সাধারণত একজন মহিলা মানুষের ক্ষেত্রে কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা পুরুষদের তুলনায় কিছুটা কম হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়েদের বেলায় পুরুষদের মতোই অনেক বেশি হারে কিডনিতে পাথর হতে দেখা যাচ্ছে যার পেছনের অন্যতম প্রধান কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করা। (Gillams, 2021)

এই অনুচ্ছেদে কিডনিতে পাথর কেন হয়, কোন কোন বিষয় গুলো এই রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ, পরীক্ষা নিরীক্ষা সমূহ চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে কিডনিতে পাথর হলে করণীয় কি এবং খাবারের ব্যাপারে কি ধরনের নির্দেশনা মেনে চলা উচিত সেই ব্যাপারে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

কিডনিতে পাথর কেন হয়?

কিডনির পাথর সাধারণত ধরনের হয়ে থাকে এবং পাথরের ধরন অনুযায়ী কারণ ভিন্নতর হয়ে থাকে। যেমনঃ 

ক্যালসিয়াম অক্সালেট 

সবচেয়ে কমন প্রকৃতির পাথর যা শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম/অক্সালেট এর উপস্থিতি এবং হরমোনজনিত সমস্যার (যেমনঃ হাইপারপ্যারাথাইরোডিজম) ফলে হয়ে থাকে।  

ইউরিক এসিড স্টোন 

সাধারণত বাত (Gout) জনিত রোগীদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায় এবং যাদের আমিষ জাতীয় খাবার (যেমনঃ মাংস, ডাল, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি) বেশি বেশি খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে।‌ 

স্ট্রুভিট স্টোন (Struvite stones) 

প্রস্রাবে ইনফেকশনের প্রভাবে হয়ে থাকে এবং এই জাতীয় পাথরের আকার খুব দ্রুত বাড়ে।  

সিস্টিন স্টোন (Cystine stones)

খুবই বিরল প্রকৃতির পাথর যা জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে। 

মোটা দাগে যে বিষয়টিকে কিডনিতে পাথর হওয়ার একটা কমন কারণ হিসেবে দাঁড় করানো যায় তা হলো প্রয়োজনের তুলনায় কম পরিমাণে পানি পান করা। এর সাথে সাথে আরো কতিপয় বিষয়কে কিডনিতে পাথর হওয়ার রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমনঃ (Crosta, 2022)

  • ব্যক্তিগত বংশগত কিডনি পাথর রোগের ইতিহাস 
  • চল্লিশ বছরের বেশী বয়সী মানুষ
  • অতিরিক্ত আমিষ জাতীয় খাবার গ্রহণ করা
  • অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার অভ্যাস
  • শরীরের অতিরিক্ত ওজন (স্থূলতা)
  • গর্ভকালীন সময় 
  • ডায়াবেটিস
  • উচ্চ রক্তচাপ
  • ডায়রিয়া 

আইবিডি (IBD- Inflammatory bowel disease) ইত্যাদি। 

কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ

কিডনিতে পাথর হওয়ার একদম শুরুর দিকে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এমনকি পাথরের আকার খুব ছোট থাকে বলে তা রোগীর অজান্তেই প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যেতে পারে। তবে যদি পাথর ছোট থাকা অবস্থায় শরীর থেকে আপনাআপনি বেড়িয়ে না যায় এবং পাথরের আকার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেয়। যেমনঃ

  • বমি বমি ভাব এবং বমি 
  • পিঠের নিচের দিকে ব্যথা
  • তলপেট কুচকিতে ব্যথা 
  • ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হওয়া
  • কম পরিমাণে প্রস্রাববের হওয়া
  • প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি

পাথরের উপস্থিতি প্রস্রাব প্রবাহে বেশি বিঘ্ন ঘটালে মূত্রতন্ত্রে ইনফেকশনের সৃষ্টি হয়। আর এই পর্যায়ে জ্বর, শীতবোধ, বমি বমি ভাব বেড়ে যাওয়া, দুর্বলতা,‌ প্রস্রাবে ফেনা সহ দুর্গন্ধ দেখা যায়। এমতাবস্থায় দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

