অনেকেই সকালের খাবার গ্রহণের ব্যাপারে বেশ উদাসীন আবার কেউ কেউ হয়তোবা শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য সকালের খাবার বর্জন করেন। এটি দিনের শুরুতেই করা সবচেয়ে বড় একটি ভুল, কারণ সুস্বাস্থ্য বজায় ও শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য সকালের খাবারের গুরুত্ব অপরিসীম।

তবে হ্যাঁ, সারাদিন সুস্থ এবং সবল থাকার জন্য সকালের নাস্তায় অবশ্যই স্বাস্থ্যকর খাবার থাকতে হবে। সকালের খাবার কেমন হওয়া উচিত সেই বিষয়ে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের পুষ্টি বিষয়ক (Nutrition) এক্সপার্টদের নির্দেশনা নিয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

সকালের খাবার কখন খাওয়া উচিত?

সকালের খাবারকে ইংরেজিতে Breakfast বলা হয় যা বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় Break অর্থ ভাঙ্গা এবং fast অর্থ উপবাস। অর্থাৎ রাতে খাওয়ার প্রায় ৮ থেকে ১০ ঘন্টা পর সকালের খাবার খাওয়া হয় আর তাই এর গুরুত্ব অনেক বেশি। রাতের বেলা আমরা ঘুমিয়ে থাকি বলে হজম প্রক্রিয়া খুব ধীর গতিতে হয় আর তাই এতো দীর্ঘ সময়ের মাঝেও খাবার গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু দিনের শুরুতেই শরীরে খাবার তথা শক্তির চাহিদা দেখা দেয়।

সকালে ঘুম থেকে উঠার পরবর্তী দুই ঘন্টার মধ্যে নাস্তা করে নেওয়া উত্তম। আপনি চাইলে আরো আগেও খেতে পারেন, তবে দুই ঘন্টা অতিক্রম করা উচিত নয়। কারণ তাতে শরীরে ক্যালরির ঘাটতি হওয়া সহ এসিডিটির সমস্যা দেখা দিতে পারে।

সকালের স্বাস্থ্যকর খাবার

Healthy breakfast

সকালের খাবারের তালিকা স্বাস্থ্যকর (Healthy) খাবার সম্পন্ন হতে হবে কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্বাস্থ্যকর খাবার কাকে বলে এবং কোনগুলো? সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার জন্য শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি এবং শক্তি সরবরাহ করে এমন খাবারকেই স্বাস্থ্যকর খাবার বলা হয়। হার্ভার্ডের পুষ্টি বিষয়ক এক্সপার্টদের মতে, সকাল বেলার স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা এর মধ্যে থাকতে হবে ভালো মানের প্রোটিন, প্রচুর পরিমাণে ফাইবার সমৃদ্ধ কার্বোহাইড্রেট যা দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা রাখবে এবং সেই সাথে শাকসবজি অথবা ফলমূল। (Harvard Medical School, 2019)

এছাড়াও সকালের নাস্তা রেসিপি এর মধ্যে যেন অতিরিক্ত পরিমাণে ফ্যাট বা চর্বি, লবণ তথা সোডিয়াম, সরল শর্করা বা সুগার ইত্যাদি না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে চলুন দেখে নেয়া যাক, সকালের ১০টি স্বাস্থ্যকর খাবার রেসিপি যা গ্রহণে আপনার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে।

১. ডিম, কলা, টোস্ট:

এই তিনটি খাবার একসাথে সকালের জন্য দারুন নাস্তা হতে পারে যা খেতে বেশ সুস্বাদু এবং সব ধরনের পুষ্টির চাহিদা মেটাবে। যেমনঃ ডিম হলো প্রোটিনের সবচেয়ে ভালো উৎস। আর কলাতে রয়েছে পটাশিয়াম, ফাইবার ইত্যাদি এবং টোস্ট শর্করার চাহিদা পূরণ করবে। সকালের নাস্তায় ১ থেকে ২ টি সিদ্ধ ডিম খেতে পারেন। তবে রক্তে কোলেস্টেরল এর পরিমাণ বেশি রয়েছে এমন মানুষের জন্য ডিমের কুসুম এড়িয়ে যাওয়া উচিত। কলা ১-২ টি এবং টোস্ট ২-৩ টি খাওয়া যাবে।

