Table of Contents

বাংলাদেশের নারীরা কেন সবচেয়ে বেশি স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং মারা যায়?

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (CDC) এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় প্রধান ক্যান্সার হলো স্তন ক্যান্সার যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। প্রতি বছর প্রায় ২ মিলিয়নের বেশি সংখ্যক নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এই তালিকা আরো দীর্ঘায়িত করছে।

আশার কথা হলো এই যে প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভবপর হলে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত রোগীর ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তার জন্য প্রয়োজন স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতা।

যেমন: স্তন ক্যান্সারের কারণ, কাদের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকি রয়েছে, কিভাবে ঝুঁকি থেকে বাঁচা যায়, কি কি উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত ইত্যাদি বিষয়ে যথেষ্ঠ জ্ঞান থাকা জরুরি। এই অনুচ্ছেদে স্তন ক্যান্সারের কারণ, রোগ নির্ণয়ের উপায়, ক্যান্সারের পর্যায় সমূহ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায় সহ স্তন ক্যান্সার সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সকল বিষয় সহজ ও সাবলীল ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে।

স্তন ক্যান্সার কি? What is Breast Cancer in Bengali? 

স্তন মহিলাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা সৌন্দর্য এবং শিশুর খাবারের যোগান দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
বয়ঃসন্ধির পর একজন মহিলার স্তন (Breast) চর্বি, কানেক্টিভ টিস্যু এবং হাজার হাজার লোবিউল (Lobule) দিয়ে গঠিত হয়।
লোবিউল হলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রন্থি যা দুধ (Milk) উৎপাদন করতে পারে। লোবিউল থেকে নালীর (Ducts) মাধ্যমে দুধ স্তনবৃন্তের (Nipple) দিকে যায়।

স্তনের মধ্যে জিন ঘটিত ত্রুটির কারণে অস্বাভাবিক ভাবে কোষ বিভাজনের ফলে স্তন ক্যান্সার সংঘটিত হয়। লোবিউল, নালী অথবা স্তনের যে কোনো অংশেই ক্যান্সারের সংক্রমণ হতে পারে যা পরবর্তীতে লিম্ফ নোডের (Lymph nodes) মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। স্তন ক্যান্সার (Breast Cancer) বলতে মূলত মহিলাদের স্তনে ক্যান্সারের সংক্রমণকে বোঝানো হয়ে থাকে যা এই অনুচ্ছেদের আলোচ্য বিষয়। উল্লেখ্য পুরুষদের ক্ষেত্রেও স্তন ক্যান্সার হতে পারে তবে তা খুবই বিরল।  

স্তন ক্যান্সার কি? What is Breast Cancer in Bengali

স্তন ক্যান্সার কত প্রকার? (Types of Breast Cancer in Bengali)

স্তনের কোন অংশে সংক্রমণ হয়েছে এবং ক্যান্সারের ছড়িয়ে পড়ার ধরন অনুযায়ী স্তন ক্যান্সার চার ধরনের হয়ে থাকে যা সচরাচর সংঘটিত হতে ‌দেখা যায়। যেমন:

  1. Ductal carcinoma: এই ধরনের ক্যান্সারের সংক্রমণ স্তনের নালী (Ducts) থেকে শুরু হয় বলে এমন নামকরণ করা হয়েছে।
  2. Lobular carcinoma: লোবিউল (Lobule) নামক ক্ষুদ্র গ্রন্থি থেকে এই ধরনের ক্যান্সারের সংক্রমণ শুরু হয়ে থাকে।‌
  3. Invasive: এই ধরনের ক্যান্সার খুব দ্রুত আশেপাশের টিস্যু এমনকি শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
  4. Noninvasive: এই ধরনের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যায় না।

 

স্তন ক্যান্সারের আরো কিছু প্রকরণ রয়েছে তবে তা খুবই কম ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায়। যেমন:

