যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ (NIH of US) এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী মহিলাদের ক্ষেত্রে জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার তালিকায় চতুর্থ প্রধান কারণ হলো (Cervical cancer) যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। (Haque, 2017) তবে আশার কথা হলো এই যে জরায়ু ক্যান্সার খুবই ধীর গতিতে বিস্তার লাভ করে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে যথাযথ চিকিৎসায় প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি রোগীর ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া যায়। (Sachdev, 2021) 

এই অনুচ্ছেদে জরায়ু ক্যান্সারের কারণ, লক্ষণ সমূহ ও চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে যা আপনাকে জরায়ু ক্যান্সার সম্পর্কে জানতে এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। এছাড়াও Cervical cancer প্রতিরোধে করণীয় বিষয়াবলী সহ গর্ভকালীন সময়ে জরায়ু ক্যান্সার ধরা পড়লে কি করা উচিত সেই বিষয়ে এই অনুচ্ছেদের শেষের দিকে আলোকপাত করা হয়েছে।

Table of Contents

জরায়ু ক্যান্সার কি? (What is cervical cancer?)

চলুন জরায়ু ক্যান্সার সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে জরায়ু সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানা যাক। জরায়ু (Uterus) মহিলাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা তলপেটে অবস্থান করে। জরায়ুর প্রধান কাজ হলো গর্ভকালীন সময়ে ভ্রূণের (Fetus) সংরক্ষণ এবং বৃদ্ধিতে সহায়তা করা। জরায়ু উল্টানো নাশপাতি আকৃতির (Inverted Pear) মত একটি অঙ্গ যার তিনটি প্রধান অংশ রয়েছে। যেমন:

  • Fundus: সবচেয়ে উপরের অংশ
  • Body: জরায়ুর প্রধান অংশ এবং এই অংশে জরায়ু গহ্বর অন্তর্ভুক্ত
  • Cervix: জরায়ুর নিচের সরু অংশ যাকে জরায়ু মুখ বলা হয়ে থাকে

জরায়ুর যে অংশে সবচেয়ে বেশি ক্যান্সার সংক্রমণ হয়ে থাকে তা হলো জরায়ু মুখ (Cervix) যাকে মেডিকেলের ভাষায় সার্ভিকাল ক্যান্সার (Cervical cancer) বলা হয়। তবে যেহেতু জরায়ু মুখ জরায়ুরই একটি অংশ তাই সাধারণ মানুষ সার্ভিকাল ক্যান্সারকেই জরায়ু ক্যান্সার নামে চিনে থাকেন। আর তাই এই অনুচ্ছেদে জরায়ু ক্যান্সার বলতে জরায়ু মুখের ক্যান্সার বা সার্ভিকাল ক্যান্সারকে বোঝানো হয়েছে। 

জরায়ুর ক্যান্সার এর কারণ গুলো কি কি? (What are the causes of cervical cancer?)

What are the causes of cervical cancer

cervical cancer

জরায়ু ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ হলো HPV (Human Papillomavirus) এর সংক্রমণ। HPV ভাইরাসের সংক্রমণ নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই হতে পারে অর্থাৎ, নারী থেকে পুরুষ এবং পুরুষ থেকে নারীতে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। তবে HPV এর সংক্রমণ হলেই তা জরায়ুর ক্যান্সার বলে বিবেচিত নয় কারণ HPV এর অনেক গুলো প্রকরণ রয়েছে যার মধ্যে মাত্র দুইটি প্রকরণ (HPV-16 & HPV-18) জরায়ু ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। HPV এর সংক্রমণের সাথে সাথে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব এবং অন্যান্য আরো কিছু বিষয় (Risks factors) রয়েছে যা জরায়ু ক্যান্সারের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। যেমন:

