শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলন রয়েছে কিন্তু অনেকেই অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করেও শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে সক্ষম হয় না। এর কারণ হলো প্রচলিত ধারণাগুলোর মধ্যে কিছু কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। 

ভুল পদ্ধতি অবলম্বন করা হলে তা শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে না। বরং তা শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই অনুচ্ছেদে ওজন কমানোর প্রচলিত ১০ টি ভুল ধারণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

১। সব ক্যালরি সমান 

আমিষ, চর্বি ও শর্করা জাতীয় খাবার থেকে ক্যালরি পাওয়া যায়। ভিটামিন, মিনারেলস, ফাইবার ও পানিতে কোনো ক্যালরি নেই। আমিষ ও শর্করার প্রতি ১ গ্রামে ৪ ক্যালরি অনুপাতে এবং চর্বির প্রতি ১ গ্রামে ৯ ক্যালরি রয়েছে। (Gunnars, 2019)  

খাবার গ্রহণ থেকে শুরু করে হজম, শোষণ ও বিপাক প্রক্রিয়ার (Metabolism) মাধ্যমে ক্যালরি উৎপন্ন হওয়া পর্যন্ত শরীরের কিছু ক্যালরি ব্যয় হয়। তবে সব খাবারের জন্য ব্যয় হওয়া ক্যালরির পরিমাণ সমান নয়। 

শর্করা জাতীয় খাবার প্রক্রিয়ায় ব্যয় হওয়া ক্যালরির পরিমাণ প্রোটিন জাতীয় খাবার প্রক্রিয়ার তুলনায় বেশ কম। আবার জটিল শর্করা জাতীয় খাবারের তুলনায় সরল শর্করা জাতীয় খাবার (সাদা ভাত, ময়দার তৈরি খাবার, চিনি ইত্যাদি) শরীরে দ্রুত ক্যালরি সরবরাহ করে। 

শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য সরল শর্করা জাতীয় খাবারের পরিবর্তে জটিল শর্করা (বাদামী চালের ভাত, লাল আটার রুটি, যব, ওটস ইত্যাদি) খেতে হবে। ফ্যাট জাতীয় খাবার কম খেয়ে প্রোটিন জাতীয় খাবার (মাছ, ডিম, মুরগির মাংস, লো ফ্যাট বা ফ্যাট ফ্রি দুধ ইত্যাদি) বেশি খেতে হবে।

২। ওজন কমানো একটি দ্রুত গতিসম্পন্ন প্রক্রিয়া   

শরীরের অতিরিক্ত ওজন বিশিষ্ট মানুষের ক্ষেত্রে খুব দ্রুত ওজন কমানোর ইচ্ছা দেখা যায়। মনে রাখতে হবে, শরীরের ওজন একদিনে বেড়ে অনেক বেশি হয়ে যায় না। তাই দ্রুত ওজন কমানোর চেষ্টা না করে বরং যথেষ্ট সময় দিতে হবে।  

শরীরের ওজন কমানোর স্বাস্থ্যকর উপায় হলো সপ্তাহে ১ থেকে ২ পাউন্ড (০.৫ কেজি থেকে সর্বোচ্চ ১ কেজি) ওজন কমানোর চেষ্টা করা। এক সপ্তাহেই শরীরের সব চর্বি বা অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলার প্রত্যাশা করা যাবে না। (Mayo Clinic, 2021) 

৩। সাপ্লিমেন্ট ওজন কমাতে সাহায্য করে

যারা রাতারাতি শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে আগ্রহী তাদের ক্ষেত্রে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার প্রবণতা দেখা যায়। বাজারে অনেক সাপ্লিমেন্ট কিনতে পাওয়া যায় যা চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করে বিক্রি করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এইসব সাপ্লিমেন্ট শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর ক্ষেত্রে কোনো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে না। 

কোনো কোনো সাপ্লিমেন্ট হয়তো শরীরের বিপাক প্রক্রিয়ার গতি (মেটাবলিসম রেট) বাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ওজন কমানোর ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়াম করতে হবে। 

একান্তই কোনো সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার প্রয়োজন মনে করলে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

৪। কম খান, শরীরচর্চা বেশি করুন 

exercise

অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য শরীরের দৈনিক ক্যালরি চাহিদার তুলনায় কিছুটা কম খাবার খেতে হবে এবং সেই সাথে ব্যায়াম করতে হবে যেন ক্যালরি খরচ হয়। এভাবে শরীরে ক্যালরি ঘাটতি হলে জমে থাকা ফ্যাট ভেঙে ক্যালরি উৎপন্ন হবে তথা শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমতে থাকবে। 

এই নীতি মেনে চলা শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য নিরাপদ ও কার্যকরী। তবে দ্রুত ওজন কমানোর আশায় অনেকে খুব কম পরিমাণ খাবার খেয়ে থাকেন এবং সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে ব্যায়াম করেন যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অর্থাৎ খুব কম খাওয়া এবং অনেক বেশি ব্যায়াম করার ফলে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্ন হওয়া সহ দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ হবে। 

স্বাভাবিক নিয়মে (সপ্তাহে সর্বোচ্চ ১ কেজি) ওজন কমানোর জন্য দৈনিক চাহিদার তুলনায় ৫০০ থেকে ১০০০ ক্যালরি কম গ্রহণ করতে হবে এবং প্রতিদিন ৩০ মিনিট মৃদু প্রকৃতির ব্যায়াম করতে হবে।         

