেকে প্রায় ৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত আয়রন পাওয়া যায়‌।

আয়রন ছাড়াও কলিজা থেকে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন ও ক্যালরি পাওয়া যায় যা দৈহিক কার্যক্রম ও বেড়ে উঠার জন্য প্রয়োজনীয়। আর তাইতো বিশেষত শিশুদেরকে কলিজা খাওয়ানোর নির্দেশনা দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা। (Kubala, 2021)

  • গরুর মাংস

গরুর মাংস

খাবার হিসেবে গরুর মাংস পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুব কমই আছে। সুস্বাদু এই খাবারটিকে আয়রনের উৎস বিবেচনাতেও উৎকৃষ্ট খাবার বলা যায়। কারণ প্রতি ১০০ গ্রাম গরুর মাংস থেকে প্রায় ২.৭ মিলিগ্রাম আয়রন পাওয়া যায় যা একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের দৈনিক চাহিদার প্রায় ৩৩ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে।

তবে শুধু আয়রন রয়েছে বলেই সবার জন্য গরুর মাংস খাওয়া সমীচিন হবে না। বিশেষত পাইলস (Hemorrhoids) রয়েছে এমন ব্যক্তিদের জন্য গরুর মাংস খাওয়া উচিত নয়। কারণ তাতে কোষ্ঠকাঠিন্যের সৃষ্টি হয় এবং পাইলসের সমস্যা বেড়ে যায়।

পাইলস এর রোগীদের খাদ্য তালিকা সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

  • মুরগির মাংস

প্রতি ১০০ গ্রাম মুরগির মাংসে রয়েছে ১.১৬ মিলিগ্রাম আয়রন এবং সেই সাথে আরো রয়েছে ২৫ গ্রাম প্রোটিন ও ২১৯ কিলোক্যালরি শক্তি। প্রোটিনের উৎস হিসেবে আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো মুরগির মাংস কারণ তা সহজলভ্য এবং বেশ সাশ্রয়ী।

তবে সাশ্রয়ী দামে কিনতে পাওয়া যায় বলেই ফার্মের মুরগি (বিশেষত সাদা ব্রয়লার মুরগি) বেশি বেশি খাওয়া উচিত নয়। কারণ ফার্মে পালন করা এই মুরগি গুলো যেনো দ্রুত বেড়ে উঠে এমন ধরনের খাবার খাওয়ানো হয়ে থাকে যা পরবর্তীতে মানুষের শরীরের উপর মারাত্বক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

  • ডিমের কুসুম

সকল বয়সের প্রায় সব মানুষ ডিম খেতে পছন্দ করেন। ডিমের কুসুমে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে। প্রতিদিন ২ টি করে ডিম খেলে তা থেকে প্রায় ১.২৬ মিলিগ্রাম আয়রন পাওয়া যাবে।

ডিমের কুসুমে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট রয়েছে যা রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের (LDL- low density lipoprotein) মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। আর তাই যাদের হার্টের সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বিশেষত মধ্যবয়সী পুরুষ ও মহিলাদের জন্য ডিমের কুসুম না খাওয়াই উত্তম।

  • সামুদ্রিক মাছ

প্রাণিজ আমিষ হিসেবে তুলনামূলক নিরাপদ প্রকৃতির খাদ্য হলো মাছ। বিশেষত সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে আমিষ ও আয়রন পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম সামুদ্রিক মাছের মধ্যে প্রায় ২ থেকে ৩ মিলিগ্রাম আয়রন রয়েছে।

মাছের মধ্যে যে ফ্যাট বা চর্বি রয়েছে তাকে বলা হয় ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। বরং এটি হলো Cardio protective অর্থাৎ হার্টের জন্য উপকারী ফ্যাট।

  • ফর্টিফায়েড সিরিয়াল

প্রাণিজ উৎসের পরে আয়রনের সেরা উৎস হিসেবে রয়েছে ফর্টিফায়েড সিরিয়াল। যারা নিরামিষাশী অর্থাৎ প্রাণিজ আমিষ জাতীয় খাবার গ্রহণ করেন না তাদের জন্য এটি বিশেষ উপকারী খাবার। ফর্টিফায়েড সিরিয়াল বলতে বোঝায় বিভিন্ন উপায়ে খাবারের পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি করা।‌ যেমনঃ ওটমিল (oatmeal) এর সাথে দুধ,‌ বাদাম, মধু ইত্যাদি মেশানো।

