এলার্জি (Allergy) খুব কমন একটি স্বাস্থ্য সমস্যা তবে এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। এলার্জির অনেকগুলো ধরণ রয়েছে যার মধ্যে এনাফাইলাক্সিস (Anaphylaxis) এর জন্য জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এলার্জি কেন হয়, কাদের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকি রয়েছে, এলার্জির লক্ষণ কেমন এবং কি কি লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে সেই বিষয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

এলার্জি কেন হয় বা এলার্জি হওয়ার কারন ?

রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য মানুষের শরীরে রয়েছে নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউন সিস্টেম। যখন শরীরে কোনো রোগ জীবাণু (যেমনঃ ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাংগাস, পরজীবী ইত্যাদি) প্রবেশ করে তখন ইমিউন সিস্টেম এন্টিবডি তৈরি করে প্রতিক্রিয়া দেখায়। তবে কখনো কখনো ইমিউন সিস্টেম শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন উপাদানের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখায় যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এলার্জি বলা হয়। অর্থাৎ এলার্জি হলো শরীরের ইমিউন সিস্টেম এর অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া জনিত একটি রোগ। যে বস্তু মানুষের শরীরে এলার্জি সৃষ্টি করে তাকে এলার্জেন বলা হয়। সাধারণত যেসব জিনিসে এলার্জি হয়ে থাকে তা হলোঃ (Mayoclinic, 2022)

  • বায়ুবাহিত এলার্জেনঃ ধুলাবালি, পরাগ রেণু (Pollen), পোষাপ্রাণীর পশম, খুশকি, ডাস্ট মাইট (ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোকা যা মৃত কোষ ভক্ষণ করে থাকে) ইত্যাদি
  • কতিপয় খাবারঃ বেগুন, পুঁইশাক, যব, ভুট্টা, ওট, ময়দা, ইলিশ মাছ, গরুর মাংস, চিংড়ি মাছ, বাদাম, ডিম, দুধ, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি
  • মৌমাছি ও পোকামাকড়ের কামড়
  • কতিপয় ঔষধ (পেনিসিলিন)
  • তাপ, ঠান্ডা, ঘাম,‌ সাবান, শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট, রাসায়নিক পদার্থ, কীটনাশক, হ্যান্ড গ্লাভস, বেলুন, কনডম, প্রসাধনী, গহনা সামগ্রী

নারী পুরুষ সহ যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে এলার্জি হতে পারে। তবে এলার্জি হওয়ার অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। এছাড়াও যাদের এজমা রোগ আছে অথবা পরিবারে এজমা রোগ ও এলার্জির ইতিহাস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এলার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

এলার্জির লক্ষণ

এলার্জেন ত্বকের সংস্পর্শে এসে, শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে অথবা পরিপাকতন্ত্রের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে ইমিউন সিস্টেম প্রতিক্রিয়া হিসেবে হিস্টামিন তৈরি করে যার প্রভাবে এলার্জির লক্ষণ দেখা যায়। কোন বস্তুর প্রভাবে এলার্জি হয়েছে তার উপর নির্ভর করে এলার্জির লক্ষণের তারতম্য হয়ে থাকে। যেমনঃ

১। এলার্জিক রাইনাইটিসঃ সবচেয়ে কমন‌ প্রকৃতির এলার্জি যা শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে ধুলাবালি, পরাগ রেণু, ডাস্ট মাইট ইত্যাদি প্রবেশের ফলে হয়ে থাকে।‌ এটিকে ‘হে ফিভার’ ও (Hay Fever) বলা হয়। এক্ষেত্রে যে সমস্ত লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ

  • ঘন‌ ঘন হাঁচি হয়
  • নাকের ভেতর চুলকানি
  • নাক থেকে পানি পড়া
  • চোখ দিয়ে পানি পড়া
  • নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া
  • সর্দি হওয়া ইত্যাদি

২। বিশেষ কোনো খাবার খাওয়ার ফলে শরীরে এলার্জি হলে তাকে ফুড এলার্জি বলা হয়। এক্ষেত্রে সাধারণত চুলকানি, চুলকানোর পর জ্বালাপোড়া, চামড়ার উপর চাকা চাকা হয়ে ফুলে উঠা, জিহ্বা ও ঠোট ফুলে যাওয়া, বমি, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।

৩। মৌমাছি বা অন্য কোনো পোকামাকড়ের কামড়ের ফলে এলার্জি হলে হুল ফুটানোর জায়গায় ফুলে যায়, প্রদাহ হয়, পানি জমে, শ্বাসকষ্ট হয় এবং চুলকানি হতে পারে।

৪। ঔষধ জনিত প্রভাব বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে এলার্জি হলে চামড়ায় চাকা চাকা হয়ে ফুলে উঠে, র‍্যাশ (Rash) হয়, মুখমণ্ডল ফুলে যায় এবং চুলকানি থাকতে পারে।