  • ১৬ বছরের কম বয়সে বিয়ে তথা যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা
  • বংশগত জরায়ু ক্যান্সারের ইতিহাস
  • একাধিক যৌন সঙ্গিনী থাকা
  • অতিরিক্ত ওজন (Obesity)
  • ধুমপানের অভ্যাস (Smoking)
  • যৌন রোগে (STD for Sexually transmitted diseases) আক্রান্ত ব্যক্তি
  • দীর্ঘদিন ধরে (৫ বছরের বেশি সময়) জন্মনিরোধক বড়ি খাওয়া
  • স্বাস্থ্যবিধি (Hygiene) পালনে উদাসীনতা

সাধারণত HPV সংক্রমিত ব্যক্তির সাথে যৌন সঙ্গম (Sexual intercourse) করার মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। তবে সংক্রমণের ফলে উদ্ভূত সমস্যা বা উপসর্গ দেখা দিতে ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক মাস থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। এই ভাইরাসের সংক্রমণে Cervical cancer ছাড়াও আরো যে সমস্ত রোগ হতে পারে তা হলো যৌনাঙ্গে আঁচিল, পায়ুপথের ক্যান্সার ইত্যাদি। (Sachdev, 2021)

জরায়ু ক্যান্সারের প্রকারভেদ ও পর্যায় (Types and Stages of Cervical cancer)

সংক্রমণের স্থানের উপর ভিত্তি করে জরায়ু ক্যান্সার বা সার্ভিকাল ক্যান্সার তিন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন:

  1. Squamous cell carcinoma: জরায়ু মুখের একদম উপরিভাগের আস্তরণে (Lining of cervix) এই ধরনের ক্যান্সারের সংক্রমণ হয়ে থাকে যা প্রায় ৯০ শতাংশ জরায়ু ক্যান্সারের রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়।
  2. Adenocarcinoma: জরায়ু মুখের ভেতরের স্তরের টিস্যু (Glandular tissue) যা মিউকাস (Mucus) উৎপাদন করে সেই অংশে ক্যান্সারের সংক্রমণ হলে তাকে Adenocarcinoma বলা হয়। খুবই কম সংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রে এই ধরনের ক্যান্সার হতে দেখা যায়।
  3. Mixed carcinoma: উপরোক্ত দুই ধরনের টিস্যুতে একইসাথে ক্যান্সারের সংক্রমণ হলে তাকে Mixed carcinoma বলা হয় যা খুবই বিরল প্রকৃতির।

জরায়ু ক্যান্সারের পর্যায় (Stages of cancer) সমূহ সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। কারণ পর্যায়ের উপর ভিত্তি করে কি ধরনের জটিলতা হতে পারে এবং কোন পদ্ধতির চিকিৎসা কার্যকরী ভূমিকা রাখবে সে বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। জরায়ু ক্যান্সারের ৪ টি পর্যায় রয়েছে যা নিচে উল্লেখ করা হলো।

  • পর্যায় ১ (Stage 1): এই পর্যায়ে জরায়ু মুখের খুব সামান্য অংশ জুড়ে ক্যান্সারের সংক্রমণ হয়ে থাকে যার সাথে সাধারণত কোনো লিম্ফ নোডের সংযুক্ততা থাকে না।
  • পর্যায় ২ (Stage 2): এই পর্যায়ে এসে ক্যান্সার লিম্ফ নোডের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
  • পর্যায় ৩ (Stage 3): এই‌ পর্যায়ে ক্যান্সার জরায়ুর সম্পূর্ণ অংশ সহ যৌনাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।
  • পর্যায় ৪ (Stage 4): এটি ক্যান্সারের সর্বশেষ পর্যায়। এই পর্যায়ে ক্যান্সার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

জরায়ু মুখের ক্যান্সার (Cervical cancer) আর জরায়ুর ক্যান্সার (Uterine cancer) কি একই?

