ক্যালোরি কি?

ক্যালোরি (Calorie) হলো শক্তির একক যা পুষ্টিবিজ্ঞানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি টার্ম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মেশিনের মতো আমাদের শরীরের সকল কাজকর্মের জন্য প্রয়োজন হয় শক্তির যা আমরা খাবার থেকে পেয়ে থাকি। তবে সব খাবারের মধ্যে ক্যালোরি থাকে না। যেমনঃ পানি, ফাইবার, ভিটামিন, মিনারেল ইত্যাদি শরীরের জন্য উপকারী পুষ্টি উপাদান তবে এগুলো থেকে কোনো ক্যালোরি পাওয়া যায় না।

ক্যালোরির উৎস হলো কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট ও প্রোটিন জাতীয় খাবার। তবে সব খাবারে সম পরিমাণে ক্যালোরি থাকে না। দৈনিক আপনার শরীরের জন্য কত ক্যালোরি দরকার, কোন ধরনের খাবার থেকে কত ক্যালোরি পাওয়া যায়, কিভাবে ক্যালোরি গ্রহণ কমানো যায় এবং শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার টিপস নিয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

বিএমআর (BMR- basal metabolic rate)

একজন মানুষের দৈনিক ক্যালোরি চাহিদার নূন্যতম মাত্রা অর্থাৎ কোনো কাজকর্ম না করে বিশ্রামে থাকলেও শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখার জন্য যতটুকু ক্যালোরি দরকার হয় তা হলো বিএমআর। লিঙ্গ, বয়স, ওজন ও উচ্চতার উপর BMR এর মান নির্ভর করে। হ্যারিস বেনেডিক্ট এর সূত্র অনুযায়ী বিএমআর নির্ণয় করা যায় যা নিচে বর্ণনা করা হলোঃ

পুরুষ = ৬৬.৪ + (১৩.৭ × শরীরের ওজন কেজিতে) + (৫ × উচ্চতা সেন্টিমিটারে) – (৬.৮ × বয়স বছর হিসেবে)

মহিলা = ৬৫৫ + (৯.৫ × শরীরের ওজন কেজিতে) + (১.৮ × উচ্চতা সেন্টিমিটারে) – (৪.৭ × বয়স বছর হিসেবে)

এই সুত্র অনুযায়ী ২০ বছর বয়সী ৫ ফুট ২ ইঞ্চি (১৫৭.৫ সেন্টিমিটার) উচ্চতার ৫০ কেজি ওজনের একজন পুরুষের দৈনিক ক্যালোরি চাহিদার নূন্যতম মাত্রা (BMR) হবে ১৪০০ ক্যালোরি। একই বয়স, উচ্চতা ও ওজনের একজন নারীর বিএমআর হবে ১৩২০ ক্যালোরি। এই সূত্র থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, মহিলা দের বিএমআর পুরুষের তুলনায় কম এবং ওজন ও উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে বিএমআর বাড়তে থাকে তবে বয়সের সাথে সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক অর্থাৎ বয়স বাড়তে থাকলে BMR কমে যায়।

আরও পড়ুনঃ উচ্চতা বৃদ্ধির ঘরোয়া উপায় গুলো কি কি?

