আলসার প্রাণঘাতী কোনো রোগ নয়,‌ বরং এটি সম্পূর্ণ নিরাময় যোগ্য একটি রোগ।‌ তবে আলসার থেকে মুক্তির উপায় হলো যথাসময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা আর তার জন্য প্রয়োজন রোগ সম্পর্কিত প্রাথমিক জ্ঞান ও সচেতনতা। এই অনুচ্ছেদে আলসার কি, কেন হয়, কি কি লক্ষণ দেয় এবং আলসার হলে করণীয় কি সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও আলসার রোগীর খাদ্য তালিকা কেমন হওয়া উচিত সেই বিষয়ে অনুচ্ছেদের শেষের দিকে বলা হয়েছে।

আলসার কি

খাবার হজমের জন্য শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী পাকস্থলীতে প্রতিনিয়ত এসিড (হাইড্রোক্লোরিক এসিড) নিঃসরণ হয়।‌‌ এই এসিড খুবই তীব্র প্রকৃতির হয়ে থাকে তবে তা পাকস্থলী ও ডিওডেনামের (পাকস্থলী থেকে পরবর্তী সরু অংশ যার মধ্যে দিয়ে খাবার যায়) কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কারণ পাকস্থলী ও ডিওডেনামের অভ্যন্তরে মিউকাস মেমব্রেন নামক একটি বিশেষ স্তর থাকে যা এসিড দ্বারা ক্ষত সৃষ্টি হওয়া রোধ করে। কোনো কারণ বশত মিউকাস মেমব্রেনের স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হলে পাকস্থলী বা ডিওডেনামে ক্ষতের সৃষ্টি হয় যাকে মেডিকেলের ভাষায় আলসার বলা হয়ে থাকে। আলসার সৃষ্টির কারণ হিসেবে নিম্নলিখিত ২ টি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে।‌ যেমনঃ

Pylori ব্যাকটেরিয়া: অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে H. Pylori নামক ব্যাকটেরিয়া ঘটিত কারণে আলসার হয়ে থাকে। সাধারণত খাবার ও পানির মাধ্যমে এই ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ে।

ব্যথা নাশক ঔষধ: দীর্ঘদিন ধরে ব্যথা নাশক ঔষধ সেবন করার ফলে মিউকাস মেমব্রেনের স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আলসার সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও আরো কতিপয় বিষয়কে আলসারের রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।‌ যেমনঃ

  • ঝাল ও মশলাযুক্ত খাবার
  • ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস
  • অতিরিক্ত মানসিক চাপ ইত্যাদি আলসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়

আলসার কত প্রকার

পেটের কোন স্থানে আলসার হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে নামকরণ করা হয়েছে। যেমনঃ

গ্যাস্ট্রিক আলসারঃ গ্যাস্ট্রিক শব্দটি দ্বারা বোঝানো হয় পাকস্থলীকে আর তাই গ্যাস্ট্রিক আলসার মানে হলো পাকস্থলীতে আলসার হওয়া।
ডিওডেনাল আলসারঃ পাকস্থলী থেকে পরবর্তী সরু নালীর মতো অংশটির নাম হলো ডিওডেনাম আর এই স্থানে আলসার হলে তাকে ডিওডেনাল আলসার বলা হয়।

এছাড়াও খাদ্যনালী বা ইসোফেগাসে (Esophagus) আলসার হলে তাকে ইসোফেজিয়াল আলসার নামে অভিহিত করা হয়। তবে সবধরনের আলসারকে একটি নামে পেপটিক আলসার বলা হয় এবং পরবর্তী সকল আলোচনায় পেপটিক আলসার বোঝানো হয়েছে।

আলসার এর লক্ষণ 

আলসারের সবচেয়ে কমন লক্ষণ হলো বুক জ্বালাপোড়া ও পেটে ব্যথা বোধ হওয়া। ব্যথা ও জ্বালাপোড়া সাধারণত খালিপেটে ও রাতের বেলায় বেশি হয়। এছাড়াও অন্যান্য আরো যেসব লক্ষণ থাকতে পারে তা হলোঃ(MayoClinic, 2022)

