শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য ব্যায়াম করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় কারণ ব্যায়ামের মাধ্যমে ক্যালরি বার্ন হয়ে থাকে। আর ক্যালরি হলো খাদ্য থেকে প্রাপ্ত শক্তি যা দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যবহৃত হয় এবং অবশিষ্ট অংশ শরীরে ফ্যাট হিসেবে জমা হতে থাকে যা ওজন বেড়ে যাওয়ার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। ডায়েট কন্ট্রোল করার মাধ্যমে শরীরের চাহিদার তুলনায় কম ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা অথবা ব্যায়ামের মাধ্যমে ক্যালরি বার্ন করে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এই অনুচ্ছেদে ওজন কমানোর ৬ টি কার্যকরী ব্যায়াম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। (Kandola, 2020)

ওজন কমানোর ব্যায়াম

হাটা (Walking)

সবচেয়ে সহজ ও নিরাপদ প্রকৃতির ব্যায়াম হলো হাঁটাহাঁটি করা যা সব বয়সের মানুষের জন্য উপযোগী। সহজ এই ব্যায়ামটি শুরু করার জন্য বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণ অথবা যন্ত্রপাতির দরকার হয় না বরং দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজকর্ম ও চলাফেরার সময় এটি সম্পন্ন করা যেতে পারে। যেমনঃ লিফট ব্যবহার না করে সিড়ি বেয়ে উঠা নামা করা, কাছের কোনো দূরত্বে যাওয়ার জন্য রিকশা বা গাড়িতে না উঠে হেঁটে যাওয়ার অভ্যাস করা ইত্যাদি। এছাড়াও সকাল ও বিকালে পার্কে বা রাস্তায় খানিকটা সময়ের জন্য হাঁটতে বের হওয়া একই সাথে ব্যায়াম হয়ে যাবে আবার প্রকৃতির ছোঁয়াও পাওয়া যাবে।‌

হার্ভার্ড হেলথ এর তথ্য অনুযায়ী ৭০ কেজি ওজনের কোনো ব্যক্তি ঘন্টায় ৬.৪ কিমি গতিতে ৩০ মিনিট হাঁটলে ১৭৫ ক্যালরি বার্ন হবে যা শরীরের ওজন কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বৃদ্ধ মানুষ অথবা যাদের হাঁটুতে সমস্যা রয়েছে এবং অন্যান্য ব্যায়াম করতে পারেন না তাদের জন্য হাটা খুব উপকারী হবে।‌ প্রতিদিন নূন্যতম ৩০ মিনিট সময় ধরে হাঁটার অভ্যাস শুরু করতে হবে এবং ধীরে ধীরে হাটার সময় ও গতি বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।

জগিং এবং দৌড়ানো (Jogging and Running)

জগিং এবং দৌড়ানো প্রায় একই রকমের ব্যায়াম যাদের মধ্যে পার্থক্য শুধু গতিতে।‌ অর্থাৎ জগিং এর চেয়ে দৌড়ানোর ক্ষেত্রে গতি খানিকটা বেশি থাকে। ৭০ কেজি ওজনের ব্যক্তি ঘন্টায় ৮ কিমি গতিতে ৩০ মিনিট জগিং করার ফলে ২৮৮ ক্যালরি বার্ন হয় আর একই ওজনের ব্যক্তি যদি ৯.৭ কিমি গতিতে ৩০ মিনিট দৌড়ায় তবে ৩৬০ ক্যালরি বার্ন হবে যা জগিং এর তুলনায় ৭২ ক্যালরি বেশি বার্ন করে থাকে। এছাড়াও গবেষণায় দেখা গেছে যে, জগিং করা ও দৌড়ানো পেটের চর্বি কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পেটে অতিরিক্ত চর্বি জমে যাওয়া হার্টের রোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

জগিং ও দৌড়ানো শুরু করার জন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। যেমনঃ স্পোর্টস সু (জুতা) ও আরামদায়ক পোশাক পরিধান করতে হবে। খোলা ময়দানে, ফাকা রাস্তায় অথবা পার্কে জগিং করা এবং দৌড়ানো উত্তম।‌ তবে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকলে সেক্ষেত্রে বাসায় অথবা জিমে গিয়ে ট্রেডমিলে (Treadmill) দৌড়ানো যেতে পারে। প্রথমদিকে সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ দিন দৈনিক ২০ থেকে ৩০ মিনিট সময় ধরে এই ধরনের ব্যায়াম করতে হবে। তবে আস্তে আস্তে ব্যায়ামের সময় বাড়াতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন শরীরে পানি স্বল্পতা না‌ হয় অর্থাৎ ব্যায়ামের পরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে।

