হার্ট ব্লক (Heart Attack) হয়ে হঠাৎ মৃত্যুবরণ করা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে কমন ঘটনা যার অন্যতম প্রধান কারণ হলো হার্ট ব্লক‌। এটি এমন একধরনের রোগ যার শুরুর দিকে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না কিন্তু ক্রমাগত হার্টের ক্ষতি হতে থাকে এবং একসময়ে হার্ট অ্যাটাকের সৃষ্টি হয়। হার্টে ব্লক হয়ে যাওয়া জনিত মৃত্যু বরণ বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি হারে হতে দেখা যায়। 

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে যে মহিলাদের ক্ষেত্রে অধিক হারে হার্ট ব্লক কেন হয়? এই অনুচ্ছেদে হার্ট ব্লকের কারণ, কেন মহিলাদের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকি রয়েছে, কি কি লক্ষণ দেখা দিলে হার্ট ব্লক হয়েছে বিবেচনায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং হার্ট ব্লক হলে তার জন্য কি ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত সেই সমস্ত বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে, হার্ট ব্লক প্রতিরোধে গবেষণালব্ধ কার্যকরী কিছু টিপস।

হার্ট ব্লক (Coronary Artery Disease) কি? 

শরীরের প্রত্যেকটি কোষে রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন ও পুষ্টি উপাদান পৌঁছে দেওয়ার জন্য অসংখ্য রক্তনালী (Blood vessels) রয়েছে। রক্ত‌ সঞ্চলন প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে হৃদপিন্ড যা ক্রমাগত সংকোচন প্রসারণের মাধ্যমে সারা শরীরে রক্ত প্রবাহ করে থাকে। হৃদপিন্ডের কোষে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহের জন্য রক্তনালী রয়েছে যাদেরকে করোনারি আর্টারি (Coronary Artery) বলা হয়।

হৃদপিন্ডের রক্তনালী সংকুচিত (narrow) হয়ে গেলে অথবা রক্তনালীতে কোলেস্টেরল (Cholesterol) জমে রক্ত চলাচলে বাঁধার সৃষ্টি হলে তাকে হার্ট ব্লক বলা হয়ে থাকে। করোনারি আর্টারিতে সংকোচন বা কোলেস্টেরল জমে এই সমস্যার সৃষ্টি হয় বলে মেডিকেলের ভাষায় এটিকে Coronary Artery Disease বলা হয়।

হার্ট ব্লক কত ধরনের হয়ে থাকে?

মানুষের হৃদপিন্ডে চারটি প্রধান রক্তনালী এবং এর সাথে সংযুক্ত আরো কিছু ছোট ছোট রক্তনালী (Tiny Blood vessels) রয়েছে। কোন ধরনের রক্তনালীতে ব্লক হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে হার্ট ব্লকের তিনটি শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। যেমনঃ

Obstructive coronary artery disease: প্রধান রক্তনালীর ৫০ শতাংশ বা তার বেশি অংশ জুড়ে Plaque তথা চর্বি, ক্যালসিয়াম, কোলেস্টেরল ইত্যাদি জমে গিয়ে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় যাকে atherosclerosis ও বলা হয়ে থাকে।

Nonobstructive coronary artery disease: এই ক্ষেত্রে প্রধান রক্তনালী হঠাৎ করে সংকুচিত (spasm) হয়ে রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে। তবে ঠিক কি কারণে রক্তনালী হঠাৎ করে সংকুচিত হয় তা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়।

Coronary microvascular disease: এই ধরনের ব্লক‌ হয়ে থাকে প্রধান রক্তনালীর বাইরে অর্থাৎ ছোট ছোট রক্তনালী গুলোতে যা Plaque জমার দরুন অথবা Spasm এর ফলে হয়ে থাকে।

হার্ট ব্লক এর কারণ গুলো কি কি?