  • বমি বমি ভাব
  • পেট ভরা মনে হয়
  • খাবারের প্রতি অনীহা দেখা যায়

উল্লেখিত লক্ষণ গুলো দেখা দিলে প্রাথমিক অবস্থায় এসিডিটি নিবারণের ঔষধ খাওয়ার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে যদি লক্ষণগুলো‌র বার বার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে তবে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। উল্লেখ্য আলসারের জটিল পর্যায়ের লক্ষণ হলো বমি হওয়া এমনকি বমির‌ সাথে রক্ত যাওয়া, কালো রঙের পায়খানা হওয়া এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে শরীরের ওজন কমতে থাকা।

আলসার নির্ণয়ের উপায়

পেটের কোন স্থানে আলসার হয়েছে তা লক্ষণ দেখে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। যেমনঃ ভরাপেটে ব্যথা বাড়লে তা গ্যাস্ট্রিক আলসার এর লক্ষণ আর খালিপেটে ব্যথা বাড়লে তা ডিওডেনাল আলসারের লক্ষণ। তবে নিশ্চিত ভাবে নির্ণয়ের উপায় হলো কতিপয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো।‌‌ যেমনঃ

এন্ডোস্কপি: ক্যামেরা যুক্ত একটি সরু নল মুখ‌ দিয়ে পেটের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে কোন‌ স্থানে কতটুকু ক্ষত/আলসার হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে নির্ণয় করা যায়।

রক্ত পরীক্ষা: রক্তে H Pylori ব্যাকটেরিয়া দমনের জন্য এন্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা তা দেখে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়।

Stool culture:‌ মল পরীক্ষা করে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি জানার চেষ্টা করা যেতে পারে। এছাড়াও প্রয়োজন সাপেক্ষে Urea breath test, barium swallow x-ray, আল্ট্রাসনোগ্রাফি ইত্যাদি পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন হয়ে থাকে।

আলসারের চিকিৎসা 

আলসারের চিকিৎসায় একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অথবা গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। সাধারণত মুখে ঔষধ সেবন করা ব্যতীত এই‌ রোগের জন্য অন্য কোনো ব্যবস্থা (যেমনঃ সার্জারি, হাসপাতালে ভর্তি থাকা) গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। আলসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এন্টি বায়োটিক ঔষধ। H. Pylori ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ফলে আলসার হলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের নির্দেশনা মোতাবেক এন্টি বায়োটিক ঔষধ সেবন করতে হবে। এছাড়াও পাকস্থলী থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে এসিড নিঃসরণ কমানো এবং এসিডের তীব্রতা কমানোর জন্য এন্টাসিড, এসিড ব্লকার ও PPI (Proton pump inhibitor) ঔষধ গ্রহনের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। সব‌‌ ধরনের ঔষধের ক্ষেত্রেই অবশ্যই ডোজ মেইনটেইন করা জরুরি।‌ অর্থাৎ শুধুমাত্র চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ঔষধ গ্রহণ ও বন্ধ করতে হবে।

গ্যাস্ট্রিক আলসার রোগীর খাদ্য তালিকা

গ্যাস্ট্রিক আলসার রোগীর খাদ্য তালিকা

গ্যাস্ট্রিক আলসার বা ডিউডেনাম আলসার যেটাই হোক না কেন সুস্থ থাকার জন্য চিকিৎসার পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো খাবার। একজন আলসারের রোগীর জন্য নিয়ম মাফিক খাবার গ্রহণ করা জরুরি।(Watson, 2020)

আলসার হলে কি কি খেতে হয়

কতিপয় খাবার আলসার রোগীর জন্য বেশ উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে।‌ যেমনঃ আপেল, জাম, চেরি ফল, স্ট্রবেরি, মধু, দই, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলি, গাজর, ঢেঁড়স সহ সবধরনের সবুজ শাকসবজি। এই খাবার গুলোতে প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। উল্লেখিত খাবার গুলো ছাড়াও সব ধরণের স্বাভাবিক খাবার (যেমনঃ ভাত, মাছ, মাংস,‌ ডিম ও ফলমূল) খেতে পারবে।