কিডনিতে পাথর হলে বোঝার উপায় (পরীক্ষা নিরীক্ষা)

লক্ষণ দেখে কিডনিতে পাথর হয়েছে বলে মনে হলে সেক্ষেত্রে কতিপয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করানোর মাধ্যমে পাথরের আকার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে জানা যায়। সাধারণত কিডনিতে পাথর নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত পরীক্ষা নিরীক্ষা গুলোর প্রয়োজন পড়ে। যেমনঃ

  • প্রস্রাব পরীক্ষা
  • এক্সরে (X-ray of KUB)
  • আলট্রাসনোগ্রাফি
  • সিটিস্ক্যান ইত্যাদি 

পরীক্ষার মাধ্যমে যদি কিডনি, মূত্রনালী অথবা মূত্রথলির কোনো স্থানে পাথরের উপস্থিতি দেখা যায় সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাথরের আকার যদি মিলিমিটার (5 mm) এর কম হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে কোনো ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, এত ছোট আকারের পাথর সাধারণত এমনিতেই প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে যায়। তবে এক্ষেত্রে রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। এর পাশাপাশি কতিপয় ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করলে তা পাথর বের করে দেওয়ার ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। 

এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন– কিডনির পাথর দূর করার ঘরোয়া উপায়

কিডনিতে পাথর হলে কি ওষুধ খেতে হবে?

বড় আকারের কিডনির পাথর সাধারণত এমনিতে বের হয়ে যেতে পারে না এবং এক্ষেত্রে উন্নত ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। মনে রাখবেন, এমন কোনো ঔষধ নেই যা খেলে পাথর ভেঙে বা গলে গিয়ে শরীর থেকে বের হতে পারে। তবে পাথরের আকার যদি মিলিমিটারের চেয়ে সামান্য বেশি হয় সেক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে কতিপয় ঔষধ সেবন করলে তা প্রস্রাব নালীর সামান্য প্রসারণ ঘটানোর মাধ্যমে পাথর বের হতে সহায়তা করতে পারে। প্রস্রাব নালীর ব্যাস যেহেতু মিলিমিটার, তাই এর চেয়ে খুব বেশি বড় আকারের পাথর ঔষধের মাধ্যমে বের করা সম্ভব হবে না। কি ঔষধ, কতদিন, কতটুকু মাত্রায় খেতে হবে সেই ব্যাপারে জানতে অবশ্যই একজন কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। এছাড়াও পাথর বের হয়ে যাওয়ার সময় ব্যথা বোধ হলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ব্যথা নাশক ঔষধ গ্রহণ করা যেতে পারে। 

কিডনিতে পাথর চিকিৎসা খরচ

পাথরের আকার বড় হলে অথবা যদি পাথরের অবস্থান কিডনির মধ্যে এমনভাবে থাকে যা বের হতে পারে না সেক্ষেত্রে ঔষধ নয়, বরং নিম্নলিখিত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের প্রয়োজন হয়।

SWL –  Shock Wave Lithotripsy: 

একধরনের শক ওয়েব থেরাপি যার মাধ্যমে শরীরের বাইরে থেকে বিশেষ প্রযুক্তির যন্ত্রের সহায়তায় পাথর ভেঙে টুকরো করে অপসারণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে কোনো কাটা ছেঁড়ার প্রয়োজন হয় না। 

PCNL- Percutaneous Nephrolithotomy 

বেশি বড় আকারের পাথরের ক্ষেত্রে যেখানে SWL এর মাধ্যমে পাথর ভাঙ্গা সম্ভব হয় না সেক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে পিঠের দিকে কিডনি বরাবর একটি ফুটো করে লম্বা, সরু টিউবের মতো যন্ত্র প্রবেশ করিয়ে কিডনি থেকে পাথর বের করে আনা হয়। 

Ureteroscopy 

পাথর যদি মূত্রনালী অথবা মূত্রথলিতে আটকে থাকে সেক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এটি এন্ডোস্কপির মতো যন্ত্র বিশেষ যা প্রস্রাবের রাস্তায় প্রবেশ করিয়ে পাথর ভেঙে বের করে আনা হয়।  