২. আটার রুটিঃ

সকাল বেলায় অনেকেই ভাত খেতে পছন্দ করেন। কিন্তু ভাতের তুলনায় আটার রুটি খুবই ভালো একটি খাবার। কারণ, ভাতের চেয়ে এতে বেশি পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা রাখতে সহায়তা করবে।

রুটির সাথে সবজি ভাজি, ডাল, ডিম, ঝোল তরকারি অথবা কলা দিয়ে খেতে পারেন। রুটির তুলনায় তেলে ভাজা পরোটাতে বেশি ক্যালরি এবং ফ্যাট রয়েছে, আর তাই এটি না খাওয়াই ভালো। তবে যারা বেশি পরিমাণে শারীরিক পরিশ্রম করেন অর্থাৎ অধিক ক্যালরি দরকার হয় তাদের জন্য পরোটা খাওয়া যেতে পারে।

৩. ওটসঃ

nutritional value of oats

ওটস খেতে খুব মজাদার না হলেও দেহের জন্য খুবই স্বাস্থ্যকর একটি খাবার ওটস এর উপকারিতা অনেক । এতে থাকা প্রচুর পরিমাণে ফাইবার শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে এবং রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। দুধ চিনি দিয়ে জ্বাল দিয়ে অথবা সাথে কোনো ফল (যেমনঃ পাকা আম, কাঁঠাল, কলা ইত্যাদি) নিয়ে, অথবা ওটস এর খিচুড়ি রান্না করে একবাটি সকালের নাস্তা হিসেবে খেতে পারেন যা আপনার জন্য চমৎকার একটি নাস্তা হবে।

৪. খিচুড়িঃ

অনেকেই ভাত ছাড়া সকালে টিকতে পারেননা। তাদের জন্য ভাতের পরিবর্তে সকালে মজাদার এবং স্বাস্থ্যকর সবজি খিচুড়ি খেতে পারেন। অল্প পরিমাণে চাল ও বেশি করে সবজি দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি ভারী নাস্তা হিসেবে কাজে লাগবে।

৫. ফলঃ

শুধু ফল অথবা ফলের সালাদ বানিয়ে সকালের নাস্তা হিসেবে খেতে পারেন। বিশেষত মৌসুমি ফলের নাস্তা সবচেয়ে ভালো। ২টি কলা, ১টি আপেল, ১টি কমলা, ২/৩টি স্ট্রবেরি, কিছু আঙ্গুর একসাথে মিক্স করে সালাদ বানিয়ে নাস্তা করা যায়। এর পাশাপাশি আপনি চাইলে প্রোটিনের উৎস হিসেবে ১-২ টি ডিম সিদ্ধ অথবা ১ গ্লাস দুধ খেতে পারেন।

৬. সালাদঃ

সালাদ বলতেই আমরা শসা, টমেটো, গাজর, পেঁয়াজ, মরিচ, লেবু ইত্যাদি বুঝি। সুস্বাস্থ্যের জন্য আপনি গাজর, টমেটো, শসার সাথে সেদ্ধ ডিম, সেদ্ধ মাংস অথবা সেদ্ধ ছোলাবুট মিশাতে পারেন। সালাদ দিয়ে সকালের নাস্তা করলে শরীরের ওজন কমানোর ক্ষেত্রে আপনি চমৎকার ফলাফল পেতে পারেন। শুধু ফলমূল ও সালাদ সকালের নাস্তা হিসেবে সবচেয়ে উপকারী ভূমিকা রাখে নিরামিষাশীদের জন্য অর্থাৎ যারা প্রাণিজ আমিষ জাতীয় খাবার গ্রহণ করেন না।

