রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের (এলডিএল বা লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন ও ট্রাইগ্লিসারাইড) মাত্রা বেশি থাকলে হার্টের রোগের (হার্ট অ্যাটাকস্ট্রোক) ঝুঁকি বেড়ে যায়। ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানো এবং উপকারী কোলেস্টেরলের (এইচডিএল বা হাই ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন) মাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে খাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার মাধ্যমে রক্তে কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখা সম্ভব হয়। এই অনুচ্ছেদে ১৩টি খাবার সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে যা রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানো এবং উপকারী কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করবে। 

১৩ টি খাবার এর বর্ণনা

লিপিড প্রোফাইল টেস্ট এর মাধ্যমে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা সম্পর্কে ধারণা অনুযায়ী ব্যক্তিভেদে খাদ্যতালিকা ভিন্নতর হতে পারে। সাধারণভাবে কোলেস্টেরল লেভেল ভালো রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখে এমন ১৩টি খাবার নিচে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়াও কোন খাবারগুলো বর্জন করতে হবে সেই সম্পর্কে জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

১। বাদাম

বাদাম কে সুপার ফুড বলা হয়। বাদাম থেকে ভালো মানের ফ্যাট (আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট), প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন, মিনারেলস ও ফাইবার পাওয়া যায়। 

নিয়মিত বাদাম খাওয়ার অভ্যাস রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায়। প্রতিদিন যেকোনো ধরনের (সবচেয়ে সহজলভ্য হলো চীনাবাদাম) একমুঠো বাদাম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।  

২। অ্যাভোকাডো 

avocade

অ্যাভোকাডো থেকে প্রচুর ফাইবার, আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, ভিটামিন ও এন্টি-অক্সিডেন্ট পাওয়া যায়।   

গবেষণায় দেখা গেছে যে, অ্যাভোকাডো খাওয়ার অভ্যাস রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং উপকারী কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়। (Jennings, 2023)

অ্যাভোকাডো একটি বিদেশী ফল যা আমাদের দেশে সহজলভ্য নয়। তবুও পুষ্টিগুণ বিচারে মাঝেমধ্যে খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত।  

৩। মাছ

যত ধরনের প্রাণীজ জাতীয় খাবার রয়েছে তার মধ্যে হার্টের জন্য সবচেয়ে উপকারী হলো মাছ। মাছ থেকে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায় যা হার্টের রোগের ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

সপ্তাহে অন্তত ২দিন খাদ্যতালিকায় মাছ রাখা উচিত। শুধুমাত্র একধরনের মাছ না খেয়ে বরং বিভিন্ন সাইজ ও ধরনের মাছ (সামুদ্রিক খাবার সহ) খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।  

৪। ওটস ও যব 

প্রচুর ফাইবার সমৃদ্ধ শর্করা জাতীয় খাবার হলো ওটস ও যব। এগুলো কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার তবে দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে। সেই সাথে শরীরের ওজন কমানো সহ রক্তে সুগার ও কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

ফলমূল বা ইয়োগার্ট সহযোগে ওটস ও যবের ছাতু খেতে বেশ সুস্বাদু লাগবে।

৫। ফ্যাট-ফ্রি দুধ 

প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অনেকেই দুধ রাখতে পছন্দ করেন। দুধ অনেক পুষ্টিকর খাবার তবে দুধে প্রচুর ফ্যাট রয়েছে যা রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। 

রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে দুধ খেতে চাইলে ফ্যাট-ফ্রি দুধ কিনতে হবে।

৬। ফলমূল

ফলমূল থেকে প্রচুর ফাইবার, এন্টি-অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন পাওয়া যায়। রক্তে কোলেস্টেরলের সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য খাদ্যতালিকায় ফলমূল রাখতে হবে।

বিভিন্ন বর্ণ ও স্বাদের ফল পাওয়া যায় যার একেকটি একেক ধরনের পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। শুধুমাত্র একধরনের ফল না খেয়ে বরং নানান রকমের ফলমূল খেতে হবে। ‌

যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের জন্য মিষ্টিজাতীয় ফলগুলো পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।

৭। শাকসবজি 

শাকসবজি থেকে প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্ট পাওয়া যায় যা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও শাকসবজি হলো কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার তবে প্রচুর পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। 

প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ শাকসবজি রাখতে হবে। বিভিন্ন বর্ণের শাকসবজি খেতে হবে। কারণ একেক বর্ণের শাকসবজি থেকে একেক ধরনের এন্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান পাওয়া যায়।

