লম্বা সময় টানা না খেয়ে থাকা একটি খাওয়ার ধরণ যেখানে মানুষ তাদের সারাদিনের খাবার দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করে ফেলে। কিছু গবেষণা পরামর্শ দেয় যে, এই নিয়মে খাওয়া ওজন কমানো সহ মস্তিষ্ক ও হার্টের স্বাস্থ্য উন্নত করে। 

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (IF- Intermittent fasting) বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় স্বাস্থ্য এবং ফিটনেস ট্রেন্ড। অনেক গবেষণা বলছে যে, এই ফাস্টিং মানুষের শরীর ও মস্তিষ্কের উপর শক্তিশালী প্রভাব ফেলে, এমনকি আয়ু বাড়াতেও সাহায্য করতে পারে।

অনেকেই ওজন কমাতে, স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে এবং জীবনধারাকে সহজ করতে নিয়মিত ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করছেন। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং কি এবং এটি সঠিকভাবে করার নিয়ম নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়েছে। 

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (IF) কি? 

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (IF) হলো একটি খাওয়ার ধরণ যেখানে উপবাস ও খাওয়ার সময়কাল চক্রাকারে চলে। 

এই ফাস্টিং পদ্ধতি কোন খাবার খাবেন তা নির্দেশ করে না বরং কখন খাবেন তা নির্দেশ করে। সুতরাং, এটি কোনো খাবার নয় বরং খাওয়ার ধরণকে বুঝানো হয়।

এই পদ্ধতিতে প্রতিদিন ১৬ ঘন্টা উপবাস বা প্রতি সপ্তাহে দুইবার ২৪ ঘন্টা করে উপবাস অন্তর্ভুক্ত থাকে।

মানব বিবর্তন জুড়ে উপবাস ছিলো অতি পরিচিত একটি বিষয়। প্রাচীনকালের শিকারি সংগ্রাহকদের জন্য সুপারমার্কেট বা রেফ্রিজারেটর ছিল না। ফলে বছরের কোনো কোনো সময় তাদের না খেয়েও থাকতে হত। কারণ কখনো কখনো তারা খাওয়ার কিছু খুঁজে পেত না।

সারা বিশ্বের মুসলিমরাও বছরে ১ মাস পবিত্র রমজান মাসে রোযা পালন করে থাকে। যে সময়ে তারা সারাদিন না খেয়ে রাতের শেষ এবং শুরুর ভাগে খেয়ে থাকেন। এছাড়াও খ্রিস্টান, ইহুদি ও বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক কারণে প্রায়শই উপবাস করা হয়।

প্রকৃতপক্ষে প্রতিদিন ৩-৪ বার বা তার বেশি খাবার খাওয়ার চেয়ে উপবাস করা উত্তম। 

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (IF) হলো একটি খাওয়ার ধরণ যেখানে উপবাস এবং খাওয়ার সময়কাল চক্রাকারে চলে। এটি বর্তমানে স্বাস্থ্য এবং ফিটনেস সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব জনপ্রিয়।

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর নিয়ম এবং পদ্ধতি 

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং কিংবা বিরতিহীন উপবাস করার বিভিন্ন উপায় আছে – যার সবকটিতেই দিন বা সপ্তাহকে খাওয়ার সময় এবং না খাওয়ার সময় হিসেবে ভাগ করা হয়ে থাকে।

এখানে কয়েকটি জনপ্রিয় নিয়ম এবং পদ্ধতি তুলে ধরা হলঃ (Gunnars, 2022)

১৬/৮ পদ্ধতি 

সহজ করে বললে এই পদ্ধতিতে আপনি ১৬ ঘন্টা না খেয়ে থাকবেন এবং সারাদিনের খাবার ৮ ঘন্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবেন। এই নিয়মে সকালের খাবার বাদ দেওয়া হয়, বাকি ৮ ঘন্টায় মানে দুপুর ১ টা থেকে রাত ৯ টার মধ্যে আপনি সারাদিনের খাবার খাবেন এবং বাকি ১৬ ঘন্টা উপবাস করবেন। 