না, একই রকম না। বরং এই দুই ধরনের ক্যান্সারের সংক্রমণের স্থান,‌ কারণ, লক্ষণ সহ সব বিষয়ে ভিন্নতা রয়েছে। জরায়ুর (Uterus) প্রধান অংশে (Body) ক্যান্সারের সংক্রমণ হলে প্রকৃতপক্ষে তাকে জরায়ুর ক্যান্সার বা Uterine Cancer নামে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে সার্ভিকাল ক্যান্সার (Cervical cancer)  জরায়ুর মুখে বা জরায়ুর নিচের দিকে সরু অংশে হয়ে থাকে কিন্তু এই ক্যান্সারটিকেও বাংলায় প্রায়ই জরায়ুর ক্যান্সারই বলা হয়ে থাকে।  Uterine Cancer সংক্রমণ তুলনামূলক কম হারে হতে দেখা যায় এবং সাধারণত তা বেশি বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। এই অনুচ্ছেদে জরায়ু ক্যান্সার বলতে Cervical cancer কে বোঝানো হয়েছে যা প্রকৃত জরায়ু ক্যান্সার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রকৃত জরায়ু ক্যান্সারের (Uterine cancer) বিশেষত্ব যা এটিকে সার্ভিকাল ক্যান্সার (Cervical cancer) থেকে আলাদা করেছে তা হলো:

  • এই‌ ক্যান্সার হওয়ার পেছনে HPV অণুজীবের কোনো ভূমিকা নেই
  • লক্ষণ সমূহ যেমন ঘন ঘন মাসিক হয় এবং প্রচুর পরিমাণে রক্তপাত দেখা যায়
  • চিকিৎসায় সফলতার সম্ভাবনা কম
  • প্রতিরোধের জন্য তেমন কোনো কার্যকরী উপায় নেই

জরায়ুর ক্যান্সার এর লক্ষণ কি কি? (What are the symptoms of cervical cancer?)

জরায়ু ক্যান্সারের একদম প্রারম্ভিক পর্যায়ে (Early stages) তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে পরবর্তীতে যে সমস্ত লক্ষণ সমূহ দেখা যায় তা নিচে উল্লেখ করা হলো:

  • দুই মাসিকের মধ্যবর্তী সময়ে অস্বাভাবিক রক্তপাত (Bleeding)
  • মাসিক একদম বন্ধ (Menopause) হয়ে যাওয়ার পরেও রক্তপাত
  • যৌন মিলনের সময় ব্যথা বোধ
  • যৌন মিলনের পরে রক্তপাত হয়
  • দুর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব (Discharge)
  • সাদা স্রাবের সঙ্গে অস্বাভাবিক ভাবে রক্ত যাওয়া
  • তলপেটে ব্যথা অনুভূত হওয়া

উপরোক্ত লক্ষণ সমূহ দেখা দেওয়া মাত্রই

cervical cancer

হয়েছে এমনটি ভেবে আতংকিত হওয়া যাবে না। কারণ জরায়ু ক্যান্সার ছাড়াও আরো অন্যান্য রোগ যেমন ফাংগাল ইনফেকশন, UTI (Urinary Tract Infections), থাইরয়েডের সমস্যা, হরমোনের পরিবর্তন ইত্যাদির ফলে এই সমস্ত লক্ষণাবলী দেখা দিতে পারে। তবে লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের (Gynecologist) শরণাপন্ন হতে হবে যেনো প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে জরায়ু ক্যান্সার হয়েছে কিনা।

কিভাবে জরায়ু ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়? (How to diagnose of cervical cancer in Bengali?)

কিভাবে জরায়ু ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়

How to diagnose of cervical cancer

জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্পর্কে জানার পূর্বে কিভাবে জরায়ু ক্যান্সার নির্ণয় করা (Diagnosis) হয় সে বিষয়ে জানা জরুরি। কেননা চিকিৎসার পূর্ব শর্ত হলো যথাযথ ভাবে রোগ নির্ণয় করা যা সঠিক পদ্ধতির চিকিৎসা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। জরায়ু ক্যান্সার (Cervical cancer) নির্ণয়ের উপায় সমূহ সম্পর্কে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

Screening: প্রাথমিক পর্যায়ে জরায়ু ক্যান্সারের কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না কিন্তু যদি কারো ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ শনাক্ত করা সম্ভবপর হয় তবে সেক্ষেত্রে চিকিৎসার মাধ্যমে প্রায় শতভাগ সফলতা পাওয়া যায়। কোনো প্রকার লক্ষণ ছাড়াই কিভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব?

