সাইনুসাইটিস কি সেই সম্পর্কে জানতে হলে আগে বুঝতে হবে সাইনাস কি? কপাল, চোখ, নাক ও উপরের চোয়ালে ফাঁপা হাড়ের ৪ জোড়া গহ্বর রয়েছে যাদেরকে যথাক্রমে ফ্রন্টাল, স্পেনয়েড, ইথময়েড ও ম্যাক্সিলারি সাইনাস বলা হয়। সুস্থ অবস্থায় সাইনাসগুলো বায়ু পুর্ণ থাকে তবে কোনো কারণবশত সাইনাসে প্রদাহ হলে তখন মিউকাস জমা হয় যাকে সাইনুসাইটিস বা সাইনোসাইটিস বলে। এই রোগের কারণ, ধরন, লক্ষণ, কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে, চিকিৎসা পদ্ধতি সহ শিশুদের সাইনাস সংক্রমণ হলে করণীয় বিষয়াবলী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

সাইনুসাইটিস কেন হয়? 

সাইনাসের মিউকাস মেমব্রেন থেকে অনবরত মিউকাস নিঃসরণ হয় যার প্রধান কাজ হলো শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা বায়ুর আর্দ্রতা ঠিক রাখা। সুস্থ অবস্থায় সাইনাসে মিউকাস জমা থাকে না বরং নাকের উপরের দিকের অংশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ভাইরাস, ব্যকটেরিয়া ও ছত্রাকের সংক্রমণ হলে তখন সাইনাসে প্রদাহের সৃষ্টি হয় এবং অতিরিক্ত পরিমাণে মিউকাস নিঃসরণের ফলে তা সাইনাসের মধ্যে জমা হতে থাকে। অথবা নাকে কোনো সমস্যা থাকলে মিউকাস বের হতে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং যার ফলশ্রুতিতে মিউকাস জমা হতে থাকে। মোটাদাগে সাইনাসের কারণ হিসেবে চিহ্নিত বিষয়গুলো হলোঃ (Cleveland Clinic, 2020)

  • ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের সংক্রমণ 
  • দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা 
  • ঠান্ডা লাগা (Common cold)
  • এলার্জিক রাইনাইটিস 
  • নাকের পলিপাস 
  • নাকের হাড় বাঁকা ইত্যাদি

যাদের এজমা রোগ, এলার্জির সমস্যা ও ধুমপানের অভ্যাস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে সাইনুসাইটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। 

সাইনাস সংক্রমণের ধরন

সাইনাস সংক্রমণের স্থায়ীত্বকাল ও পুনরাক্রমণের উপর ভিত্তি করে সাইনুসাইটিসের চারটি ধরন রয়েছে। যথাঃ (Ellis, 2021)

  • একিউট সাইনুসাইটিস: হঠাৎ আক্রমণ হয় এবং রোগের স্থায়ীত্বকাল ৪ সপ্তাহের কম থাকে।
  • সাবএকিউট সাইনুসাইটিস: স্থায়ীত্বকাল ৪ থেকে ১২ সপ্তাহ। 
  • একিউট সাইনুসাইটিসের পুনরাক্রমণ: বছরে ৪ অথবা তার অধিক বার আক্রান্ত হয় এবং প্রতিবার ২ সপ্তাহের কম স্থায়ীত্বকাল থাকে। 
  • ক্রনিক সাইনুসাইটিস: ১২ সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে সাইনুসাইটিস থাকে। 

সাইনোসাইটিসের লক্ষণ

সাইনাস অর্থ হলো গহ্বর যা সবার শরীরে থাকে আর সেই গহ্বরে যখন প্রদাহ হবে তখন তাকে সাইনোসাইটিস বলা হয়। কিন্তু প্রচলিত ভাবে অনেকেই সাইনাস দ্বারা সাইনুসাইটিসকে বুঝিয়ে থাকেন। যাহোক, সাইনোসাইটিস বা সাইনাস এর লক্ষণ গুলো হলোঃ

  • মাথাব্যথা 
  • নাক থেকে হলুদ বা সবুজাভ ঘন সর্দি বের হয়
  • নাক বন্ধ থাকে
  • ঘ্রাণশক্তি কমে যায় 
  • নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ থাকতে পারে
  • জ্বর ও কাশি হতে পারে
  • দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ ইত্যাদি 

সাইনাসের মাথাব্যথার ধরন হলো কপালের সম্মুখভাগে অধিক ব্যথা, মাথা ভারি লাগে এবং মুখমণ্ডলে চাপ বোধ হয়। এছাড়াও মাথা ঝুঁকিয়ে রাখলে এবং সকালের দিকে ব্যথার বৃদ্ধি হয়ে থাকে। 

কখন একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন?