  • অলস জীবন যাপন
  • পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব
  • মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা
  • ধুমপান করা (Smoking)
  • অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বিশেষত সরল শর্করা (Refined carbohydrates), স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাট গ্রহণ
  • রাত জেগে কাজ করা বা সপ্তাহে ৫৫ ঘন্টার বেশি কর্মদিবস পালন
  • দীর্ঘ সময় ধরে বসে কাজ করা
  • অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা

কোন ধরনের খাবারে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাট রয়েছে তা জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

হার্ট ব্লক এর রিস্ক ফেক্টর গুলো কি কি?

হার্ট ব্লক এর রিস্ক ফেক্টর গুলো কি কি

বয়স, লিঙ্গ ও কতিপয় রোগীর ক্ষেত্রে হার্ট ব্লক হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে যাকে হার্ট ব্লকের রিস্ক ফ্যাক্টর (Risk factors) নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। যেমনঃ

  • ৪৫ বছরের বেশি বয়স
  • হার্ট ব্লকের পারিবারিক ইতিহাস
  • উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension)
  • ডায়াবেটিস (Diabetes)
  • রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL- low density lipoprotein) এর পরিমাণ বেশি কিন্তু উপকারী কোলেস্টেরল (HDL- High density lipoprotein) এর পরিমাণ কম থাকা
  • মানসিক রোগ (Anxiety, Depression, এবং PTSD- posttraumatic stress disorder)

মহিলাদের ক্ষেত্রে হার্ট ব্লক হওয়ার অতিরিক্ত ঝুঁকি কেন থাকে?

সাধারণভাবে মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের ক্ষেত্রে হার্ট ব্লক হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ (NIH of US) এর তথ্য অনুযায়ী কিছু বিশেষ কারণে মহিলাদের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং হার্ট ব্লক জনিত জটিলতা তথা মৃত্যুহার বেশি হয়ে থাকে। (National Institute of Health, n.d.)

প্রথমত মহিলাদের ক্ষেত্রে বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ ৪৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে মহিলাদের মেনোপজ (Menopause) হয়ে থাকে। আর মেনোপজের ফলে শরীরে হরমোনের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে।‌

বিশেষত মেনোপজের পরে মহিলাদের শরীরে ইস্ট্রোজেন (estrogen) হরমোন নিঃসরণের পরিমাণ কমে যায় আর এর সাথে সাথে হার্ট ব্লকের সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। তবে মেনোপজের আগেও কিছু বিষয় বা রোগের কারণে মহিলাদের ক্ষেত্রে হার্ট ব্লকের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। যেমনঃ

  • জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওষুধ সেবন
  • রক্তস্বল্পতা (Anemia)
  • গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational diabetes)
  • প্রি-এক্লাম্পসিয়া (Preeclampsia)
  • জরায়ুর রোগ (Endometriosis)
  • ওভারিয়ান সিস্ট (PCOS- polycystic ovary syndrome)

মহিলাদের ক্ষেত্রে হার্ট ব্লক জনিত জটিলতা বা মৃত্যুহার বেশি হওয়ার প্রধান কারণ হলো Nonobstructive coronary artery disease এবং Coronary microvascular disease । মহিলাদের ক্ষেত্রে এই দুই ধরনের হার্ট ব্লক হয়ে থাকে যা সহজে নির্ণয় করা যায় না। আর হার্ট ব্লক নির্ণয় করতে সক্ষম না হলে রোগীর অজ্ঞাতসারে হার্ট ব্লক বাড়তে থাকে এবং একসময়ে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের সৃষ্টি করে। এছাড়াও দৈহিক গঠনের তারতম্য অনুযায়ী মহিলাদের হার্টের পেশী তুলনামূলক কম শক্তিশালী হয়ে থাকে যা হার্টের রোগের জটিলতা বৃদ্ধি করে।

হার্ট ব্লক এর লক্ষণ (Symptoms of heart block)

হার্ট ব্লক এর লক্ষণ

সাধারণত হার্টের রক্তনালীতে ধীরে ধীরে ব্লক হতে থাকে এবং সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ব্লক হয়ে গেলেও তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে অল্প পরিশ্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়া, ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাস এবং কখনো কখনো বুকে মৃদু প্রকৃতির ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এমতাবস্থায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে হার্টের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়া উচিত।