৫। এটোপিক ডার্মাটাইটিসঃ এই ধরনের এলার্জি দীর্ঘমেয়াদী (Chronic) হয়ে থাকে এবং এর কারণ হলো পারিবারিক ইতিহাস। এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাচ্চাদের শরীরে দেখা যায় যার লক্ষণ হলোঃ

  • ত্বকের শুষ্কতা, প্রদাহ ও চুলকানি
  • বাচ্চাদের গাল লাল হয়ে যায়
  • চুলকানির পর র‍্যাশ হয় ইত্যাদি

৬। ত্বকে এলার্জেন বস্তুর সরাসরি সংস্পর্শে এলার্জি হলে কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিস বলা হয়। যেমনঃ আংটি, চুড়ি, গলার হার, সাবান, ডিটারজেন্ট, রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার। এক্ষেত্রে লক্ষণ হিসেবে চামড়া ফুলে যাওয়া,‌ চুলকানি, প্রদাহ, ফোস্কা পড়া ইত্যাদি হয়ে থাকে।

৭। সবচেয়ে জটিল প্রকৃতির এলার্জি হলো এনাফাইলাক্সিস যা ঔষধ, খাবার‌ ও পোকামাকড়ের কামড়ের ফলে হতে পারে। এমতাবস্থায় জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে Epinephrine/Adrenaline ইনজেকশন নিতে হয়, অন্যথায় রোগীর প্রাণহানির সম্ভাবনা রয়েছে। নিচে উল্লেখিত লক্ষণ দেখা দিলে বুঝতে হবে এনাফাইলাক্সিস হয়েছে। যেমনঃ

  • ঘন‌‌ ঘন শ্বাস নেওয়া
  • শ্বাসকষ্ট ও বুকের মধ্যে শব্দ হওয়া
  • দম বন্ধ আসছে এমন অনুভূতি
  • বমি বমি ভাব ও‌ বমি হওয়া
  • সারা শরীরে র‍্যাশ হওয়া
  • শরীর ফুলে ওঠা ও চুলকানি
  • জ্ঞান হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি

এলার্জি দূর করার ঘরোয়া উপায়

এলার্জি দূর করার জন্য ওষুধের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো এলার্জেন চিহ্নিত করে তা এড়িয়ে চলা।‌ অর্থাৎ আপনার ক্ষেত্রে কিসে এলার্জি হচ্ছে তা নির্ণয় করতে হবে এবং সেগুলো বর্জন করা জরুরী। যেমনঃ

  • যেসব খাবার খেলে এলার্জি হয় সেগুলো খাওয়া যাবে না
  • ঘরের পরিবেশ যেন নোংরা ও স্যাঁতস্যাঁতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে
  • বিছানারর চাদর, বালিশের কভার, ব্যবহৃত পোশাক ইত্যাদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে
  • লেপ, তোশক, কম্বল ও বালিশ মাঝে মধ্যে রোদে শুকাতে হবে
  • সাবান, শ্যাম্পু, প্রসাধনীতে সমস্যা হলে ব্র্যান্ড পরিবর্তন করতে হবে
  • নিঃশ্বাসের সাথে এলার্জেন প্রবেশ ঠেকাতে ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরিধান করুন

এলার্জি জাতীয় খাবারের তালিকা

বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে বেগুন, পুঁইশাক, যব, ভুট্টা, ওট, ময়দা, ইলিশ মাছ, গরুর মাংস, চিংড়ি মাছ, বাদাম, ডিম, দুধ, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদির সাথে সম্পর্কিত এলার্জি হয়ে থাকে। তবে এর বাইরে অন্য খাবারগুলো থেকেও এলার্জি হতে পারে। আপনার ক্ষেত্রে কোন খাবার খেলে এলার্জি হচ্ছে তা চিহ্নিত করুন এবং বর্জন করুন।

চোখের এলার্জি দূর করার উপায়

চোখে এলার্জি দূর করার জন্য এন্টিহিস্টামিন ঔষধ খেতে পারেন। এছাড়াও ঘরোয়া পদ্ধতি হিসেবে একটি পরিষ্কার নরম কাপড় ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে চোখের পাতায় ঠান্ডা সেক দেওয়া যেতে পারে। চোখের আশপাশ যতটা সম্ভব পরিষ্কার রাখুন, চোখে কাজল ও মেকআপ লাগাবেন না এবং চোখে ঘনঘন হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। যারা দীর্ঘসময় কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে চোখে চুলকানি সহ চোখের ক্লান্তি দূর করতে ২০-২০-২০ নামক ফর্মুলা ফলো করার মাধ্যমে বেশ ভালো ফলাফল পেতে পারেন। শরীরের বিভিন্ন অংশে এলার্জির জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধ গুলো প্রায় একই।

References

Mayoclinic. (2022, August 05). Allergies. Retrieved from Mayoclinic:
https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/allergies/symptoms-causes/syc-20351497

Last Updated on October 16, 2023