বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো হার্টের রোগ তথা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক। হার্টের রোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য ধুমপান ও মদ্যপান বর্জন, কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করা, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার গুরুত্ব অপরিসীম।  

হার্ট ভালো রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের ডায়েট (খাদ্যাভ্যাস) প্রচলন রয়েছে। হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য ৬টি সেরা ডায়েট সম্পর্কে জানতে চাইলে এই অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যাভ্যাস 

ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর (গ্রিস, স্পেন, ইতালি, ফ্র্যান্স ইত্যাদি) মানুষের প্রচলিত খাদ্যাভ্যাস (১৯৬০ এর দশকের) মেডিটেরানিয়ান ডায়েট (Mediterranean diet) নামে পরিচিত। 

বিভিন্ন সময়ের গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ভূমধ্যসাগরীয় ডায়েট অনুসরণ করেন তাদের ক্ষেত্রে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হার্টের রোগের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। (McGrane, 2020) 

যেসব খাবার খেতে হবে 

১. ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যাভ্যাসের মূলনীতি হলো উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার (ফলমূল ও শাকসবজি) যতটা সম্ভব কম প্রক্রিয়া করে খেতে হবে। অর্থাৎ আঁশযুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।  

যেমনঃ গমের আঁশ (ভূষি) বাদ‌ দিয়ে ময়দা তৈরি না করে বরং সরাসরি গমের আটা দিয়ে খাবার তৈরি করতে হবে। সাদা‌ চালের পরিবর্তে বাদামী চাল দিয়ে ভাত রান্না করে খেতে হবে। 

২. ফলমূলের ক্ষেত্রে জুস বা শরবত না বানিয়ে বরং আস্ত ফল খেতে হবে। শাকসবজি কম তাপে রান্না করতে হবে যেন পুষ্টিগুণ কমে না যায়। বেশি বেশি সালাদ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।   

৩. সপ্তাহে অন্তত দুই দিন মাছ খেতে হবে। রান্নার কাজে এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ব্যবহার করতে হবে।  

যেগুলো বর্জন করতে হবে

মেডিটেরানিয়ান ডায়েট অনুযায়ী পরিমিত পরিমাণে মুরগির মাংস, ডিম ও লো-ফ্যাট দুধ খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে রেড মিট ও চর্বিযুক্ত মাংস খাওয়া যাবে না। এছাড়াও চিনি, বিস্কুট, পাউরুটি, কোমল পানীয় ও সবধরনের ফাস্টফুড বর্জন করতে হবে। 

DASH ডায়েট 

DASH দ্বারা Dietary Approaches to Stop Hypertension বোঝানো হয়। অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য এই ধরনের ডায়েট আবিষ্কার করা হয়েছে। 

অতিরিক্ত লবণ বর্জন

ড্যাশ‌ ডায়েটের প্রথম কথা হলো পরিমিত পরিমাণে লবণ খেতে হবে। কারণ লবণে থাকা সোডিয়াম ব্লাড প্রেসার বাড়িয়ে দেয়। 

একজন মানুষের জন্য দিনে ১৫০০ মিলিগ্রাম থেকে সর্বোচ্চ ২৪০০ মিলিগ্রামের বেশি সোডিয়াম গ্রহণ করা যাবে না। অর্থাৎ দিনে সর্বোচ্চ এক চা চামচ (৬ গ্রাম) বা তার চেয়ে কিছুটা কম লবণ খেতে হবে।

যেসব খাবার খেতে হবে 

পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে যা ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যেমনঃ বাদাম, বিভিন্ন ধরনের বীজ (যেমনঃ কুমড়ার বিচি ও সূর্যমুখী বীজ), ফলমূল ও শাকসবজি।  

আঁশযুক্ত শর্করা জাতীয় খাবার খেতে হবে। যেমনঃ বাদামী চালের ভাত, লাল আটার রুটি, ওটস, যব ইত্যাদি। সপ্তাহে অন্তত ২ দিন মাছ খেতে হবে। এছাড়াও মুরগির মাংস, ডিম ও ফ্যাট-ফ্রি দুধ খাওয়া যাবে।

যেগুলো বর্জন করতে হবে 

foods to avoid

স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। যেমনঃ দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, নারিকেল তেল, চর্বিযুক্ত মাংস, মুরগির চামড়া, পোড়া তেলে ভাজা খাবার (সিঙ্গাড়া, পুরি, সমুচা, পিঁয়াজু ইত্যাদি) সহ সবধরনের ফাস্টফুড। এছাড়াও চিনি, অ্যালকোহল ও কোমল পানীয় বর্জন করতে হবে। 

নিরামিষভোজী 

যারা প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবারগুলো বর্জন করেন তাদের নিরামিষভোজী বলা হয়। নিরামিষভোজী দুই ধরনের দেখা যায়।