Anjina কি? (৪০৭০ শতাংশ হার্ট ব্লক)

রক্তনালীর ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্লক হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে হৃদপিন্ডের কোষে পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত সরবরাহের ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটে। এমতাবস্থায় সেই কোষ গুলোতে অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না এবং প্রচন্ড বুকে ব্যথার সৃষ্টি হয় যাকে মেডিকেলের ভাষায় Anjina বলা হয়ে থাকে।

Anjina এর লক্ষণ

Anjina এর ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা ছাড়াও আরো যে সমস্ত লক্ষণাবলী দেখা যেতে পারে তা হলো-

  • বুকে চাপ বোধ
  • শ্বাসকষ্ট
  • দুর্বলতা
  • ঘেমে যাওয়া
  • বুকজ্বালা
  • বমি বমি ভাব (Nausea) ইত্যাদি

হার্ট অ্যাটাক (Heart attack) কি?

(৭০ শতাংশের বেশি হার্ট ব্লক)

রক্তনালীর ৭০ শতাংশের বেশি ব্লক হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে রক্ত প্রবাহে প্রতিনিয়ত বাঁধার সৃষ্টি হয়ে থাকে আর যার ফলে একসময় রক্তনালীর মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। হৃদপিন্ডের কোষে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে কোষগুলো মরে যেতে থাকে। আর এই অবস্থাকেই হার্ট অ্যাটাক (Heart attack) বলা হয়।

এছাড়াও অনেক সময় রোগীর অজ্ঞাতসারে অথবা অসচেতনতার দরুন রক্তনালী সম্পূর্ণভাবে ব্লক হয়ে গিয়ে হৃদপিন্ডের কোষে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় তথা হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে। হার্ট অ্যাটাক একটি জরুরি অবস্থা যেখানে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হয়।

হার্ট অ্যাটাক (Heart attack) এর লক্ষণ

নিম্নলিখিত লক্ষণ সমূহ দেখা দিলে বুঝতে হবে যে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।

  • হঠাৎ করে প্রচন্ড বুকে ব্যথা এবং ব্যথা গলা, ঘাড়, চোয়াল, পেটে ও পিঠে ছড়িয়ে পড়তে থাকে
  • অস্বস্তি বোধ ও অস্থিরতা
  • দম বন্ধ হয়ে আসা
  • বমি বমি ভাব ও বমি হওয়া
  • ঘেমে যাওয়া ইত্যাদি

হার্টে ব্লক আছে কিনা তা কিভাবে ডায়াগনোসিস করা হয়?

হার্টে ব্লক আছে কিনা তা কিভাবে ডায়াগনোসিস করা হয়

কতিপয় পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে হার্টে ব্লক হয়েছে কিনা এবং কত শতাংশ পর্যন্ত ব্লক হয়েছে তা সহ হার্টের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যায়। এক্ষেত্রে সাধারণত নিম্নলিখিত পরীক্ষা গুলো করানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। যেমনঃ

ইসিজি (ECG- Electrocardiogram): হার্টের জন্য এই পরীক্ষাটি সবচেয়ে কমন যার মাধ্যমে হার্টের অবস্থা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। সাধারণত ইসিজি রিপোর্টে অস্বাভাবিকতা দেখা গেলে পরবর্তীতে আরো কিছু পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন হয়ে থাকে।

ইকোকার্ডিওগ্রাম (Echocardiogram): এটি মূলত হার্টের আল্ট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষা যার‌ মাধ্যমে হার্টের গঠন, ক্রমাগত সংকোচন প্রসারণ, রক্ত পাম্প করা ইত্যাদি বিষয়গুলো লক্ষ্য করা যায়। ইকোকার্ডিওগ্রামের মাধ্যমে হার্ট ব্লক নির্ণয় করা যায় না তবুও হার্ট ব্লকের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষাটি করানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। কারণ সকল ক্ষেত্রেই হার্টে কোনো গঠনগত অস্বাভাবিকতা রয়েছে কিনা তা জেনে নেওয়া জরুরি।