১ বাটি ফর্টিফায়েড সিরিয়াল (৪০ থেকে ৫০ গ্রাম পরিমাণ) গ্রহণের মাধ্যমে দিনের আয়রন চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে।

  • পালংশাক

পালংশাক সহ যেকোনো সবুজ বর্ণের শাকসবজি থেকে প্রচুর পরিমাণে আয়রন পাওয়া যেতে পারে। প্রতি ১০০ গ্রাম পালংশাকে ২.৭ মিলিগ্রাম আয়রন রয়েছে।

পালংশাকের মধ্যে আরো রয়েছে ভিটামিন সি (Vitamin C) যা‌‌ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং আয়রন শোষণের (Absorption) ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।

সতর্কতা

হাইপোথাইরয়েডিজমে (Hypothyroidism) আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে পালংশাক বর্জন করা উচিত। কারণ পালংশাকের মধ্যে রয়েছে Goitrogens নামক একপ্রকার উপাদান যা থাইরয়েডের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটায়।

  • ডাল ও মসুর ডাল

বাংলাদেশে মুগ, মসুর, ছোলা, মটর, মাষকলাই, খেসারি প্রভৃতি রকমের ডাল পাওয়া যায়। ডাল‌ থেকে প্রচুর পরিমাণে আমিষ ও আয়রন পাওয়া যায়। তবে সব রকমের ডালের মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হলো মসুরের ডাল। প্রতি ১০০ গ্রাম মসুরের ডালের মধ্যে ৪.৮ মিলিগ্রাম আয়রন পাওয়া যায়। তবে আয়রন ছাড়াও এতে পাওয়া যেতে পাওয়া যেতে পারে ২৫ গ্রাম আমিষ, ৬৯ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ৩৪৩ কিলোক্যালরি শক্তি।

  • কাজুবাদাম

কাজুবাদাম

সব ধরনের বাদামের মধ্যেই আয়রন রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে কাজুবাদামের মধ্যে। যেখানে প্রতি ১০০ গ্রাম চীনাবাদাম থেকে মাত্র ২ মিলিগ্রাম আয়রন পাওয়া যায় সেখানে প্রতি ১০০ গ্রাম কাজুবাদামের মধ্যে রয়েছে ৬.৬৮ মিলিগ্রাম আয়রন।

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল গুলোতে কাজুবাদামের চাষ হয়ে থাকে। তবে সারা‌দেশের বিভিন্ন দোকানে কাজুবাদাম কিনতে পাওয়া যায়। সাধারণত কাঁচা অবস্থায় অথবা ভেজে কাজুবাদাম খাওয়া যায়।

  • শিমের বিচি

শিমের বিচির অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো আয়রন, প্রোটিন, আঁশ (fiber), ক্যালসিয়াম ইত্যাদি।

প্রতি ১০০ গ্রাম শিমের বিচি থেকে ২.৯ মিলিগ্রাম আয়রন পাওয়া যায়। এর পাশাপাশি ৮.৭ গ্রাম প্রোটিন, ২৮ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ১২৭ কিলোক্যালরি পাওয়া যেতে পারে।

  • মিষ্টি কুমড়ার বিচি

খাবার হিসেবে মিষ্টি কুমড়া সবার কাছেই পরিচিত। মিষ্টি কুমড়া অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি খাবার বিশেষত এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ (Vitamin A) রয়েছে।

তবে খাবার হিসেবে মিষ্টি কুমড়ার বিচির কথা অনেকের কাছেই অপরিচিত বা রীতিমতো বিস্ময়কর মনে হতে পারে। কিন্তু এটি একটি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার যার প্রতি ৩০ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ ২.৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত আয়রন পাওয়া যেতে পারে। মিষ্টি কুমড়ার বিচি রোদে শুকিয়ে ভাজার পরে তা‌‌ খাওয়া যায়।