  • Paget disease: এই ধরনের ক্যান্সারের সংক্রমণ শুরু হয় স্তন বৃন্ত (Nipple) থেকে যা পরবর্তীতে নিপলের চারপাশে (areola and skin) ছড়িয়ে পড়তে পারে।
  • Phyllodes tumor: খুবই বিরল প্রকৃতির এই ক্যান্সারের সংক্রমণ শুরু হয় কানেক্টিভ টিস্যু থেকে যা সাধারণত কম ক্ষতিকারক প্রকৃতির (Benign) হয়ে থাকে।
  • Angiosarcoma: স্তনের মধ্যে থাকা রক্ত ও লসিকা নালীতে ক্যান্সারের সংক্রমণ হলে তাকে Angiosarcoma বলা হয়ে থাকে।
  • IBC: IBC for Inflammatory Breast Cancer যা বিরল প্রকৃতির স্তন ক্যান্সার হলেও খুব দ্রুত জটিল আকার ধারণ করে। এই ধরনের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে স্তনে টিউমার সৃষ্টি হয় না তবে স্তন ফুলে যাওয়া, লাল বর্ণ ও গরম অনুভব হওয়া সহ স্তনের চামড়া খসখসে হয়ে কমলার খোসার মতো দেখায়।

 

স্তন ক্যান্সারের কারণ? What causes breast cancer in Bengali?

স্তনের মধ্যে একধরনের বিশেষ প্রকৃতির DNA থাকে যা কোষ বিভাজন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। DNA এর অকার্যকারিতার ফলে কোষ বিভাজনের এই প্রক্রিয়া অনিয়ন্ত্রিতভাবে হতে থাকলে তখন স্তনের মধ্যে টিউমার (Lump or mass) সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীতে ক্যান্সার হিসেবে পুরো স্তন সহ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

DNA এর অকার্যকারিতা তথা ক্যান্সার কোষ কলা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হিসেবে হরমোনের পরিবর্তন, জীবনযাপন পদ্ধতি এবং পরিবেশকে (Radiation) দায়ী মনে করেন গবেষকরা। এছাড়াও চিকিৎসক গণ কিছু কিছু বিষয়কে স্তন ক্যান্সারের রিস্ক ফ্যাক্টর (Risk factors) হিসেবে মনে করে থাকেন। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এমনটি হতে দেখা যায় যে রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে এমন ব্যক্তির ক্যান্সার হয় নি অথবা রিস্ক ফ্যাক্টর ব্যতীতই ক্যান্সারের সংক্রমণ ঘটেছে।

 

স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকির কারণগুলি কী কী?  What are the risk factors for breast cancer?

স্তন ক্যান্সারের রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকির কারণ সমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো: 

  • বয়স বেড়ে যাওয়া
  • মদ্যপানের অভ্যাস
  • অতিরিক্ত ওজন (Obesity)
  • বংশগত স্তন ক্যান্সারের ইতিহাস
  • কম বয়সে (১২ বছরের নিচে) মাসিক শুরু হওয়া
  • বাচ্চা না নেওয়া অথবা অধিক বয়সে (৩০ বছরের পর) প্রথম বাচ্চা নেওয়া
  • শিশুকে বুকের দুধ না খাওয়ানো
  • অধিক বয়স (৫৫ বছরের বেশি) পর্যন্ত মাসিক চলতে থাকা
  • মাসিক বন্ধ (Menopause) হওয়ার পরে হরমোন থেরাপি নেওয়া

এছাড়াও যাদের একটি স্তনে ক্যান্সার সংক্রমণের ইতিহাস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে অন্য স্তনে ক্যান্সার হওয়ার অনেক বেশি সম্ভাবনা রয়েছে।

কোন বয়সে স্তন ক্যান্সার হতে পারে? 

স্তন ক্যান্সার যে কোনো বয়সের মহিলাদের ক্ষেত্রেই হতে পারে।‌ তবে কম বয়সী মহিলাদের ক্ষেত্রে অনেক কম সম্ভাবনা রয়েছে।
কিশোরী মেয়েদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী ২০ বছর বয়সের একজন নারীর ক্ষেত্রে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ০.০৬ শতাংশ অর্থাৎ ১৭৩২ জনে ১ জন যা অতি নগণ্য হিসেবে বিবেচিত। অপরদিকে ৭০ বছরের একজন নারীর ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা বেড়ে দাঁড়ায় ৩.৮৪ শতাংশ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রতি ২৬ জনে ১ জন। মূলত মহিলাদের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।

 

স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ কি? What are the symptoms of Breast Cancer in Bengali?