ইটিটি (ETT- exercise tolerance test): এটি হার্ট ব্লক নির্ণয়ের প্রাথমিক পর্যায়ের একটি পরীক্ষা যার মাধ্যমে হার্টে ব্লক রয়েছে কিনা সেই বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। যদি হার্টে ব্লক থাকে তাহলে তা কতটুকু অংশ জুড়ে তা নির্ণয় করতে এনজিওগ্রাম (Angiogram) করাতে হয়।

এনজিওগ্রাম: অনেকেই এই পরীক্ষাটির নাম শুনলেই ভয় পেয়ে যান। বস্তুত এটি কোনো জটিল পরীক্ষা নয় এবং কোনো প্রকারের ব্যথা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই পরীক্ষার মাধ্যমে একদম সুস্পষ্টভাবে হার্টের ব্লক নির্ণয় করা যায়। আর এ রোগে সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্ব শর্ত হলো যথাযথ ভাবে হার্টের ব্লক নির্ণয় করা।

লিপিড প্রোফাইল (Lipid profile): হার্ট ব্লকের চিকিৎসা ও প্রতিরোধের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা যার মাধ্যমে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা সম্পর্কে জানা যায়। আর কোলেস্টেরলের পরিমাণের সাথে হার্ট ব্লকের বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে বিশেষত LDL (low density lipoprotein) যাকে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

উল্লেখ্য লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষাটি খাবার গ্রহণের ১২ ঘন্টা পরে করানো হলে সবচেয়ে নির্ভুল ফলাফল পাওয়া যায়। আর তাই রাতে খাবার গ্রহণ করে পরেরদিন সকালে কিছু না খেয়ে খালিপেটে এই পরীক্ষাটি করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।

হার্ট ব্লক এর চিকিৎসা কি?

হার্টের ব্লকের ধরন‌ এবং রক্তনালীর কতটুকু অংশে ব্লক হয়েছে তা সহ রোগীর শরীরের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় হার্ট ব্লকের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। যেমনঃ

রক্তনালীর বেশিরভাগ অংশজুড়ে ব্লক থাকলে সেক্ষেত্রে সাধারণত হার্টে রিং পরানো (angioplasty) অথবা বাইপাস সার্জারির (coronary bypass surgery) নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। এই দুইটি চিকিৎসা পদ্ধতি শল্যচিকিৎসার (Surgery) অন্তর্ভুক্ত যা ‌হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ শল্যচিকিৎসকগণ (Cardiovascular surgeon) প্রদান করে থাকেন।

রিং পরানো: হার্ট ব্লক হলে রক্তনালীর‌ গায়ে চর্বি বা কোলেস্টেরল জমে রক্ত চলাচলের পথ সরু হয়ে যায়। এক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতির এই চিকিৎসার মাধ্যমে হার্টের রক্তনালীতে একধরনের রিং (stent) পরানো হয়ে থাকে যা চর্বি ও কোলেস্টেরলকে চেপে রাখে এবং রক্ত চলাচলের পথ সুগম করে দেয়। এটি একটি নিরাপদ ও‌ কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থা যার মাধ্যমে হার্ট ব্লক জনিত হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়।

বাইপাস সার্জারি: বাইপাস শব্দটি হয়তো অনেকেই শুনেছেন যা দ্বারা বোঝানো হয় কোনো একটি রাস্তার অংশবিশেষ পারি দিতে অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে এসে পুনরায় সেই রাস্তায় মিলিত হওয়া। যানজটপূর্ণ শহরে বসবাসের সুবাদে বাইপাস সড়ক ব্যবহারের বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের ধারণা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। হার্টের বাইপাস সার্জারির মুল বিষয়টি সড়ক বাইপাসের মতোই আর তাই বোঝার সুবিধার্থে এই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।‌