Eat-Stop-Eat

এটি একটু কঠিন পদ্ধতি। তবে যারা নিয়মিত রোযা রাখেন তাদের জন্য অনেকটাই সহজ। এই নিয়মে আপনি ২৪ ঘন্টা উপবাস করবেন। অর্থাৎ একদিন রাতের খাবার থেকে পরের দিন রাতের খাবার পর্যন্ত না খেয়ে থাকা। সপ্তাহে একবার বা দুইবার এটি মেনে চলতে পারেন। 

৫:২ ডায়েট 

এই পদ্ধতিতে সপ্তাহে ২ দিন মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ ক্যালোরি গ্রহণ করবেন। তবে অন্য ৫ দিন সাধারণ নিয়মেই খাবেন। 

এই পদ্ধতিতে যেহেতু আপনি ক্যালরির পরিমাণ কমিয়ে ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন, খেয়াল রাখতে হবে, যে সময় টুকুতে আপনি খাচ্ছেন, আপনি যেন যথেষ্ট পরিমাণে এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার খান। 

এই পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল ১৬/৮ পদ্ধতি। কেননা এই পদ্ধতিকে অনেকেই সবচেয়ে সহজ, টেকসই এবং লেগে থাকা সহজ বলে মনে করেন। 

এই পদ্ধতি কীভাবে কোষ এবং হরমোনকে প্রভাবিত করে?

লম্বা সময় না খেয়ে থাকলে বা উপবাস করলে, শরীরের কোষ এবং হরমোনজনিত কাজে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। 

  • যেমন আপনার শরীর সঞ্চিত বা জমে থাকা চর্বিকে কাজে লাগাতে হরমোনের মাত্রা সামঞ্জস্য করে।
  • আপনার শরীরের কোষ কাজে লেগে পরে। যেমনঃ গুরুত্বপূর্ণ মেরামত প্রক্রিয়া শুরু করে এবং জিনের অভিব্যক্তি পরিবর্তন করে। 

ফাস্টিং এর ফলে শরীরে কি কি পরিবর্তন ঘটে? 

  • গ্রোথ হরমোন (HGH): ফাস্টিং এর ফলে গ্রোথ হরমোনের মাত্রা প্রায় ৫ গুণ বেশি বৃদ্ধি পায়। আর এই হরমোন চর্বি হ্রাস এবং পেশী বৃদ্ধির কাজে সাহায্য করে। 
  • ইনসুলিন হরমোন: ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা উন্নত হয় এবং ইনসুলিনের মাত্রা কমে যায়। আর কম ইনসুলিনের মাত্রা শরীরের চর্বিকে কাজে লাগাতে সাহায্য করে। 
  • কোষের মেরামত: উপবাস থাকলে আপনার শরীরের কোষগুলো মেরামত প্রক্রিয়া শুরু করে। এর মধ্যে রয়েছে অটোফ্যাজি (autophagy), যেখানে কোষগুলো হজমের কাজ শুরু করে এবং কোষের ভিতরে তৈরি হওয়া পুরানো ও অকার্যকর প্রোটিনগুলোকে সরিয়ে দেয়।
  • জিনের কার্যকারিতার পরিবর্তন: ফাস্টিং এর ফলে জিনের কাজে কিছু পরিবর্তন আসে। যেমন দীর্ঘায়ু এবং রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা সম্পর্কিত কাজ শুরু করে।

ফাস্টিং করলে মানুষের বৃদ্ধি হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায় এবং ইনসুলিনের মাত্রা কমে যায়। শরীরের কোষগুলোর উপকারী কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং জিনের অভিব্যক্তির ভালো পরিবর্তন হয়।

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর উপকারিতা 

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং বা বিরতিহীন উপবাসের উপর অনেক গবেষণা করা হয়েছে।

গবেষণায় দেখা যায় যে, এই ফাস্টিং ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং শরীর ও মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এমনকি এই উপবাস পদ্ধতি আপনাকে আরো বেশি দিন বাঁচতে সাহায্য করতে পারে। 