স্তন ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় না। তবে পরবর্তীতে নানাবিধ উপসর্গ দেখা দেয় যা ক্যান্সারের ধরন (types) অনুযায়ী ভিন্নতর হয়ে থাকে। সাধারণ ভাবে যে সমস্ত লক্ষণ গুলো দেখা যায় তা নিচে তুলে ধরা হলো:

  • স্তনে চাকা (Lumps) অনুভূত হওয়া
  • মৃদু থেকে মাঝারি প্রকৃতির ব্যথা বোধ
  • হঠাৎ স্তনের আকার বদলে যাওয়া
  • স্তন ফুলে যাওয়া (Swelling)
  • স্তন থেকে দুধ ব্যতীত অন্য কোন তরল বা রক্ত বের হওয়া
  • বগলে চাকা (Lumps) হওয়া অথবা ফুলে যাওয়া
  • স্তন লাল বর্ণ ধারণ করা
  • নিপল স্তনের মধ্যে ঢুকে যাওয়া ইত্যাদি

উপরোক্ত লক্ষণ সমূহ দেখা দিলে স্তন ক্যান্সার হয়েছে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। বরং কিছু কিছু লক্ষণ রয়েছে যা কোন রোগ ছাড়াও হতে পারে।‌ যেমন: মাসিকের শুরুতে স্তন ভারী ও হালকা ব্যথা বোধ হতে পারে যা একদম ‌স্বাভাবিক। তেমনি ভাবে স্তনে চাকা হওয়া মানেই ক্যান্সার নয় তবে চাকার সাথে ব্যথা সহ আরো অন্যান্য লক্ষণ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে শুধু মাত্র লক্ষণ অনুযায়ী স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা যায় না। বরং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার (Diagnosis) মাধ্যমে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত করা হয়।

স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ কি

স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ কি

স্তন ক্যান্সার কিভাবে নির্ণয় করা যায়? How is breast cancer diagnosed?

স্তন সংক্রান্ত যে কোনো সমস্যায় একজন গাইনী ডাক্তারের (Gynecologist) শরণাপন্ন হতে হবে। সাধারণত নিম্নলিখিত পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়ে থাকে।‌ যেমন:

শারীরিক পর্যবেক্ষণ: সাধারণত একজন গাইনী ডাক্তার দ্বারা শারীরিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে স্তনে কোনো অস্বাভাবিক চাকা বা টিউমার হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করা যায়। এই পরীক্ষার জন্য কোনো বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে না। তবে রোগীকে অবশ্যই জড়তা ও লজ্জা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অথবা বসে থেকে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী হাত মাথার উপরে অথবা পাশে রেখে চিকিৎসককে পরীক্ষা কার্যে সহায়তা করতে হবে।

আল্ট্রাসনোগ্রাফি (USG of breast): এই পরীক্ষার মাধ্যমে অল্প খরচে এবং ব্যথাহীন ভাবে স্তনের অস্বাভাবিকতা ক্ষতিকারক টিউমার (Solid mass) জনিত নাকি নিরাপদ প্রকৃতির সিস্ট (Cyst) সে সম্পর্কে জানা যায়।

Mammogram: স্তনের যে কোনো ধরনের সমস্যা নির্ণয়ের সবচেয়ে অধিক ব্যবহৃত ও কার্যকরী উপায় হলো ম্যামোগ্রাম করানো। মহিলাদের ক্ষেত্রে ৪০ বছর বয়সের পর থেকে বছরে কমপক্ষে ১ বার ম্যামোগ্রাম করানোর নির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে। যার মাধ্যমে স্তনের সুস্থতা পর্যবেক্ষণ এবং কোনো অস্বাভাবিকতা (টিউমার, সিস্ট) হয়েছে কিনা তা প্রাথমিক পর্যায়েই জানা সম্ভবপর হয়।

MRI:যদিও এমআরআই (MRI) একটি ব্যয়বহুল পরীক্ষা তবে ক্ষেত্র বিশেষে ক্যান্সারের ধরন সঠিক ভাবে নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক গণ এই পরীক্ষা করানোর নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।

বায়োপসি: আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও ম্যামোগ্রাফিতে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়লে সেক্ষেত্রে চিকিৎসক বায়োপসি করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। কোন ধরনের স্তন ক্যান্সার হয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে স্তন থেকে সুচের মাধ্যমে টিস্যু (sample of tissue) নিয়ে ল্যাবরেটরিতে এই পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।