হার্ট ব্লকের চিকিৎসার ক্ষেত্রে রক্তনালীর যে অংশে ব্লক হয়ে গেছে সেই অংশটি অতিক্রম করতে একটি বাইপাস নালী তৈরি করা হয়। শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে শরীরের অন্য কোনো অংশ থেকে রক্তনালী নিয়ে তা হার্টের সেই বিশেষ অংশে জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে বাইপাস সার্জারি সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। এটি তুলনামূলক জটিল প্রকৃতির একটি শল্যচিকিৎসা তবে নিরাপদ এবং সফলতার সম্ভাবনা অনেক বেশি। (Higuera, 2020)

বিনা অপারেশনে হার্ট ব্লকের চিকিৎসা

আমাদের দেশে বিভিন্ন যায়গায় চটকদার বিজ্ঞাপন দেখতে পাওয়া যায় যে বিনা অপারেশনে হার্টের ব্লক দূর করা হয়। প্রকৃতপক্ষে বিনা অপারেশনে হার্টের ব্লক দূর করা যায় না। তবে বিনা অপারেশনে হার্ট ব্লকের চিকিৎসা রয়েছে। চলুন সেই বিষয়ে একটু বিস্তারিত জেনে আসা যাক।

প্রথমত যাদের ক্ষেত্রে রক্তনালীতে ব্লকের পরিমাণ কম অথবা রোগ নির্ণয় ও রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসক যদি নিরাপদ মনে করেন তবে শল্যচিকিৎসা ব্যতীত ওষুধ সেবন এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপনের মাধ্যমে হার্ট ব্লক নিয়ে সুস্থ থাকা যায়। হার্টের ব্লকের চিকিৎসায় সাধারণত যে সমস্ত ওষুধ গুলো নির্দেশিত হয়ে থাকে তা নিচে উল্লেখ করা হলোঃ

  • Beta-blockers
  • Nitroglycerin patches
  • Angiotensin-converting enzyme inhibitors
  • Statins ইত্যাদি

উল্লেখ্য সকল অবস্থায় একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের (Cardiologist) পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। ওষুধ সেবনের পাশাপাশি অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন এবং স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

হার্টের রোগীদের জন্য সরল শর্করা, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্র্যান্স ফ্যাট, অতিরিক্ত সোডিয়াম রয়েছে এমন খাবার বর্জন করা জরুরি। সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

এর বাইরেও আরো কিছু চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে যা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে চালু হয়েছে। যেমনঃ ECP– External counterpulsation, ESMRExtracorporeal Shockwave Myocardial Revascularization থেরাপি। এই চিকিৎসা পদ্ধতি গুলো সেই সমস্ত রোগীদের জন্য নির্দেশিত হয়ে থাকে যাদের ক্ষেত্রে রক্তনালীতে অনেক বেশি ব্লক থাকা সত্ত্বেও শল্যচিকিৎসা (Angioplasty, Coronary bypass surgery) করা সম্ভব হয় না।

যেমনঃ কিডনি ফেইলিউর এর রোগী, বেশি বয়স্ক মানুষ, শারীরিক ভাবে প্রচন্ড দুর্বল, অথবা অন্য যে কোনো ধরনের জটিল রোগ যার ফলে শল্যচিকিৎসা করা হলে বিপদজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে।

ECP এবং ESMR চিকিৎসা পদ্ধতি দুইটি আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত ও হার্ট ব্লক চিকিৎসায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তবে তা রক্তনালীর ব্লক দূর করে না‌, বরং বিশেষ একধরনের তরঙ্গ প্রেরণের মাধ্যমে হৃদপিন্ডে রক্ত প্রবাহের পথ (কৈশিক জালিকা প্রকৃতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্ত নালী) তৈরি করে থাকে। আর তাই এটিকে বিনা অপারেশনে ব্লক দূর করা বলা সমীচিন হবে না। বরং বলতে হবে হার্ট ব্লকের বিকল্প ধারার চিকিৎসা। (The American Journal of Cardiology, 2021)

আর তাছাড়া রাস্তার পাশের চটকদার বিজ্ঞাপন গুলোতে এই‌ চিকিৎসা (ECP, ESMR) পদ্ধতি গুলোকেও নির্দেশ করে না। বিভিন্ন কবিরাজি, হেকিমি, হারবাল ইত্যাদি চিকিৎসা পন্থা অবলম্বনকারী ব্যক্তিবর্গ এমন বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও কার্যকারিতা নেই।