  • কচু শাক

রক্তস্বল্পতার রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা প্রায়ই কচু শাক খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তার‌ কারণ হলো রক্তস্বল্পতা হয়ে থাকে আয়রনের অভাবে আর কচু শাক খাওয়ার মাধ্যমে আয়রন পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম পরিমাণ কচু শাকের মধ্যে ২.২৫ মিলিগ্রাম আয়রন পাওয়া যায়। আয়রনের পাশাপাশি এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ এবং ভিটামিন সি। আর কচু শাকের মধ্যে থাকা ভিটামিন সি আয়রন শোষণের ক্ষেত্রেও সহায়তা করে থাকে।

  • শুকনো ফল (Dry Fruits)

শুকনো ফল বলতে কিসমিস, খেজুর, আখরোট ইত্যাদিকে বোঝানো হয়ে থাকে। শুকনো ফলের মধ্যে পানির পরিমাণ কম থাকে কিন্তু ফলের অন্যান্য পুষ্টি গুণাগুণ প্রায় অক্ষুন্ন থাকে।

আধ কাপ শুকনো ফলের মধ্যে প্রায় ২.১৬ মিলিগ্রাম আয়রন রয়েছে। এছাড়াও আরো রয়েছে ক্যালসিয়াম,‌ ভিটামিন, শর্করা ইত্যাদি। ফাস্টফুডের পরিবর্তে আদর্শ খাবার হিসেবে শুকনো ফল খাওয়ার অভ্যাস করা উচিত।

  • কালো চকলেট বা ডার্ক চকলেটে

প্রতি ৮৫ গ্রাম কালো চকলেট থেকে প্রায় ৭ মিলিগ্রাম আয়রন পাওয়া যায়। আর তাই আয়রনের উৎস হিসেবে কালো চকলেটকে খাদ্য তালিকায় প্রাধান্য দেওয়া উচিত। আয়রনের উৎস বিবেচনার বাইরেও কালো চকলেটের আরো কিছু উপকারিতা রয়েছে। যেমনঃ (Spritzler, 2020)

  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
  • ত্বক ভালো রাখে।
  • মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
  • হার্টের রোগের ঝুকি কমায়।
  • রাজমা

রাজমা

উদ্ভিজ্জ উৎসজাত এই খাবারটি নিরামিষাশী ব্যক্তিদের জন্য অত্যন্ত উপকারী যাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও প্রোটিন। প্রতি ১০০ গ্রাম রাজমা থেকে প্রায় ৩.২ মিলিগ্রাম আয়রন পাওয়া যায়। রাজমার অন্যান্য উপকারিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • এতে রয়েছে এন্টি অক্সিডেন্ট যা ক্যান্সার প্রতিরোধে‌ বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
  • রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
  • শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে ইত্যাদি।

আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের ব্যাপারে সতর্কতা

শুধুমাত্র আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খেতে থাকলেই তা শরীরের জন্য উপকারী হবে এমনটি নয়। বরং আয়রন গ্রহণের জন্য খাবার খাওয়ার পরে হজম (Digestion) এবং অন্ত্রের মাধ্যমে তা শোষণ (Absorption) হওয়া জরুরি। আর এই প্রক্রিয়াগুলো সঠিক ভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য কিছু বিশেষ নির্দেশনা মেনে চলা উচিত। যেমনঃ

গবেষণায় দেখা গেছে যে চা ও কফিতে থাকা ট্যানিন (Tannins) নামক একটি উপাদান অন্ত্রের মাধ্যমে আয়রন গ্রহণের ক্ষেত্রে বাঁধার সৃষ্টি করে থাকে। আর তাই রক্তস্বল্পতা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের জন্য চা ও কফি পান করা উচিত নয়। (Lewin, 2021)

আয়রন শোষণের ক্ষেত্রে ভিটামিন সি এর প্রভাব

অন্ত্রে আয়রন শোষণের ক্ষেত্রে ভিটামিন সি (Vitamin C) বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। আর তাই আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের পাশাপাশি ভিটামিন সি রয়েছে এমন খাবার গ্রহণ করতে হবে। উল্লেখ্য ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার গুলো হলো লেবু, কমলা, মালটা, আঙুর, পেঁপে, আনারস, জাম, শশা, গাজর, টমেটো, কাঁচা মরিচ, পুদিনাপাতা ইত্যাদি।

আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের নিয়ম

আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের নিয়ম  

শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণে আয়রনের ঘাটতি দেখা দিলে সেক্ষেত্রে খাবারের পাশাপাশি আয়রন সাপ্লিমেন্ট (আয়রন বড়ি) গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। বিশেষত গর্ভকালীন সময়ে চিকিৎসকেরা আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হলো একই সাথে ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট (Calcium tablet) এবং আয়রন বড়ি খাওয়া যাবে না। কারণ তাতে অন্ত্রে আয়রন শোষণের ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটে। আর‌ তাই দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আলাদাভাবে দুই ধরনের সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।

বিশেষ সতর্কতা

এছাড়াও আরেকটি বিশেষ সতর্কতা হলো অতিরিক্ত পরিমাণে আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না। খাবার গ্রহণের মাধ্যমে শরীরে আয়রনের অতিরিক্ততা না ঘটলেও দিনে ২৫ মিলিগ্রাম বা তার বেশি মাত্রায় আয়রন বড়ি খাওয়ার ফলে নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। যেমনঃ

  • পেটে ব্যথা।
  • বমি বমি ভাব।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য।
  • খিঁচুনি ইত্যাদি।

কাদের জন্য আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা ঝুঁকিপূর্ণ?   

হাইপোথাইরয়েডিজম এর রোগীদের জন্য নিয়মিত Levothyroxine ওষুধ সেবনের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। একই সাথে আয়রন সাপ্লিমেন্ট এবং এই ওষুধটি সেবন করা হলে সেক্ষেত্রে levothyroxine এর কার্যকারিতা হ্রাস পায় যা হাইপোথাইরয়েডিজম রোগীর জন্য জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। আর তাই এই দুই ধরনের ওষুধ দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আলাদাভাবে সেবন করা উচিত।

হাইপোথাইরয়েডিজম রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন

শুধুমাত্র আয়রন সাপ্লিমেন্টই নয়, বরং আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের ফলেও ক্ষেত্রবিশেষে সমস্যা হতে পারে। যেমনঃ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বেলায় প্রতিনিয়ত রক্ত সঞ্চালনের (Blood transfusion) প্রয়োজন পড়ে। আর যার দরুন শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণে আয়রন জমা হতে থাকে।

আর তাই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়ে থাকে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগী যদি আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করেন তবে সেক্ষেত্রে শরীরে আয়রনের অতিরিক্ততার (Iron overload) ফলে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে।

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য বিশেষ বিশেষ করণীয় বিষয়াবলী সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

আয়রন শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান যা প্রতিনিয়ত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে পাওয়া যায়। তবে খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে যেমন যথাযথ জ্ঞান থাকা জরুরি তেমনি ভাবে আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের মাধ্যমে অভাব পূরণের জন্য প্রয়োজন বিশেষ সতর্কতা। স্বাস্থ্য বিষয়ক সঠিক জ্ঞান অর্জন ও সতর্কতা সুস্থ্য ও সুন্দর জীবন যাপনের প্রথম পদক্ষেপ।

References

Cherney, k. (2016, March 29). Why Women Get Irregular Periods While Breast-Feedin. Retrieved from https://www.healthline.com/health/parenting/period-while-breast-feeding

Kubala, J. (2021, November 30). 30 High-Iron Foods That Aren’t Just Meat. Retrieved from Greatist: https://greatist.com/eat/foods-high-in-iron

Lewin, J. (2021, January 20). How to get more iron from the diet. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/322272

National Institiute of Health. (2021, March 22). Iron. Retrieved from NIH: https://ods.od.nih.gov/factsheets/Iron-Consumer/

Spritzler, F. (2020, January 27). 12 Healthy Foods That Are High in Iron. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/nutrition/healthy-iron-rich-foods#3.-Liver-and-other-organ-meats

Last Updated on April 12, 2023