দৈনিক ক্যালোরি চাহিদা

BMR, SDA (specific dynamic action) এবং পরিশ্রমের ধরনের উপর ভিত্তি করে দৈনিক একজন মানুষের জন্য কত ক্যালোরি দরকার হবে তা হিসাব করে বের করা যায়। SDA হলো খাবার গ্রহণের পর হজম ও মেটাবলিসমের মাধ্যমে খাবার থেকে শক্তি উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়ায় ব্যয় হওয়া শক্তির পরিমাণ। অর্থাৎ আমরা যে খাবার খাই তা শক্তিতে রুপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় শরীরের নিজস্ব শক্তি ব্যয় হয় যাকে SDA বলা হয়। প্রোটিন জাতীয় খাবার থেকে শক্তি পাওয়ার জন্য তুলনামূলক একটু বেশি ক্যালোরি খরচ হয় তবে গড়ে সব খাবারের জন্য ১০ শতাংশ হিসেবে SDA ধরা হয়ে থাকে। প্রতি ১ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থেকে ৪ ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। তাহলে ১০০ গ্রাম থেকে পাওয়া যাবে ৪০০ ক্যালোরি কিন্তু খাবার থেকে এই পরিমাণ শক্তি পাওয়ার জন্য শরীরের ১০ শতাংশ ক্যালোরি ব্যয় হবে। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে ১০০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থেকে ৩৬০ ক্যালোরি পাওয়া যাবে।

খুব কম পরিশ্রম করেন এমন ব্যক্তিদের জন্য BMR এর সাথে ২৫ শতাংশ যোগ করে তার সাথে SDA এর ১০ শতাংশ মিলিয়ে দৈনিক ক্যালোরির চাহিদা নির্ণয় করতে হবে। BMR ১৪০০ ক্যালোরি হলে তার জন্য দৈনিক ১৯২৫ ক্যালোরি লাগবে। যারা মাঝারি প্রকৃতির পরিশ্রম করেন তাদের জন্য বিএমআর এর ৫০ শতাংশ এবং কঠোর পরিশ্রমী ব্যক্তিদের জন্য ১০০ শতাংশ যোগ করতে হবে। (Hoque, 2018)

গর্ভবতী নারীদের জন্য এই হিসেবের সাথে অতিরিক্ত ৩০০ ক্যালোরি যোগ করতে হবে কারণ পেটের ভেতরে থাকা বাচ্চা মায়ের শরীর থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে থাকে। একইভাবে শিশুকে বুকের দুধ পান করান এমন মায়েদের জন্য অতিরিক্ত ৫০০ ক্যালোরি গ্রহণ করতে হবে। (Hoque, 2018)

ক্যালোরি এবং খাবার

প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেটের ক্ষেত্রে প্রতি ১ গ্রামে ৪ ক্যালোরি রয়েছে। আর প্রতি ১ গ্রাম ফ্যাটে রয়েছে ৯ ক্যালোরি যা প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেটের তুলনায় অনেক বেশি। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী দৈনিক চাহিদার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যালোরি ফ্যাট থেকে নেওয়া যেতে পারে যার মধ্যে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের মাত্রা হওয়া উচিত ১০ শতাংশের কম এবং ট্র্যান্স ফ্যাট হতে হবে ১ শতাংশের কম‌। কার্বোহাইড্রেট থেকে ৬০ শতাংশ এবং প্রোটিন থেকে ১০ শতাংশ ক্যালোরি গ্রহণ করতে হবে।

মাঝারি প্রকৃতির পরিশ্রম করেন একজন যুবকের দৈনিক প্রায় ২৪০০ ক্যালোরির প্রয়োজন পড়ে। সেই হিসেবে দিনে প্রায় ৩৫০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৬০ গ্রাম প্রোটিন এবং সর্বোচ্চ ৮০ গ্রাম ফ্যাট খাওয়া যাবে। মহিলাদের ক্ষেত্রে সাধারণত দিনে ২০০০ ক্যালোরি দরকার হয় এবং সেই অনুপাতে সব ধরনের খাবার গ্রহণ করতে হবে।

কিভাবে ক্যালোরি গ্রহণ কমানো যায়?

শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখার জন্য ক্যালোরি প্রয়োজন। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে ক্যালোরি গ্রহণ করা হলে তা শরীরে ফ্যাট হিসেবে জমা হতে থাকে যা শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া সহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যেমনঃ হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সার। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ক্যালোরি গ্রহণ কমাতে হবে যেন শরীরে জমে থাকা ফ্যাট ভেঙ্গে যায় এবং সেই সাথে নতুন করে ফ্যাট জমা হওয়ার সুযোগ না পায়।‌ ক্যালোরি গ্রহণ কমানোর কয়েকটি সহজ ও কার্যকরী উপায় নিচে বর্ণনা করা হলোঃ (Ajmera, 2021)

  • সরল শর্করা (সাদা ভাত, গ্লুকোজ, ময়দা, রুটি, নুডলস, চিনি, মিষ্টি ইত্যাদি) বেশি খাওয়া যাবে না বরং প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে এমন খাবার (বাদামী চালের ভাত, গমের আটা, ওটস, ফলমূল ও শাকসবজি ইত্যাদি) খেতে হবে।
  • প্রোটিন খাওয়ার পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। কারণ কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন থেকে একই পরিমাণে ক্যালোরি পাওয়া গেলেও প্রোটিন জাতীয় খাবার থেকে ক্যালোরি পাওয়ার জন্য অনেক বেশি পরিমাণে SDA বা শরীরের নিজস্ব ক্যালোরি ব্যয় হয়ে থাকে।
  • খাওয়ার আগে পানি পান করা হলে সামান্য খাবার খাওয়ার পরে পেট ভরা মনে হবে। আর পানিতে কোনো ক্যালোরি থাকে না। তবে কোমল পানীয় পান করা যাবে না। কারণ সেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে চিনি তথা ক্যালোরি থাকে।
  • খাবারের সাথে প্রচুর পরিমাণে সালাদ (শশা, টমেটো, কাচা পেপে, গাজর ইত্যাদি) খেতে হবে। কারণ এগুলো পেট ভরাতে সাহায্য করবে তবে ক্যালোরির পরিমাণ খুব কম।

ওজন কমানোর কিছু প্রাথমিক টিপস

  • দৈনিক ক্যালোরি চাহিদার তুলনায় কিছুটা কম পরিমাণে খাবার গ্রহণ করতে হবে।
  • সকালের খাবার বাদ দেওয়া যাবে না। বরং সকালে স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে দিন শুরু করতে হবে।
  • দিনে অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। শুয়ে বসে অলস জীবন যাপন না করে বরং কায়িক শ্রমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
  • ফলের জুস না খেয়ে বরং আস্ত ফল খেতে হবে।‌ এতে করে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার পাওয়া যাবে।
  • কোনো বেলার খাবার না খেয়ে দিনের মধ্যে কয়েকবার স্ন্যাকস খাওয়া যাবে না। কারণ স্ন্যাকসের মধ্যে অনেক ক্যালোরি রয়েছে।
  • তুলনামূলক ছোট সাইজের প্লেটে খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।
  • ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় যতটা সম্ভব বর্জন করতে হবে।
  • মদ্যপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আপনি জেনে হয়তো অবাক হবেন যে, অ্যালকোহলের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ ক্যালোরি (প্রতি ১ গ্রামে ৯ ক্যালোরি হিসেবে) রয়েছে।

ক্যালোরি সংক্রান্ত উপরে উল্লেখিত হিসাব সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য হবে। যারা রোগাক্রান্ত অথবা বিশেষ কোনো ডায়েট পালন করছেন তাদের জন্য চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্যালোরি বা খাবার গ্রহণ করতে হবে। ওজন কমানোর জন্য কম পরিমাণে ক্যালোরি গ্রহণ করা সহ টিপস মেনে ফলাফল পাওয়া না গেলে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার সাথে বিভিন্ন রোগ ও হরমোনের সম্পর্ক রয়েছে।

References

Ajmera, R. (2021, December 03). How Many Calories Should You Eat Per Day to Lose Weight? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/how-many-calories-per-day#tips-to-eat-fewer-calories
Hoque, P. M. (2018). Nutrition. In P. M. Hoque, ABC of Medical Biochemistry (pp. 504 – 510). Dhaka: Parveen Sultana.

Last Updated on November 1, 2023