এই ব্যাপারে আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি (ACS) এর নির্দেশনা হলো ২৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী সুস্থ নারীদের জন্য অন্তত প্রতি পাঁচ বছর পর পর একবার করে HPV test করানো উচিত। ৬৫ বছরের পর থেকে এভাবে রুটিন পর্যবেক্ষণ করানোর প্রয়োজন নেই তবে চিকিৎসকের নির্দেশনা থাকলে করানো যেতে পারে। (Felman, 2021)

Pap test: এই পরীক্ষাকে Cervical smear test ও বলা হয়ে থাকে।‌ মূলত জরায়ু মুখ (Cervix) থেকে নমুনা (Cell) সংগ্রহ করে এই পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ ও ব্যথাহীন একটি পরীক্ষা যা ২১ থেকে ৬৫ বছর বয়সী নারীদের জন্য প্রতি ৩ বছর পর পর করানো উচিত। এই পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি রয়েছে কি না সে সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়।

উপরোক্ত পরীক্ষা দুইটি (HPV test & Pap test) সুস্থাবস্থায় করানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে যা ক্যান্সারের সম্ভাবনা রয়েছে কি না তা জানতে কিংবা প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করতে সহায়তা করে। তবে জরায়ু ক্যান্সারের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পরে রোগ নির্ণয়ের জন্য যে সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে তা হলো:

  • HPV DNA Testing: পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে সব প্রকরণের HPV ইনফেকশন জরায়ু ক্যান্সার সৃষ্টি করে না। আর তাই এই পরীক্ষার মাধ্যমে HPV এর প্রকরণ নির্ণয়ের মাধ্যমে জানা যায় যে এই ভাইরাসের সংক্রমণকতটা ক্ষতিকর হতে পারে। জরায়ু থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে এই পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।
  • Colposcopy: Speculum এবং একটি colposcope যন্ত্র জরায়ুতে প্রবেশের মাধ্যমে এই পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুর অস্বাভাবিকতা পর্যবেক্ষণ করা যায়।
  • Biopsy: জরায়ু থেকে টিস্যু সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে এই পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। যার মাধ্যমে ক্যান্সারের ধরন ও পর্যায় নির্ণয় করা হয়।
  • অন্যান্য: এছাড়াও রক্ত পরীক্ষা (CBC for complete blood count), প্রস্রাব পরীক্ষা (Urine R/E), আল্ট্রাসনোগ্রাফি (USG of lower abdomen) সহ ক্ষেত্র বিশেষে সিটি স্ক্যান (CT scan) ও এমআরআই (MRI) পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন হয়ে থাকে।

জরায়ুর ক্যান্সার এর চিকিৎসা (Treatment of cervical cancer)

জরায়ু ক্যান্সারের কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি গুলো বিষয়ে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

সার্জারি: প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের জরায়ু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা হলো সার্জারির মাধ্যমে ক্যান্সার সংক্রমিত অংশ অপসারণ করে ফেলা। তবে চিকিৎসকগণ জরায়ুর পুরো অংশ সার্জারির মাধ্যমে অপসারণের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন যা পরবর্তীতে ক্যান্সারের পুনঃসংক্রমণের ঝুঁকি দূর করে। উল্লেখ্য জরায়ু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে পুনঃ সংক্রমণের ঝুঁকি অন্যান্য ক্যান্সারের তুলনায় অনেক বেশি। (Sachdev, 2021)