৭. দইঃ

অনেকে সকাল সকালই দই খেতে চান না। কিন্তু দেহের জন্য দই খুবই উপকারী ১টি খাবার। দই এ থাকা ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠন মজবুত করে। দিনের শুরুতে দই খেলে দিনের শেষেও থাকবে অফুরন্ত এনার্জি। দই এর সবচেয়ে ভালো একটি রেসিপি হলো চিড়ার সাথে দই মিশিয়ে খাওয়া। চিড়া দীর্ঘসময় ধরে পেট ভরা রাখে ও শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

৮. বাদামঃ

নানাধরনের বাদাম রয়েছে তবে এর মধ্যে কাঠবাদাম অথবা কাজুবাদাম সকালের খাবার হিসেবে সবচেয়ে ভালো হবে। রাতে একটি বাটির মধ্যে পরিষ্কার পানিতে কয়েকটি বাদাম ভিজিয়ে রেখে সকালে খাওয়ার মাধ্যমে অনেক উপকারিতা পাওয়া যায়। যেমনঃ এতে থাকা পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম হার্ট ভালো রাখতে সহায়তা করে। এছাড়াও বাদাম থেকে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ফ্যাট পাওয়া যায়। তবে শুধু বাদাম খেয়ে ক্ষুধা বোধ দূর না হলে এর পাশাপাশি সবজি, টোস্ট, কলা, ইয়োগার্ট ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।

৯. প্রোটিন সেক (Protein shakes):

বাজারে বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন পাউডার কিনতে পাওয়া যায় যার সাথে দুধ, কলা ইত্যাদি মিশিয়ে ব্লেন্ডারে খুব সহজেই আপনি সকালের নাস্তা তৈরি করতে পারেন।‌ এর পাশাপাশি আপনি আরো কিছু স্বাস্থ্যকর খাদ্য উপাদান যোগ করতে পারেন। যেমনঃ ফ্লাক্স সিড, চিয়া সিড, পিনাট বাটার ইত্যাদি।‌ প্রোটিন সেক একাধারে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার যা থেকে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি পাওয়া যায়। আর যাদের সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে কাটে তাদের জন্য সকালে বেশি ক্যালরি সমৃদ্ধ নাস্তা সারাদিনের কর্মক্ষমতা ভালো রাখতে সহায়তা করে।‌ (Spritzler, 2021)

১০. গ্রিন টি

গ্রিন টি

ঘুম ভাব কাটিয়ে শরীর ও মন চাঙ্গা করতে সকাল বেলায় এক কাপ চায়ের জুড়ি নেই। আর সেই চা যদি হয় গ্রিন টি, তবে তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী ভূমিকা রাখবে। গ্রিন টির সাথে আদা, লেবু, পুঁদিনা পাতা ইত্যাদি যোগ করে পুষ্টিগুণ আরো বাড়িয়ে তুলতে পারেন। আর চায়ে চিনির পরিবর্তে সামান্য পরিমাণে মধু মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। তবে শুধুমাত্র চা কিংবা কফি যেন সকালের নাস্তা না হয়, বরং সকালের নাস্তার পর এক কাপ চা খেয়ে কাজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন।

উল্লেখিত স্বাস্থ্যকর খাবারের তালিকা থেকে আপনার পছন্দমতো সকালের নাস্তা সম্পন্ন করুন। প্রত্যেক দিন একই খাবার খেতে বোরিং লাগলে একেক দিন একেক রকম নাস্তা করতে পারেন। আর সবসময় মনে রাখবেন, সুস্থ থাকার জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার রুটিন মেনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

 

References

Harvard Medical School. (2019, December 14). 4 ways to boost your energy naturally with breakfast. From Harvard Health Publishing: https://www.health.harvard.edu/staying-healthy/4-ways-to-boost-your-energy-naturally-with-breakfast

Spritzler, F. (2021, October 25). The 12 Best Foods to Eat in the Morning. From Healthline: https://www.healthline.com/nutrition/12-best-foods-to-eat-in-morning#TOC_TITLE_HDR_10

 

 

Last Updated on April 15, 2023