আলসার হলে কি কি খাওয়া যাবে না

আলসার রোগীর জন্য কতিপয় খাবার যতটা সম্ভব বর্জন করে চলতে হবে। যেমনঃ

  • চা ও কফি
  • চকোলেট
  • অতিরিক্ত ঝাল
  • লাল মাংস
  • ধুমপান
  • মদ্যপান ইত্যাদি

এছাড়াও বিশেষ কোনো খাবার খেলে যদি মনে হয় এসিডিটি বা বুক জ্বালাপোড়া হচ্ছে তবে সেই খাবার গুলো বর্জন করা উচিত। সেই সাথে অবশ্যই চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।

জিজ্ঞাসাঃ

১। কী খেলে আলসার ভাল হয়?

নিয়মমাফিক ঔষধ সেবন এবং সেই সাথে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এমন খাবার খেলে আলসার ভালো হয়। এছাডাও, আলসারের সমস্যা বৃদ্ধি করে এমন খাবার (উল্লেখিত) গুলো যতটা সম্ভব কম খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।

২। আলসার কত দিনে ভালো হয়?

যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করা হলে সাধারণত ১ থেকে ২ মাসের মধ্যে আলসার ভালো হয়ে যায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সময় আরো বেশি লাগতে পারে। যেমনঃ

  • সঠিক নিয়মে ঔষধ না খাওয়া
  • এন্টি বায়োটিক রেজিস্ট্যান্স
  • ব্যথা নাশক ঔষধ সেবন করা
  • ধুমপান বর্জন না করা ইত্যাদি

৩। আলসার থেকে কি ক্যান্সার হয়?

আলসার থেকে পরবর্তী জটিলতা হিসেবে পেটের ভেতরে রক্তক্ষরণ, খাদ্য চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়া এমনকি পেটের নাড়ি ফুটো হয়ে যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম যদিও একদম হবে না তা নয়। বরং, H. Pylori ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে পাকস্থলীতে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

৪। আলসার হলে কি লেবু খাওয়া যাবে?

আলসার হলে লেবু খাওয়া যাবে। কারণ লেবুতে থাকা ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে ক্ষত শুকাতে সহায়তা করবে। তবে কারো ক্ষেত্রে যদি লেবু খেলে এসিডিটি বাড়ে সেক্ষেত্রে খাওয়ার নিয়ম পরিবর্তন অথবা বর্জন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ভিটামিন সি এর বিকল্প উৎস হিসেবে কমলা, মালটা, আঙ্গুর, পেয়ারা, বাদামি ইত্যাদি খেতে হবে।

৫। আলসার হলে কি রুটি খাওয়া যাবে?

রুটি হলো প্রচুর পরিমাণে ফাইবার সমৃদ্ধ শর্করা জাতীয় খাবার।‌ আলসারে আক্রান্ত একজন রোগীর জন্য রুটি সহ ফাইবার সমৃদ্ধ যেকোনো খাবার খাওয়া উপকারি হবে।

৬। গ্যাস্ট্রিক আলসার থেকে মুক্তির উপায়

গ্যাস্ট্রিক আলসার তথা আলসার থেকে মুক্তির উপায় হলো চিকিৎসা গ্রহণ করা আর আলসার যেন না হয় তার জন্য প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা হলোঃ

  • বিশুদ্ধ পানি পান করা
  • খাওয়ার আগে হাত ধুয়ে নেওয়া
  • নিয়মমাফিক খাবার খাওয়া
  • ব্যথা নাশক‌ ঔষধ কম খাওয়া
  • ধুমপান ও মদ্যপান না করা ইত্যাদি
References

MayoClinic. (2022, June 11). Peptic ulcer. Retrieved from mayoclinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/peptic-ulcer/symptoms-causes/syc-20354223
Watson, K. (2020, August 21). Stomach Ulcer Diet. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/stomach-ulcer-diet

 

Last Updated on April 15, 2023