রেডিয়েশন থেরাপি: সার্জারির পরে অথবা পূর্বে রেডিয়েশন থেরাপি ব্যবহৃত হয়ে থাকে যা ক্যান্সারের বিস্তার রোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দুই ভাবে রেডিয়েশন থেরাপি নেওয়া যেতে পারে।

কেমোথেরাপি: সাধারণত চতুর্থ পর্যায়ের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি ব্যবহার করা হয়। এই পর্যায়ে কেমোথেরাপির মাধ্যমে ক্যান্সার সারানো যায় না তবে রোগ যন্ত্রণা লাঘব করা সম্ভবপর হয়ে থাকে।

অন্যান্য: এছাড়াও আধুনিক প্রযুক্তির চিকিৎসা হিসেবে রয়েছে Targeted therapy, LEEP conization, Diathermy, Cryosurgery, Laser surgery ইত্যাদি।‌

জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে কিছু বিশেষ নিয়মাবলী অনুসরণ করা উচিত। যেমন:

  • নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে শরীরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে
  • প্রতি ১ বছর পর পর অথবা চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়মিত Pap test করতে হবে
  • পুষ্টিবিদ (Dietitian) এর পরামর্শ অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে
  • প্রত্যেহ অল্প কিছু সময় ধরে মৃদু প্রকৃতির ব্যায়াম করতে হবে
  • ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে অবশ্যই তা পরিত্যাগ করতে হবে

জরায়ুর ক্যান্সার চিকিৎসায় পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া (Side effects of cervical cancer treatment)

জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসায় কিছু ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে যা নিচে উল্লেখ করা হলো। (Felman, 2021)

  • সার্জারির মাধ্যমে জরায়ুর অংশ বিশেষ অথবা জরায়ুর পুরো অংশ অপসারণ করা হলে গর্ভধারণের সক্ষমতা নষ্ট হয়। এছাড়াও মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া সহ যৌন স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে
  • রেডিয়েশন থেরাপির ফলে পেটে ব্যথা, মাসিকের সমস্যা, যোনিপথ সংকোচিত হয়ে যাওয়া সহ প্রস্রাব সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দেয়
  • কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মাথার চুল পড়া, সন্তান ধারণের সক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া সহ নির্ধারিত বয়সের অনেক আগেই মাসিক বন্ধ (Menopause) হয়ে যায়
  • এছাড়াও জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসায় সার্বিক ভাবে শরীর ও মনের উপর যে ধরনের প্রভাব পড়ে তা হলো রক্তস্বল্পতা (Anemia), শারীরিক দুর্বলতা, ক্লান্তি, অনিদ্রা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি

জরায়ুর ক্যান্সার এ কি কি ঝুঁকি থাকে? (What are the risks of cervical cancer?)

জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসায় নানাবিধ জটিলতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলেও ক্যান্সারের সংক্রমণ হলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসা গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। কেননা চিকিৎসা গ্রহণ করা না হলে ক্রমাগত ক্যান্সার আরো জটিলতর হতে থাকে এবং সেই সাথে চিকিৎসা ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। যথাসময়ে জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসা গ্রহণ না করলে পরবর্তীতে যে সমস্ত সমস্যা গুলো হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে তা হলো:

  • জরায়ুর অস্বাভাবিক স্ফীতির কারণে প্রস্রাব নালীতে চাপ পড়ে যার দরুন প্রস্রাব সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেয়
  • কিডনি বিকল হয়ে পড়ে যার ফলে পায়ে পানি জমে যায় (Edema)
  • ক্যান্সার হাড়ে আক্রমণ করে যার দরুন হাড়ে ব্যথা বোধ হয়
  • ক্ষুধা কমে যায় এবং ক্রমাগত শরীরের ওজন কমতে থাকে
  • ক্লান্তি ও দুর্বলতা বোধ হয় ইত্যাদি