সাইনাস সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিলে প্রাথমিক পর্যায়ে কতিপয় ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে উপশম পাওয়া যায়। বিশেষ করে একিউট সাইনুসাইটিসের ক্ষেত্রে ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। তবে যদি লক্ষণ খুব তীব্রতর হয়ে থাকে অথবা দীর্ঘমেয়াদী (১০ দিনের বেশি) ও বার বার পুনরাক্রমণ হয় এমন ধরনের সাইনাসের ক্ষেত্রে একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। 

সাইনাসের ঘরোয়া সমাধান 

ঘরোয়া পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি সহজলভ্য, কোনো খরচ হয় না এবং সবধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত। সাইনাসের ক্ষেত্রে যেসব ঘরোয়া পদ্ধতি উপকারিতা বয়ে আনতে পারে তা হলোঃ 

  • গরম পানির ভাপ নেওয়া
  • কুসুম গরম পানিতে সামান্য পরিমাণ খাবার লবণ মিশিয়ে সেই পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করা 
  • পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং তরল জাতীয় খাবার (স্যুপ) খেতে হবে
  • ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে।‌ যেমনঃ লেবু, কমলা, মাল্টা, আঙ্গুর, আমড়া, আমলকি, আনারস, জাম্বুরা, পেয়ারা, লিচু, লেটুসপাতা, কাঁচা মরিচ, ব্রকলি ইত্যাদি
  • লেবু, আদা, পুদিনাপাতা ইত্যাদি সহযোগে রং চা (চিনি ছাড়া) পান করা
  • রাতে একাধিক বালিশ নিয়ে মাথা উঁচু রেখে শুয়ে থাকা। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন ঘাড়ে ব্যথা না হয়

সাইনাস এর ঔষধ

সাইনাসের সমস্যা দূর করতে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওটিসি মেডিসিন সেবন করা যাবে।‌ এই ধরনের ঔষধ সাইনাস‌ সংক্রমণ হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে সেবন করলে বেশ উপকার পাওয়া সম্ভব। যেমনঃ 

  • জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল ৫০০ মিগ্রা দিনে ৩ বার খেতে হবে
  • ঠান্ডার জন্য এন্টিহিস্টামিন গোত্রের ঔষধ (যেমনঃ সেট্রিজিন, লোরাটাডিন বা ফেক্সোফেনাডিন) দিনে একবার সেবন করতে হবে
  • নাক বন্ধ থাকলে Decongestant ধরনের নাকের স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমনঃ Afrin (এরিস্টোফার্মা), Azolin (একমি), Natazol (ইবনে সিনা), Nazolin (বেক্সিমকো), Rynex (ইনসেপ্টা), Xylocon (স্কয়ার) ইত্যাদি

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণের ক্ষেত্রে ওটিসি ঔষধ সর্বোচ্চ ৭ দিন এবং নাকের স্প্রে ৩ দিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে। তবে যাদের উচ্চ রক্তচাপ, গ্লুকোমা, প্রস্টেট গ্রন্থির রোগ ও ঘুমের সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়া ওষুধ সেবন করা উচিত নয়। 

সাইনাসের ব্যায়াম 

ইয়োগা বা শ্বাসের ব্যায়াম করার মাধ্যমে সাইনাসের সমস্যায় উপকার পাওয়া যায়। এই সময়ে ভারী কাজ না করে বরং বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। তবে হাঁটাহাঁটি করা যেতে পারে কিন্তু মাথা নিচের দিকে ঝুঁকে যায় এমন ধরনের ব্যায়াম থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, মাথা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখলে সাইনাসের যন্ত্রণা বেড়ে যায়। 