৮। গ্রিন টি

green tea

গ্রিন টি হলো অন্যান্য চা ও কফির তুলনায় কম পরিমাণ ক্যাফেইন এবং প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। নিয়মিত গ্রিন টি পানের অভ্যাস রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ কাপ গ্রিন টি খেতে পারেন। তবে গ্রিন টিতে চিনি মেশানো যাবে না। স্বাদ ও ফ্লেভার বৃদ্ধি করার জন্য গ্রিন টিতে আদা, লেবু, লবঙ্গ, পুদিনাপাতা ইত্যাদি যোগ করা যেতে পারে।

৯। অলিভ অয়েল

রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা ভালো রাখার জন্য রান্নার কাজে অলিভ অয়েল ব্যবহার করা সবচেয়ে উপকারী হবে। অলিভ অয়েল স্বাস্থ্যকর ফ্যাট সমৃদ্ধ এবং এতে প্রচুর পরিমাণ এন্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে।

অলিভ অয়েলের দাম একটু বেশি। তাই রান্নার কাজে সয়াবিন বা সূর্যমুখী তেল ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে নারিকেল তেল বা পাম অয়েল ব্যবহার করা যাবে না। কারণ এগুলো ক্ষতিকর ফ্যাট সমৃদ্ধ।

১০। ইসবগুলের ভুসি 

ইসবগুলের ভুসি রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন রাতে ২ চা‌ চামচ ইসবগুলের ভুসি পানিতে গুলিয়ে খেলে‌ উপকার পাওয়া যায়। (Harvard Health, 2019)

১১। ডার্ক চকোলেট

ডার্ক চকোলেট হলো ৭০ শতাংশের বেশি কোকোয়া (Cocoa) সমৃদ্ধ চকোলেট। ডার্ক চকোলেটের এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী রয়েছে যা রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানো এবং উপকারী কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

ডার্ক চকোলেট প্রচুর ক্যালরি সম্পন্ন একটি খাবার এবং দাম তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় নয়, বরং মাঝেমধ্যে স্ন্যাকস হিসেবে ডার্ক চকোলেট খাওয়া যেতে পারে। 

ডার্ক চকোলেট কেনার সময় প্যাকেটের গায়ে কোকোয়া ও চিনির পরিমাণ দেখে কিনতে হবে। পর্যাপ্ত কোকোয়া সমৃদ্ধ এবং খুব কম চিনি রয়েছে এমন চকোলেট কিনতে হবে।

১২। রসুন 

রসুন থেকে অ্যালিসিন (Allicin) নামক এন্টি-অক্সিডেন্ট পাওয়া যায় যা রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

রান্নার কাজে স্বাদ ও ফ্লেভার বৃদ্ধির জন্য মশলা হিসেবে রসুন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে রান্না ছাড়াও সরাসরি কাঁচা রসুন খাওয়া যেতে পারে।‌ প্রতিদিন এক কোয়া কাঁচা রসুন খেতে পারলে ভালো।

১৩। টফু (Tofu)

টফু হলো সয়াবিন থেকে তৈরি খাবার যা স্বাস্থ্যকর প্রোটিন সরবরাহ করে। প্রোটিনের উৎস হিসেবে টফু খাওয়া একদম নিরাপদ। কারণ টফু কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় না বরং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। 

স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে টফু সারা বিশ্বেই বেশ জনপ্রিয়তার সাথে খাওয়া হয়ে থাকে। বিশেষ করে যারা নিরামিষ আহার করেন (প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার গ্রহণ করেন না) তাদের জন্য আমিষের উৎস হিসেবে টফু দারুন একটি খাবার হতে পারে।  

বিভিন্ন সুপার শপ ও অনলাইন শপ থেকে টফু কিনতে পাওয়া যায়।

যেসব খাবার কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় 

  • সাদা ভাত, বিস্কুট, কেক, পাউরুটি, নুডুলস ও পাস্তা যতটা সম্ভব কম খেতে হবে। 
  • মুরগির চামড়া, গরু ও খাসির মাংস এড়িয়ে চলা উচিত। প্রোটিন হিসেবে ডিম, ডাল, ফ্যাট-ফ্রি দুধ, মটরশুটি, শিমের বিচি, টফু ইত্যাদি খেতে পারেন। 
  • পোড়া তেলে ভাজা খাবার, কোমল পানীয়, চিপস ও ফাস্টফুড বর্জন করতে হবে। 
  • ধুমপান ও মদ্যপান করা যাবে না। 

শেষ কথা

রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা ভালো রাখতে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে। সেই সাথে নিয়মিত ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রম করতে হবে এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। 

রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা খুব বেশি থাকলে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ খেতে হবে এবং ওষুধ সেবনের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে। 

Bibliography

Harvard Health. (2019, August 13). 11 foods that lower cholesterol. Retrieved from Harvard Health: https://www.health.harvard.edu/heart-health/11-foods-that-lower-cholesterol

Jennings, K.-A. (2023, March 10). 13 Cholesterol-Lowering Foods to Add to Your Diet. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/13-foods-that-lower-cholesterol-levels

Last Updated on January 4, 2024