৫। কার্বোহাইড্রেট আপনাকে মোটা করে তোলে 

কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার মানেই ওজন বাড়িয়ে দেবে কথাটা পুরোপুরি সঠিক নয়। কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার বেশি খেলে শরীরে ফ্যাট জমে যেতে পারে তবে একদম বাদ‌ দেওয়া যাবে না। কারণ কার্বোহাইড্রেট ভেঙে গ্লুকোজ হয় যা থেকে মেটাবলিসমের মাধ্যমে শরীরের জন্য ক্যালরি উৎপন্ন হয়।

শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণের পরিমাণ অবশ্যই পরিমিত হতে হবে। বিশেষ করে সরল শর্করা জাতীয় খাবার (যেমনঃ সাদা ভাত ও ময়দার তৈরি খাবার) যতটা সম্ভব কম খেতে হবে।

৬। চর্বি আপনাকে মোটা করে তুলবে 

চর্বি থেকে সবচেয়ে বেশি (প্রতি ১ গ্রামে ৯ ক্যালরি) পরিমাণে ক্যালরি পাওয়া যায়। তবে চর্বিযুক্ত খাবার খেলেই ওজন বেড়ে যাবে এমন নয়। বরং স্বাস্থ্যকর চর্বি খেতে হবে যা শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

দৈনিক ক্যালরি চাহিদার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত চর্বি থেকে নেওয়া যাবে। তবে তা হতে হবে স্বাস্থ্যকর চর্বি। যেমনঃ মাছ, অলিভ অয়েল, সূর্যমুখী তেল, বাদাম তেল, সয়াবিন তেল, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি।   

৭। ওজন কমাতে না খেয়ে থাকতে হবে 

unhealthy foods

ওজন কমানোর জন্য না খেয়ে থাকতে হবে শুনে অনেকেই কষ্ট করে না খেয়ে থাকেন। তবে পরবর্তীতে যখন খাবার খেতে বসেন তখন একবারে অনেক বেশি খেয়ে ফেলেন। 

কোনো বেলার খাবার না খেয়ে পরবর্তীতে বেশি পরিমাণে খাওয়া ওজন কমানোর জন্য উপকারী নয়। বরং এতে মেটাবলিসম রেট কমে যায় যার ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে। 

শরীরের ওজন কমানোর জন্য কোনো বেলায় খাবার বাদ দিতে হবে না। বরং কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাওয়া বা পরিমাণে একটু কম খেতে পারলে ওজন কমে যাবে। 

৮। সুস্বাদু খাবার সবসময় ওজন বৃদ্ধি করে 

খাবারের স্বাদ বিবেচনায় শরীরের ওজন বেড়ে যায় না।‌ বরং খাবারের ক্যালরি কত তার উপর ওজন বেড়ে যাওয়া নির্ভর করে। তাই ওজন বাড়াতে হলে আপনার পছন্দের সব সুস্বাদু খাবার বর্জন করতে হবে এমন নয়।

সুস্বাদু খাবার যদি স্বাস্থ্যকর না হয় (যেমনঃ সরল শর্করা, চিনি, কোমল পানীয়, ফাস্টফুড, চর্বিযুক্ত মাংস, কলিজা ইত্যাদি) তবে সেক্ষেত্রে খাওয়া যাবে না। আবার সুস্বাদু খাবার স্বাস্থ্যকর হলেই বেশি খাওয়া যাবে না।

৯। স্থূলতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবসময় অসুস্থ  

স্থূলতা বা শরীরের অতিরিক্ত ওজন কোনো অসুস্থতা নয়। তাই মোটা মানুষকে অসুস্থ মনে করা যাবে না। 

তবে মোটা মানুষের ক্ষেত্রে কিছু কিছু রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। যেমনঃ হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি। আবার চিকন স্বাস্থ্যের মানুষ মানেই একদম সুস্থ এমন নয়। বরং যাদের শরীরের ওজন কম তাদের ক্ষেত্রেও রোগব্যাধি হতে পারে। 

১০। গ্লুটেন ফ্রি খাবার ওজন কমাতে সাহায্য করে  

গম থেকে উৎপন্ন সব খাবারে গ্লুটেন থাকে। যাদের অন্ত্রের রোগ (Celiac disease) রয়েছে তাদের জন্য গ্লুটেন ফ্রি খাবার খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে।  

শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে চান এমন ব্যক্তিদের জন্য গ্লুটেন ফ্রি খাবার বাজারে বিক্রি করা হয়। শরীরের ওজনের সাথে গ্লুটেনের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং গ্লুটেন ফ্রি খাবার হিসেবে যেগুলো বিক্রি করা হয় তাতে গমের আটার তুলনায় অনেক কম ফাইবার থাকে। কিন্তু ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার ওজন কমানোর জন্য বেশি উপকারী। তাই গ্লুটেন বাদ না‌ দিয়ে বরং ফাইবার যেন বাদ‌ না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। 

References

Gunnars, K. (2019, July 3). Top 12 Biggest Myths About Weight Loss. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/top-12-biggest-myths-about-weight-loss

Mayo Clinic. (2021, 12 07). Weight loss. Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/healthy-lifestyle/weight-loss/in-depth/weight-loss/art-20047752

Last Updated on December 31, 2023