এছাড়াও স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা হিসেবে শল্যচিকিৎসা (Surgery) নেওয়ার পূর্বে কিছু পরীক্ষা (Routine test) করানোর প্রয়োজন হয়ে থাকে।
যেমন: রক্ত পরীক্ষা (CBC for Complete blood count), ডায়াবেটিস টেস্ট করা, বুকের X-ray, ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ECG) ইত্যাদি।

 

স্তন ক্যান্সারের পর্যায় সমূহ (Stages of breast cancer)

টিউমারের আকৃতি ও ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতার উপর ভিত্তি করে স্তন ক্যান্সারের পাঁচটি পর্যায় (Stages) রয়েছে। ক্যান্সারের পর্যায় সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি কারণ পর্যায়ের উপর নির্ভর করে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভিন্নতর হয়ে থাকে। নিচে স্তন ক্যান্সারের পর্যায় সমূহ তুলে ধরা হলো:

শূন্য পর্যায় (Stage 0): এই পর্যায়ে ক্যান্সার শুধুমাত্র আক্রান্ত নালীতে (Ducts) সীমাবদ্ধ থাকে। আশেপাশের টিস্যু গুলোতে ছড়িয়ে পড়ে না।

 এক (Stage 1): টিউমারের আকার ২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হলে তা প্রথম পর্যায়ের স্তন ক্যান্সার বলে বিবেচিত হয়।

 দুই (Stage 2): এই পর্যায়ে টিউমার আশেপাশের লিম্ফ নোড (Lymph) গুলোতে ছড়িয়ে পড়ে অথবা টিউমারের আকার ২-৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

 তিন (Stage 3): টিউমারের আকার ৫ সেন্টিমিটার অতিক্রম হলে তা তৃতীয় পর্যায়ের স্তন ক্যান্সার বলে বিবেচিত হয়।‌

 চার (Stage 4): এটি হলো ক্যান্সারের চূড়ান্ত পর্যায় (Advance Stages) যেখানে ক্যান্সার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে বিশেষত হাড়, ফুসফুস ও যকৃতে সংক্রমণ ঘটে।

 

বিভিন্ন স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা কি? What is the treatment for different breast cancers?

পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত করা গেলে যত দ্রুত সম্ভব যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ চিকিৎসা গ্রহণ করা না হলে সময়ের সাথে সাথে ক্যান্সার পরবর্তী জটিলতর পর্যায়ের দিকে যেতে থাকে আর সেই সাথে চিকিৎসায় সফলতার সম্ভাবনা কমতে থাকে। স্তন ক্যান্সারের কার্যকরী চিকিৎসা সমূহ সম্পর্কে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

সার্জারিঃ স্তন ক্যান্সারের প্রধান চিকিৎসা হলো সার্জারির (Surgery) মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ অপসারণ করা।‌ ক্যান্সারের পর্যায় অনুযায়ী স্তনের কতটুকু অংশ অপসারণ করতে হবে তার উপর ভিত্তি করে সার্জারি বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন:

  • Lumpectomy: Ectomy একটি মেডিকেল টার্ম যা দ্বারা বোঝানো হয় শরীরের কোনো অংশ সার্জারির মাধ্যমে অপসারণ করা। প্রাথমিক পর্যায়ের স্তন ক্যান্সারে যখন স্তনের মধ্যে ছোট টিউমার (Lump) থাকে ‌তখন সার্জারির মাধ্যমে শুধু সেই টিউমার অংশ টুকু অপসারণ করা হয়ে থাকে। শুধুমাত্র Lumb অপসারণ করা হয় বলে এই পদ্ধতিকে Lumpectomy বলা হয়।
  • Mastectomy: Mast হলো স্তনের মেডিকেল টার্ম অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে স্তন অপসারণ করা হয়ে থাকে। যখন পুরো ‌স্তনে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে সেই পর্যায়ে সার্জারির মাধ্যমে স্তন ও স্তনের সাথে সংযুক্ত লিম্ফ নোড (Lymph nodes) গুলো অপসারণ করার প্রয়োজন পড়ে।