সাইক্লিং (Cycling)

শরীরের ওজন কমানো ও বডি ফিটনেস ভালো রাখার জন্য সাইক্লিং করা খুব ভালো একটি ব্যায়াম হতে পারে। সাইক্লিং দুইভাবে করা যায়। যথাঃ

  • বাসা বাড়িতে অথবা জিমে গিয়ে স্টেশনারি বাইক (stationary bike) ব্যবহার করে সাইক্লিং করা
  • পার্কে বা রাস্তায় বাইসাইকেল নিয়ে সাইক্লিং করা যা সবচেয়ে ভালো।

হার্ভার্ড হেলথ এর তথ্য অনুযায়ী ৭০ কেজি ওজনের ব্যক্তি মধ্যম গতিতে (ঘন্টায় ১৯ থেকে ২২ কিমি) স্টেশনারি বাইকের সাহায্যে ৩০ মিনিট সাইক্লিং করলে ২৬০ ক্যালরি বার্ন হয়। অপরদিকে একই ওজনের কোনো ব্যক্তি যদি বাইসাইকেল ব্যবহার করে সমান গতিতে ৩০ মিনিট সাইক্লিং করে তবে সেক্ষেত্রে ২৯৮ ক্যালরি বার্ন হবে। বাইসাইকেল চালানোর আরেকটি সুবিধা হলো বাইরের সুন্দর পরিবেশ উপভোগ করা যাবে। তবে স্টেশনারি বাইক ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এক্সিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না বলে এটি সবার জন্য নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

নিয়মিত সাইক্লিং করার মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আরো কিছু উপকারিতা পাওয়া যায়। যেমনঃ হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়, হাঁটুর জয়েন্ট ভালো রাখে এবং শরীরের ভারসাম্য বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও বাইসাইকেল ব্যবহার করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া যায় যার মাধ্যমে একই সাথে গন্তব্যে পৌঁছানো এবং ব্যায়াম করা হয়ে যাবে।

ইন্টারভাল ট্রেইনিং (HIIT)

HIIT এর পূর্ণরূপ হলো High-intensity interval training যা করার নিয়ম হলো খুব দ্রুত গতিতে কিছুক্ষণ করে দৌড়ানো এবং তারপর একটু সময় বিশ্রাম নেওয়া। এই প্রক্রিয়ায় এক দিনে কয়েকবার ব্যায়াম করতে হবে যা অন্যান্য ব্যায়ামের তুলনায় বেশি পরিমাণে ক্যালরি বার্ন করতে সাহায্য করে।‌ গবেষণায় দেখা গেছে যে দৌড়ানো, সাইক্লিং ও ভার উত্তোলন করার চেয়ে ইন্টারভাল ট্রেইনিং করার মাধ্যমে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি ক্যালরি বার্ন হয়ে থাকে।

এছাড়াও ইন্টারভাল ট্রেইনিং করার ফলে পেটের মেদ কমে যায় এবং শরীরের মাংসপেশীগুলো সবল হয়। HIIT ব্যায়াম করার জন্য ট্রেডমিল ব্যবহার করা সবচেয়ে ভালো কারণ এক্ষেত্রে সহজে দৌড়ের গতি বাড়ানো এবং কমানো যায়। তবে বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের হাঁটুতে সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য এই ধরনের ব্যায়াম করা কঠিন হবে।

সাঁতার (Swimming)

নদী, পুকুর বা সুইমিংপুলে সাঁতার কাটা খুব মজাদার একটি ব্যায়াম যা ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং শরীরের গঠন ভালো রাখতে সাহায্য করে। যাদের জয়েন্টে সমস্যা রয়েছে অথবা ভারী প্রকৃতির ব্যায়াম করতে পারেন না তাদের জন্য সাঁতার সুবিধাজনক ব্যায়াম হতে পারে। ৭০ কেজি ওজনের একজন ব্যক্তি ৩০ মিনিট সময় সাঁতার কেটে ২১৬ ক্যালরি বার্ন করতে পারবেন। এছাড়াও ২৪ জন মধ্যবয়সী নারীর উপর ১২ সপ্তাহ ধরে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে, প্রতিদিন ১ ঘন্টা করে সপ্তাহে ৩ দিন সাঁতার কাটার ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পেটের পেট কমে যাওয়া সহ শরীরের ভারসাম্য বৃদ্ধি এবং রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমে গেছে।