সাইনাস নির্ণয় 

ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন এবং ওটিসি ঔষধ সেবন করে আশানুরূপ ফল পাওয়া না‌ গেলে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এই পর্যায়ে চিকিৎসক রোগের কারণ নির্ণয়ের জন্য কতিপয় পরিক্ষা নিরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। যেমনঃ

  • ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন
  • নাকের এন্ডোস্কপি
  • সাইনাসের এক্সরে বা সিটিস্ক্যান 
  • রক্ত পরীক্ষা 
  • এলার্জি টেস্ট ইত্যাদি 

সাইনাসের চিকিৎসা

সাইনাসের কারণ নির্ণয় করা গেলে সেই কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যেমনঃ 

  • এলার্জি জনিত কারণে সাইনাস হলে সেক্ষেত্রে এন্টিহিস্টামিন, স্টেরোয়েড জাতীয় সাইনাসের ঔষধ ও স্প্রে, Decongestant স্প্রে ইত্যাদি চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবহার করতে হয়।
  • ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থাকলে এন্টি বায়োটিক ঔষধ খেতে হবে।
  • ছত্রাক ও ভাইরাস ঘটিত ক্ষেত্রে এন্টি বায়োটিক কাজে দেবে না। আবার এন্টি ফাংগাল ও এন্টি ভাইরাস ঔষধ সচরাচর পাওয়া যায় না। আর তাই এক্ষেত্রে প্যারাসিটামল সহ অন্যান্য ঔষধ ও স্প্রে ব্যবহার করা হয়। 
  • পলিপাস বা নাকের হাড় বাঁকা থাকলে সার্জারির প্রয়োজন পড়ে।

সাইনাসের জটিলতা 

সাইনাসের যথাযথ চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা‌ না হলে দীর্ঘদিন ধরে রোগ যন্ত্রণায় ভুগতে হয় এবং সেই সাথে রোগের জটিলতা বাড়তে থাকে। সাইনাসের থেকে কানের মধ্যে সংক্রমণ ও মেনিনজাইটিস (Meningitis) হতে পারে। মেনিনজাইটিস হলো মস্তিষ্কপর্দার প্রদাহ যেখানে জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। 

শিশুদের সাইনাসের সংক্রমণ

শিশুদের ক্ষেত্রে সাইনাস‌ সংক্রমণ একটি কমন ঘটনা। আপনার শিশুর ক্ষেত্রে সাইনাসের সমস্যা হয়েছে কিনা তা নিচে উল্লেখিত লক্ষণ দেখে‌ বুঝতে পারবেন।‌ 

  • ৭ দিনের বেশি সময় ধরে ঠান্ডা এবং সেই সাথে জ্বর থাকে
  • চোখের চারপাশে ফুলে যাওয়া
  • নাক থেকে ঘন সর্দি বের হয় 
  • কাশি, বমি, নিঃশ্বাসে‌ দুর্গন্ধ থাকে
  • মাথাব্যথা ও কানে ব্যথা হতে পারে

শিশুদের ক্ষেত্রে ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন, ওটিসি মেডিসিন সহ স্প্রে ব্যবহার করা যাবে। তবে ২ দুই বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য সাইনাসের লক্ষণ দেখা গেলে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মোতাবেক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। 

সাইনাসের সংক্রমণ সাধারণত ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তবে ক্রনিক সাইনুসাইটিস এবং পুনরাক্রমণ হয় এমন ধরনের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে সাইনুসাইটিস প্রতিরোধে মেনে চলুন নিচে উল্লেখিত নিয়মগুলো- 

  • হাত, মুখ ও নাখ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে
  • ধুলাবালি ও রোগজীবাণু এড়াতে মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে
  • শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকতে হবে
  • ধুমপানের অভ্যাস থাকলে বর্জন করতে হবে
  • এলার্জিক রিয়েকশন যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে 
  • ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে যেন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। 
References

Cleveland Clinic. (2020, April 06). Sinus Infection (Sinusitis). Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/17701-sinusitis

Ellis, M. E. (2021, November 30). Sinus Infection (Sinusitis): What It Is, Symptoms, and More. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/cold-flu/sinus-infection-symptoms

Last Updated on April 15, 2023