আশার কথা হলো, কিডনির পাথর অপসারণের জন্য এই সব উন্নত মানের চিকিৎসা আমাদের দেশে বিদ্যমান রয়েছে। কিডনি ফাউন্ডেশন সহ দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে খুব কম খরচে কিডনি পাথর রোগের চিকিৎসা পাওয়া যায়। আর বেসরকারি হাসপাতাল গুলোতে চিকিৎসার খরচ কিছুটা বেশি তবে সেবার মান বেশ উন্নত হয়ে থাকে। 

কিডনিতে পাথর হলে কি কি সমস্যা হয়‌?

পাথরের আকার ছোট হলে সেক্ষেত্রে কিছুদিন সময় নিয়ে অপেক্ষা করা যেতে পারে যেন প্রস্রাবের মাধ্যমে তা‌ বের হয়ে যায়।‌ তবে / মাস পর পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে,‌ পাথর এখনো রয়ে গেছে কিনা এবং এর আকার বেড়েছে কিনা। যদি এমনটি হয় সেক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব যথাযথ চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখবেন, দীর্ঘদিন ধরে কিডনিতে পাথর থাকলে তা কিডনি অকেজো হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। আর কিডনি একবার অকেজো হতে‌ শুরু করলে তা আর‌ পুনরুদ্ধার করা যায় না। 

কিডনিতে পাথর হলে কি খেতে হবে?

কিডনিতে পাথর রোগীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা যেন দিনে লিটার প্রস্রাব হয়।‌ এর জন্য দিনে কমপক্ষে . থেকে লিটার পানি পান করতে হবে। সেই সাথে আরো কিছু খাবার উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে।‌ যেমনঃ 

  • গ্রীন টি 
  • আপেল
  • আঙ্গুর
  • ভিটামিন বি সমৃদ্ধ খাবার
  • ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার ইত্যাদি

কিডনিতে পাথর হলে কি খাওয়া যাবে না? 

কিডনিতে পাথর হয়েছে এমন রোগী সহ যাদের ক্ষেত্রে এই রোগের প্রবণতা রয়েছে তাদের জন্য প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা হিসেবে নিম্নলিখিত খাবার গুলো কম পরিমাণে খেতে হবে। যেমনঃ

  • আমিষ জাতীয় খাবার
  • খাবারে অতিরিক্ত লবণ
  • অতিরিক্ত অক্সালেট সমৃদ্ধ খাবার যেমনঃ আলু, পালংশাক, বাদাম, চকলেট ইত্যাদি 
  • ভিটামিন সি ট্যাবলেট
  • ক্যালসিয়াম বড়ি ইত্যাদি

উল্লেখ্য, খাবার থেকে প্রাপ্ত ভিটামিন সি ক্যালসিয়াম ক্ষতিকারক নয়। বরং ভিটামিন সি ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের মাধ্যমে কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা কমতে থাকে। 

কিডনিতে পাথর হলে কি ব্যায়াম করতে হবে?

কিডনিতে পাথর হয়েছে এমন রোগীদের জন্য মৃদু প্রকৃতির ব্যায়াম পাথর দূর করা সহ ব্যথা নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও সুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নিয়মিত ব্যায়াম করার ফলে কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। তবে ব্যায়ামের ফলে অতিরিক্ত ঘাম হয়ে যেন শরীরে পানি স্বল্পতার সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। 

উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই যুগে কিডনিতে পাথর হওয়া ভয়ংকর কোনো রোগ নয়। আর তাই কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে ঘাবড়ে না গিয়ে বরং একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে যথাযথ চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে সুস্থ থাকুন।

References

Crosta, P. (2022, 12 03). What to know about kidney stones. Retrieved from medicalnewstoday: https://www.medicalnewstoday.com/articles/154193

Gillams, K. (2021, Oct 08). Gender Differences in Kidney Stone Disease (KSD): Findings from a Systematic Review. Retrieved from Pubmed Central: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC8497339/#CR15

Last Updated on November 20, 2023