উল্লেখ্য জরায়ু ক্যান্সারের প্রথম পর্যায়ে (Stage 1) যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করা হলে সেক্ষেত্রে পরবর্তী ৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে চিকিৎসা গ্রহণ করা সম্ভবপর না হলে অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্যায়ে (Stage 2) চিকিৎসা গ্রহণ করা হলে এই সম্ভাবনা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৬০ শতাংশে। এভাবে ক্রমান্বয়ে তৃতীয় (Stage 3) ও চতুর্থ পর্যায়ের (Stage 4) ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা কমে গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩০ শতাংশ ও ১৬ শতাংশে। (Sachdev, 2021) 

জরায়ুর ক্যান্সার প্রতিরোধ (Prevention of cervical cancer)

জরায়ুর ক্যান্সার প্রতিরোধ

Prevention of cervical cancer

জরায়ু ক্যান্সার হচ্ছে এমন একধরনের ক্যান্সার যার রয়েছে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী প্রতিরোধ ব্যবস্থা। যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায় তা নিচে উল্লেখ করা হলো। (Sachdev, 2021)

১। সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো HPV ভ্যাকসিন গ্রহণ করা। সাধারণত ১১ থেকে ২৬ বছর বয়সের মধ্যে এই ভ্যাকসিন গ্রহণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে তবে সর্বনিম্ন ৯ বছর এবং সর্বোচ্চ ৪৫ বছর পর্যন্ত এই ভ্যাকসিন নেওয়া যেতে পারে। তিন ডোজ ভ্যাকসিন প্রথম ডোজের দুই মাস পর দ্বিতীয় ডোজ এবং দ্বিতীয় ডোজের নূন্যতম চার মাস পর তৃতীয় ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে হয়। তবে ১৫ বছরের কম বয়সীদের জন্য দুই ডোজ ভ্যাকসিন ই যথেষ্ট।

২। চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ২১ থেকে ৬৫ বছরের নারীদের জন্য প্রতি তিন বছর অন্তর অন্তর ‌Pap test করাতে হবে।

৩। আরো সুনিশ্চিত ফলাফল পাওয়ার জন্য Pap test এর পাশাপাশি HPV test করাতে হবে। সাধারণত ২৫ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এই টেস্ট করানোর নির্দেশনা দেওয়া হয় না। তবে ২৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সীদের জন্য প্রতি ৫ বছর পর পর এই টেস্ট করানো উচিত।

৪। নূন্যতম ১৭ বছরের নিচে বিয়ে, যৌন সম্পর্ক স্থাপন ও গর্ভধারণ করা যাবে না।

৫। গবেষণায় দেখা গেছে যে ধুমপান জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আর তাই ধুমপান পরিহার করতে হবে। (Felman, 2021)

৬। একাধিক যৌন সঙ্গিনী তথা অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা থেকে বিরত থাকা জরুরি।

৭। যদি পুরুষ সঙ্গীর HPV সংক্রমণ হয়ে থাকে অথবা একাধিক সঙ্গীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে পুরুষ সঙ্গীর অবশ্যই কনডম ব্যবহার করতে হবে।

৮। দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিরোধক বড়ি খাওয়া যাবে না। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণের অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করতে হবে।

৯। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

১০। বেশি ‌বেশি শাকসবজি এবং ফলমূল খেতে হবে।

জরায়ু ক্যান্সার এবং প্রেগনেন্সি (Cervical Cancer and Pregnancy)

গর্ভকালীন সময়ে জরায়ুর ক্যান্সার খুবই বিরল প্রকৃতির অর্থাৎ সম্ভাবনা কম তবে কদাচিৎ দেখা যেতে পারে। যেহেতু ভ্রূণ জরায়ুর মধ্যে অবস্থান করে তো এমতাবস্থায় কি করা উচিত?