উল্লেখ্য হার্টে পেসমেকার (Pacemaker) বসানো হার্টের রোগের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী চিকিৎসা। তবে জেনে রাখা ভালো যে সাধারণত হার্ট ব্লকের চিকিৎসায় হার্টে পেসমেকার বসানো হয় না। বরং যাদের ক্ষেত্রে হার্টের নিয়মিত সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে রক্ত পাম্প কার্যক্রমে সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য এটি প্রযোজ্য। পেসমেকার কৃত্রিমভাবে হার্টকে বিশেষ উদ্দীপনা দেয় যা হার্টের সংকোচন প্রসারণ কার্যক্রমকে স্বাভাবিক রাখতে বিশেষ সহায়তা করে থাকে।

হার্ট ব্লক হলে কি কি জটিলতা হতে পারে?

হার্ট ব্লকের প্রধান জটিলতা হলো হার্ট অ্যাটাক যা একটি প্রাণঘাতী ব্যাধি। হার্টে ব্লক রয়েছে এমন রোগীদের ক্ষেত্রে প্রায়ই হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা ঘটতে পারে। আর হার্ট অ্যাটাক অনেক সময় অকাল মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এছাড়াও আরো যে সমস্ত জটিলতা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মাঝে মধ্যেই বুকে প্রচণ্ড ব্যথা হওয়া, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন (arrhythmia) ইত্যাদি।

হার্ট ব্লক প্রতিরোধের উপায় 

হার্ট ব্লক প্রতিরোধের উপায় 

হার্ট ব্লক একটি গুরুতর সমস্যা যার চিকিৎসা পদ্ধতি বেশ জটিল। আর তাই উত্তম হলো কিভাবে হার্ট ব্লক প্রতিরোধ করা যায় তা জেনে সেই মোতাবেক জীবন যাপন করা। হার্ট ব্লক প্রতিরোধে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের গবেষণায় প্রাপ্ত কিছু টিপস নিচে তুলে ধরা হলোঃ (Johns Hopkins Medicine, n.d.)

  • হার্ট ব্লক এবং হার্ট অ্যাটাকের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো ধুমপান। আর তাই ধুমপানের অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে
  • হার্টের জন্য ক্ষতিকর এমন খাবার গুলো বর্জন করতে হবে। যেমনঃ সরল শর্করা, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্র্যান্স ফ্যাট ইত্যাদি
  • শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে। এক্ষেত্রে উত্তম হলো BMI (Body Mass Index) অনুযায়ী শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
  • অহেতুক মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে
  • নিয়মিত রক্তচাপ মেপে দেখা উচিত এবং রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে

হার্ট ব্লক একটি জটিল ব্যাধি তবে প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্রই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে চিকিৎসা ব্যতীত নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপনের মাধ্যমেই সুস্থ থাকা যায়। আর চিকিৎসার প্রয়োজন হলে সেক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই সাথে সুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হার্ট ব্লক প্রতিরোধের জন্য উপরের টিপসগুলো মেনে চলা উচিত।

 

References

Higuera, V. (2020, June 23). What Is Coronary Artery Disease? Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/coronary-artery-disease#treatment

Johns Hopkins Medicine. (n.d.). Coronary Artery Disease: Prevention, Treatment and Research. Retrieved from Johns Hopkins Medicine: https://www.hopkinsmedicine.org/health/conditions-and-diseases/coronary-artery-disease-prevention-treatment-and-research

National Institute of Health. (n.d.). Coronary Heart Disease. Retrieved from National Heart, Lung, and Blood Institute (NHLBI): https://www.nhlbi.nih.gov/health-topics/coronary-heart-disease

The American Journal of Cardiology. (2021, Apr 1). Effectiveness and Safety of Extracorporeal Shockwave Myocardial Revascularization in Patients With Refractory Angina Pectoris and Heart Failure. Retrieved from PubMed: https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/33385348/

Last Updated on April 13, 2023