লিম্ফ নোড অপসারণ: স্তনের সাথে অনেক গুলো লিম্ফ নোড সংযুক্ত থাকে যার মাধ্যমে খুব সহজেই সারা শরীরে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর তাই অনেক সময় চিকিৎসক ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার এমন সম্ভাবনা এড়াতে সার্জারির মাধ্যমে লিম্ফ নোড অপসারণ করে থাকেন।

Reconstruction: এই পদ্ধতিতে সার্জারি করার মাধ্যমে স্তনকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক আকারে ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করা হয়। শরীরের অন্য কোনো অংশ থেকে টিস্যু নিয়ে স্তনে জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে অথবা Breast implants পদ্ধতিতে স্তনের স্বাভাবিক আকার ফিরে পাওয়া সম্ভবপর হয়। এটি ক্যান্সারের চিকিৎসা হিসেবে নয়, বরং সার্জারি পরবর্তীতে সৌন্দর্য রক্ষায় এর প্রয়োজন পড়ে।

রেডিয়েশন থেরাপি: স্তন ক্যান্সার চিকিৎসায় সার্জারির ১ মাস পর রেডিয়েশন থেরাপি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। যা সার্জারি পরবর্তীতে কোনো ক্যান্সার কোষ কলা অবশিষ্ট থাকলে তা ধ্বংস করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

কেমোথেরাপি: সার্জারি করার পরে চিকিৎসক রোগীর বংশগত ইতিহাস ও অন্যান্য লক্ষণাবলী বিচারে যদি মনে করেন পুনরায় ক্যান্সার সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি রয়েছে তবে সে ক্ষেত্রে কেমোথেরাপির নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।

হরমোন থেরাপি: স্তন ক্যান্সারের কারণ হিসেবে হরমোন সংক্রান্ত সমস্যা থাকলে সে ক্ষেত্রে হরমোন থেরাপির মাধ্যমে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হয়। এছাড়াও যখন ক্যান্সার অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ে অর্থাৎ যে ক্ষেত্রে সার্জারি, রেডিয়েশন থেরাপি অথবা কেমোথেরাপি নেওয়ার মতো পরিস্থিতি না থাকে সেই ক্ষেত্রে হরমোন থেরাপি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।

ওষুধ: কিছু কিছু ওষুধ রয়েছে যা ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হয়। যেমন:

  • Trastuzumab
  • Lapatinib
  • Bevacizumab

উল্লেখ্য স্তন ‌ক্যান্সার সহ অন্যান্য প্রায় সব ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসায় নানাবিধ জটিলতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে।
আর তাই চিকিৎসা গ্রহণের পূর্বে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সাথে এই ব্যাপারে পরামর্শ করে তবেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।

স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসার জটিলতা কি? What are the complications of breast cancer treatment in Bengali?

স্তন ক্যান্সার চিকিৎসায় যে সমস্ত জটিলতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় তা হলো:

  • সার্জারি,‌ রেডিয়েশন থেরাপি ও কেমোথেরাপির ফলে ক্যান্সার কোষের সাথে সাথে শরীরের কিছু স্বাভাবিক কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়
  • কেমোথেরাপির ফলে মাথার চুল পড়া, রক্তস্বল্পতা, ক্ষুধা কমে যাওয়া ও ঘুমের সমস্যা হয়ে থাকে
  • হরমোন থেরাপির ফলে যৌন স্বাস্থ্য ও সন্তান ধারণের সক্ষমতা নষ্ট হয়
  • সার্বিক ভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়
  • এছাড়াও স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসায় সার্জারির মাধ্যমে স্তনের অংশ বিশেষ বা পুরো স্তন অপসারণ করা হলে সে ক্ষেত্রে বিরাট সৌন্দর্যহানি হয়ে থাকে

What are the risk factors for breast cancer

স্তন ক্যান্সার কিভাবে প্রতিরোধ করবেন? How to prevent breast cancer in Bengali?