সাঁতার কাটার জন্য পূর্ব শর্ত হলো সাঁতার জানা। এছাড়াও নিরাপদে সাঁতার কাটার জন্য উপযুক্ত পোশাক (যেমনঃ সুইম স্যুট, চোখে গগলস, ক্যাপ ইত্যাদি) পরিধান করা উচিত। পানিতে নামার আগে ওয়ার্ম আপ (warm up) করে নিতে হবে এবং শরীরে যেন পানি স্বল্পতা না হয় সেজন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে।

যোগ ব্যায়াম (Yoga)

শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে উপকারী ব্যায়াম হলো যোগ‌ ব্যায়াম যা বর্তমানে অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। হার্ভার্ড হেলথ এর তথ্য অনুযায়ী ৭০ কেজি ওজনের ব্যক্তি ৩০ মিনিট যোগ ব্যায়াম করার ফলে ১৪৪ ক্যালরি বার্ন হবে। এর পাশাপাশি আরো যেসব উপকার পাওয়া যাবে তা‌ হলোঃ

  • শরীরের ভারসাম্য বৃদ্ধি করে
  • মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে
  • রোগ‌‌ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
  • মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ভালো রাখে
  • হার্ট ও ফুসফুস ভালো রাখে
  • ভালো ঘুমের জন্য সহায়ক

বয়স্ক মানুষ সহ আঘাত প্রাপ্ত অথবা হাঁটুতে ব্যথা রয়েছে এমন মানুষ অনায়াসে যোগ ব্যায়াম করতে পারবে। বাড়িতে বসে অথবা যোগ‌ ব্যায়ামের ক্লাসে গিয়ে প্রতিদিন যোগ ব্যায়াম করা যেতে পারে। এতে করে ওজন নিয়ন্ত্রণ সহ শরীর ও মন সুস্থ থাকবে।

ব্যায়ামের মাধ্যমে কত দ্রুত ওজন কমানো যাবে তা কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমনঃ (Raman, 2023)

  • বয়স্কদের শরীরে‌ মাংসপেশীর তুলনায় ফ্যাটের পরিমাণ বেশি থাকে যার ফলে BMR (basal metabolic rate) কম হয়ে থাকে। আর BMR হলো ওজন কমানোর ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক যা কম থাকলে কম পরিমাণে ক্যালরি বার্ন হয় তথা শরীরের ওজন ধীরে ধীরে কমে।‌
  • যার শরীরের ওজন যত বেশি তার BMR তত বেশি আর তাই অনেক বেশি মোটা মানুষ ব্যায়াম শুরু করে দ্রুত ওজন কমাতে পারবেন।
  • পুরুষের তুলনায় মহিলাদের BMR কম হয়ে থাকে আর তাই মহিলাদের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে ওজন কমে।
  • ব্যায়ামের পাশাপাশি কম ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা দ্রুত ওজন কমানোর জন্য অত্যাবশ্যক। বিশেষ করে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার (ফলমূল ও শাকসবজি) বেশি বেশি করে খেতে হবে এবং সরল শর্করা (ভাত, চিনি, মিষ্টি, কোমল পানীয় ইত্যাদি) যতটা সম্ভব কম পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে।
  • শরীরের ওজন কমানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম জরুরী।‌
  • ডিপ্রেশন ও থাইরয়েডের রোগীদের ক্ষেত্রে সহজে ওজন কমতে চায় না। এক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

 

References

Kandola, A. (2020, July 06). What are the best exercises for weight loss? Retrieved from medical news today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/best-exercise-for-weight-loss
Raman, R. (2023, February 23). The 8 Best Exercises for Weight Loss. Retrieved from healthline:
https://www.healthline.com/nutrition/best-exercise-for-weight-loss#weight-loss

Last Updated on April 12, 2023