ক্যান্সারের ধরন, পর্যায় ও গর্ভস্থ ভ্রূণের বয়সের উপর নির্ভর করে এই ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। যেহেতু জরায়ু ক্যান্সার খুবই ধীর গতিতে বিস্তার লাভ করে আর তাই প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য প্রসব কালীন সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে। অর্থাৎ প্রসবের পর জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। (Watson, 2019)

তবে ক্যান্সার যদি দ্বিতীয় বা তৃতীয় পর্যায়ের হয়ে থাকে অথবা খুবই দ্রুত গতিতে বিস্তার লাভ করার সম্ভাবনা দেখা যায় সেক্ষেত্রে গর্ভস্থ শিশুর বয়সের উপর নির্ভর করে দুইটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।

১। ২৪ সপ্তাহের কম সময়ের গর্ভকালীন শিশুর প্রসব করানো হলে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। আর তাই এক্ষেত্রে একমাত্র উপায় হলো গর্ভপাত (Abortion) করানো।

২। গর্ভকালীন সময় ২৪ সপ্তাহ বা তার বেশি হলে অথবা অন্তত ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভবপর হলে সেক্ষেত্রে বাচ্চা প্রসব করে বিশেষ যত্নে (NICU -Neonatal intensive care unit) সংরক্ষণ করতে হবে। অতঃপর মায়ের জন্য জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

উল্লেখ্য যে কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ (Oncologist) ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞের (Pediatrician) সাথে বারংবার পরামর্শ করে নিতে হবে।

বাংলাদেশে সার্ভিকাল ক্যান্সারের খরচ কত (Cost of cervical cancer in Bangladesh)

বাংলাদেশে সার্ভিকাল ক্যান্সারের প্রবণতা অনেক বেশি রয়েছে। এর কারণ হিসেবে গবেষকরা মনে করেন আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতার অভাব। তবে বর্তমান সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, সরকারি পদক্ষেপ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে মহিলাদের জরায়ু স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি ভাবে বিনা খরচে HPV ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়ে থাকে‌ যা জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশে সার্ভিকাল ক্যান্সারের চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রধান দুটি সমস্যার একটি হলো অধিকাংশ রোগী তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে থাকে যে পর্যায়ে চিকিৎসায় সফলতার সম্ভাবনা অনেক কম।  (Haque, 2017)  আর দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো ঘনবসতিপূর্ণ জনসংখ্যার এই দেশে রোগীর তুলনায় সরকারি চিকিৎসা সেবা অপ্রতুল। ফলে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

সরকারি হাসপাতাল গুলোতে বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় অনেক কম খরচে চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায়, কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল গুলোতে সেবা পাওয়া গেলেও চিকিৎসার অতিরিক্ত ব্যায় বহন করে সেই চিকিৎসা গ্রহণ করা অনেকের ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। আবার, এমন নিম্নবিত্ত পরিবারের সখ্যাও কম নয় যাদের পক্ষে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ বহন করারও সামর্থ্য থাকেনা।

জরায়ু একজন নারীর শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা তাকে মা হতে সহায়তা করে। আর তাই একজন মায়ের জরায়ু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জরায়ু ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসা গ্রহণের সক্ষমতা সবার মাঝে নেই। আর তাই প্রচেষ্টা রাখতে হবে যেনো জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভবপর হয়।

 

 

References

Felman, A. (2021, Sept 26). What you need to know about cervical cancer. Retrieved from Medical News Today: medicalnewstoday.com/articles/159821

Haque, N. (2017, Jun 27). Challenges to cervical cancer treatment in Bangladesh. Retrieved from NCBI: ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC5502821/#!po=69.5313

Sachdev, P. (2021, Sept 20). Cervical Cancer. Retrieved from WevMD: webmd.com/cancer/cervical-cancer/cervical-cancer

Sachdev, P. (2021, Sept 30). What Is Cervical Cancer and Can I Prevent It? Retrieved from WebMD: webmd.com/cancer/cervical-cancer/understanding-cervical-cancer-prevention

Watson, S. (2019, Sept 30). Everything You Need to Know About Cervical Cancer. Retrieved from Healthline: healthline.com/health/cervical-cancer#stages

Last Updated on April 17, 2023