স্তন ক্যান্সার একটি জটিলতর ব্যাধি যার চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এতে রয়েছে নানাবিধ জটিলতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
সবচেয়ে নিরাপদ, সহজ ও সুবিধাজনক বিষয় হলো স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করা। এই পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধের কিছু কার্যকরী উপায় সমূহ নিয়ে আলোচনা করা হলো:

১। খাবারের মধ্যে যেমন শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান রয়েছে তেমনি রয়েছে কিছু বিশেষ উপকারী উপাদান যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। গবেষণায় দেখা গেছে স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে কিছু কিছু খাবার বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন:

  • সবুজ শাকসবজি
  • মাছ (এতে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড)
  • কমলা লেবু ও আঙ্গুর ফল
  • স্ট্রবেরি ও কালো জাম
  • দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
  • আদা, পেঁয়াজ ও রসুন
  • আপেল ও পেয়ারা
  • বাদাম, ডাল ও শিমের বিচি ইত্যাদি

২। মদ্যপানের অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে যে অধিক মাত্রায় মদ্যপানের অভ্যাস স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

৩। ফাস্টফুড, অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার ও প্রক্রিয়াজাত খাবার হৃদরোগ, স্থূলতা (Obesity) ও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আর তাই এই সমস্ত খাবার গুলো পরিহার করতে হবে।

৪। শর্করা ও চিনি জাতীয় খাবার কম পরিমাণে খেতে হবে। কারণ অধিক মাত্রায় শর্করা ও চিনি জাতীয় খাবার গ্রহণ করা স্তন ক্যান্সারের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

৫। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে দিন ব্যায়াম করতে হবে। ব্যায়ামের ফলে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায়।

৬। অনেকেই বগলের ঘাম দূর করতে একধরনের স্প্রে (Antiperspirant) ব্যবহার করে থাকেন যা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। আর তাই এই ধরনের প্রসাধনী ব্যবহার করা উচিত নয়।

৭। সঠিক মাপের ব্রা (Bra) ব্যবহার করতে হবে। টাইট ব্রা পড়লে তা স্তনের রক্তচলাচলে বিঘ্ন ঘটায় যা একসময়ে স্তন ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।

৮। প্রতি মাসে কমপক্ষে একবার করে নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা (Breast self-examination) করতে হবে। যদি স্তনে কোনো অস্বাভাবিক চাকা, ফোলাভাব ও নিপলের সমস্যা দেখা দেয় তবে সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের জন্য বছরে অন্তত একবার করে ম্যামোগ্রাম (Mammogram) করানো উচিত।

 

বাংলাদেশ স্তন ক্যান্সার চিকিৎসার খরচ কত? what is the cost of breast cancer treatment in Bangladesh?

বাংলাদেশে নারীদের সবচেয়ে বেশি স্তন ক্যান্সার হয়ে থাকে যার কারণ হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব ও লজ্জা। এছাড়াও এই ব্যাপারে সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো আমাদের দেশে অধিকাংশ নারী তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ের স্তন ক্যান্সার নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।

এই পর্যায়ে চিকিৎসার মাধ্যমে খুব বেশি ভালো ফলাফল আশা করা যায় না। অথচ স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকলে রোগের উপসর্গ দেখা দেওয়া মাত্রই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসার মাধ্যমে সফলতা লাভ করা যায়।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে উন্নত হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (NICRH) সহ দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল গুলোতে স্তন ক্যান্সারের পরীক্ষা নিরীক্ষা‌ সহ প্রায় সব ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে।

এছাড়াও ক্যান্সার চিকিৎসায় উন্নত সেবার প্রত্যয় নিয়ে রয়েছে কতিপয় বেসরকারি হাসপাতাল যা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে চলেছে। যে সমস্ত বেসরকারি হাসপাতাল গুলোতে বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানের ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো:

 

বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সার চিকিৎসায় খরচ কেমন এর উত্তর নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের উপর। যেমন: ক্যান্সারের ধরন, পর্যায় ও চিকিৎসা পদ্ধতি। হাসপাতাল ভেদে খরচের তারতম্য হয়ে থাকে তবে সরকারি হাসপাতাল‌ গুলোতে তুলনামূলক কম খরচে চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায়।

স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্তন ক্যান্সারের সংক্রমণ অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভবপর হবে। স্তন ক্যান্সার সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সারা বিশ্বে প্রতি বছরের অক্টোবর মাসকে স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। আসুন জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকি এড়াতে আমরা নিজেরা সচেতন হই এবং অপরকে সচেতন হতে সহায়তা করি।

Last Updated on April 15, 2023