এখানে বিরতিহীন ফাস্টিং এর প্রধান স্বাস্থ্য উপকারিতা তুলে ধরা হয়েছে। 

১. ওজন কমাতে সাহায্য করে 

ওজন কমানোর জন্য ডায়েট মেইন্টেইন করা অনেকের কাছেই কঠিন মনে হয়। উপরে উল্লিখিত হিসাবে, বিরতিহীন উপবাস ওজন এবং পেটের চর্বি কমাতে সাহায্য করবে। তবে এক্ষেত্রে আপনাকে খাওয়া দাওয়ায় খুব কঠিন ডায়েট মেনে চলতে হবে না বরং খাওয়ার সময়টা মেনে চললেই হবে। 

২. ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স (Insulin resistance)

এই লম্বা সময় না খেয়ে থাকা বা ফাস্টিং রক্তে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স (Insulin resistance) কমাতে পারে যা টাইপ-২ ডায়াবেটিস  থেকে রক্ষা করে।  

৩. প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে

কিছু গবেষণায় দেখা যায়, এই ফাস্টিং এর ফলে প্রদাহ হ্রাস পায় যা অনেক দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল রোগের কারণ। 

৪. হার্ট ভালো রাখে 

বিরতিহীন উপবাস শরীরের খারাপ LDL (Low-density lipoprotein) কোলেস্টেরল, রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড, রক্তে শর্করা এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স (Insulin resistance)  কমাতে পারে যার প্রত্যেকটি হৃদরোগের ঝুঁকির কারণ। 

৫. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে

প্রাণীর উপর গবেষণায় দেখা যায় যে, বিরতিহীন উপবাস ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারে।

৬.মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখে

বিরতিহীন উপবাস মস্তিষ্কের BDNF (Brain-derived neurotrophic factor) হরমোন বৃদ্ধি করে এবং নতুন স্নায়ু কোষের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এটি আলজেইমার্স (Alzheimer’s) রোগ প্রতিরোধ করে।

৭. আয়ু বাড়াতে সাহায্য করে 

বিরতিহীন উপবাস ইঁদুরের আয়ু বাড়াতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে উপবাস করা ইঁদুর ৩৬-৮৩% বেশি বাঁচে। 

মনে রাখবেন যে গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। অনেক গবেষণা ছোট, স্বল্পমেয়াদী বা প্রাণীদের মধ্যে পরিচালিত হয়েছিল। উচ্চ মানের মানব গবেষণায় অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। 

বিরতিহীন উপবাস আপনার শরীর এবং মস্তিষ্কের জন্য অনেক উপকার করতে পারে। এটি ওজন হ্রাস করতে পারে এবং আপনার টাইপ ২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে। এটি আপনাকে আরও বেশি দিন বাঁচতেও সাহায্য করতে পারে।

সতর্কতা 

বিরতিহীন উপবাস অবশ্যই সবার জন্য নয়। 

কিছু কিছু মানুষের জন্য ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এড়িয়ে যেতে হবে। যেমনঃ (Johns Hopkins Medicine, n.d.)

  • ১৮ বছরের কম বয়সী ব্যক্তি
  • গর্ভবতী নারী ও স্তন্যদানকারী মা 
  • যারা গর্ভধারণের চেষ্টা করছেন 
  • যারা রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত 
  • ইটিং ডিজঅর্ডারে (eating disorders) আক্রান্ত রোগী
  • টাইপ-১ ডায়াবেটিসের রোগী
  •  শরীরের ওজন কম 

এইসব ক্ষেত্রে প্রথমে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ না করে আপনার ফাস্টিং শুরু করা উচিত নয়। 

References

Gunnars, K. (2022, June 16). Intermittent Fasting 101 — The Ultimate Beginner’s Guide. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/nutrition/intermittent-fasting-guide

Johns Hopkins Medicine. (n.d.). Intermittent Fasting: What is it, and how does it work? Retrieved from Johns Hopkins Medicine: https://www.hopkinsmedicine.org/health/wellness-and-prevention/intermittent-fasting-what-is-it-and-how-does-it-work

Last Updated on May 2, 2023