একদল মানুষ মাছ ও মাংস না খেলেও দুধ ও ডিম খেয়ে থাকেন যাদের Vegetarians বলা হয়। আবার আরেকদল প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত সকল খাবার (ডিম ও দুধ সহ) বর্জন করেন তাদের Vegans বলা হয়।

নিরামিষ আহার (উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার খাওয়া) রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং হার্টের রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। 

যারা নিরামিষ আহার করেন তাদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কতিপয় ভিটামিন বা মিনারেল সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের প্রয়োজন হয়। কারণ উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবারে ভিটামিন বি১২, ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও জিংক অনুপস্থিত বা খুব কম পরিমাণে থাকে যা যথেষ্ট নয়।

ফ্লেক্সিটারিয়ান ডায়েট

veg

আমেরিকান বিখ্যাত পুষ্টিবিদ Dawn Jackson Blatner একটি বিশেষ ধরনের নিরামিষ ডায়েট প্ল্যান তৈরি করেন যেখানে সীমিত পরিমাণে প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। 

Flexible (শিথিল) ও Vegetarian (নিরামিষাশী) শব্দ দুটির সমন্বয়ে Flexitarian Diet নামকরণ করা হয়েছে। (Streit, 2022) 

যেসব খাবার খেতে হবে  

  • আঁশযুক্ত শর্করা জাতীয় খাবার 
  • প্রচুর ফলমূল ও শাকসবজি  
  • বাদাম ও বীজ জাতীয় খাবার 
  • মাছ ও সামুদ্রিক খাবার 

যেসব খাবার সীমিত পরিমাণে খেতে হবে 

  • ডিম 
  • মুরগির মাংস  
  • লো-ফ্যাট দুধ 

যেসব খাবার খাওয়া যাবে না 

  • চিনি 
  • ফাস্টফুড  
  • কোমল পানীয় 

ফ্লেক্সিটারিয়ান ডায়েট অনুসরণ করার ফলে হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। এছাড়াও ফ্লেক্সিটারিয়ান ডায়েট শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।

টিএলসি ডায়েট 

TLC এর পূর্ণরূপ হলো Therapeutic Lifestyle Changes যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট দ্বারা তৈরি একটি ডায়েট প্ল্যান। এই ডায়েটের উদ্দেশ্য হলো হার্টের রোগের ঝুঁকি কমানো এবং স্ট্রোক প্রতিরোধ করা।

টিএলসি ডায়েটের নির্দেশনাগুলো হলো- 

  • দৈনিক ক্যালরি চাহিদা মেনে খাবার খেতে হবে। চাহিদার চেয়ে বেশি ক্যালরি গ্রহণ করা যাবে না।  
  • দৈনিক ক্যালরি চাহিদার ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ স্বাস্থ্যকর চর্বি থেকে গ্রহণ করতে হবে। 
  • সরল শর্করার পরিবর্তে আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে।   
  • প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে। 
  • প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। 

টিএলসি ডায়েট রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমানোর মাধ্যমে হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায়।

কম কার্ব ডায়েট  

কার্ব দ্বারা কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা বোঝানো হয়েছে। কম কার্ব ডায়েট বলতে খাদ্যতালিকায় তুলনামূলক কম পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার (ভাত, রুটি, পাস্তা, নুডলস, বিস্কুট ইত্যাদি) রাখতে হবে। 

গবেষণায় দেখা গেছে যে, কম কার্ব ডায়েট হার্টের রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। (McGrane, 2020) 

শরীরের ক্যালরি চাহিদা পূরণের জন্য ভালো মানের প্রোটিন ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের উপর ভরসা করতে হবে। 

ভালো মানের প্রোটিন হিসেবে ডিম, মাছ, মুরগির মাংস, বাদাম, ডাল ইত্যাদি খেতে হবে। স্বাস্থ্যকর ফ্যাট বলতে মাছ, সূর্যমুখী তেল, অলিভ অয়েল, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি বোঝানো হয়।  

কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার একদম বাদ দিতে হবে তা নয়, তবে কম খেতে হবে। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। 

শেষ কথা 

হার্টের জন্য উপকারী সবগুলো ডায়েট প্রায় একই রকম নির্দেশনা বহন করে। অর্থাৎ আঁশযুক্ত খাবার (ফলমূল ও শাকসবজি), স্বাস্থ্যকর প্রোটিন ও ফ্যাট খেতে হবে। এছাড়াও অতিরিক্ত লবণ, চিনি, প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত চর্বি, কোমল পানীয়, অ্যালকোহল ইত্যাদি বর্জন করতে হবে।  

হার্টের রোগ প্রতিরোধ করে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা জরুরী। খাদ্যতালিকা সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাওয়ার জন্য একজন পুষ্টিবিদের (Dietitian) পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।    

References

McGrane, K. (2020, October 27). The 6 Best Diets for Heart Health. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/best-diet-for-heart-health

Streit, L. (2022, January 14). The Flexitarian Diet: A Detailed Beginner’s Guide. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/flexitarian-diet-guide

Last Updated on December 31, 2023