জন্ম নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী পদ্ধতি হিসেবে পিল খাওয়া বেছে নেন অনেক মহিলা। তবে পিল কিভাবে কাজ করে, পিল কত প্রকারের হয়ে থাকে এবং কার জন্য কোন ধরনের পিল খাওয়া উচিত নয় সেটা হয়তো অনেকেই জানেন না। এই অনুচ্ছেদে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিলের প্রকারভেদ, পিল কিভাবে শরীরের ভেতরে কাজ করে, পিল খাওয়ার সুবিধা ও অসুবিধা সহ পিল খাওয়ার নিয়ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও পিল খাওয়া মিস হলে কি করা উচিত, জন্ম নিয়ন্ত্রণের পিল যৌন বাহিত রোগ প্রতিরোধ করতে পারে কিনা এবং পিলের বিকল্প জন্ম নিয়ন্ত্রণের আর কি কি পদ্ধতি রয়েছে সেসব বিষয়ে জানতে হলে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

জন্ম নিয়ন্ত্রণ কি?

নারী পুরুষের যৌন সঙ্গমের ফলে পুরুষের বীর্যে থাকা শুক্রাণু নারীর ওভারি থেকে নিঃসৃত হওয়া ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়ে গর্ভধারণ হয়ে থাকে। কোনো দম্পতি যদি বাচ্চা নিতে না চান তবে সেক্ষেত্রে যৌন সঙ্গমের ফলে যেন শুক্রাণুর সাথে ডিম্বাণু মিলিত হতে না পারে তথা গর্ভধারণ না হয় সেজন্য প্রতিরোধ মূলক যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাকে জন্ম নিয়ন্ত্রণ বলা হয়। আগেকার দিনে মানুষ জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক পদ্ধতি (আজল, নিরাপদ দিনে যৌন সঙ্গম করা ইত্যাদি) অবলম্বন করতো। তবে বর্তমানে জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য নানাবিধ কৃত্রিম পদ্ধতি আবিস্কার হয়েছে যেগুলো পালন করা সহজ এবং প্রাকৃতিক পদ্ধতির তুলনায় অনেক বেশি কার্যকরী।

জন্ম নিয়ন্ত্রণের পিল কি?

জন্ম নিয়ন্ত্রণের কৃত্রিম পদ্ধতি গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো পিল খাওয়া।

নারীর শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন নামক দুইটি হরমোন রয়েছে যা পিরিয়ড ও ডিম্ব নিঃসরণ সহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রাখে।

জন্ম নিয়ন্ত্রণের পিল হলো নারীর শরীরে থাকা হরমোনের সদৃশ কৃত্রিম হরমোন যা গর্ভধারণ প্রতিরোধ করে থাকে।

জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল কিভাবে কাজ করে?

একজন নারীর শরীরে গর্ভধারণ প্রতিরোধে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল ৩ ভাবে কাজ করে থাকে। যথাঃ (cleveland clinic, 21)

  • ওভারি থেকে ডিম্ব নিঃসরণে বাধা দেয় (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ)
  • জরায়ুর মুখে (Cervix) প্রচুর পরিমাণে মিউকাস মেমব্রেন জমা করে যা শুক্রাণুকে ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য ফ্যালোপিয়ান টিউবে পৌঁছতে দেয় না
  • জরায়ুর গায়ে নিষিক্ত ডিম্বাণু লেগে গর্ভধারণ হওয়া প্রতিরোধ করে

জন্ম নিয়ন্ত্রণের পিল কতটা কার্যকর?

গর্ভধারণ প্রতিরোধ করার জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল ৯৯ শতাংশ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এর জন্য যথাযথ নিয়ম মেনে পিল খাওয়া জরুরী।

পিল খেতে ভুলে যাওয়া, যথাসময়ে পিল না খাওয়া ইত্যাদি কারণে পিলের কার্যকারীতা কমে যায়। (cleveland clinic, 21)

জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল কত প্রকার?

জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথাঃ (mayo clinic, 2022)

  • কম্বিনেশন পিল: যার মধ্যে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টিন হরমোন থাকে।
  • মিনিপিল: শুধু প্রোজেস্টিন হরমোন দিয়ে তৈরি পিল।

মিনিপিলের তুলনায় কম্বিনেশন পিল বেশি কার্যকরী। তবে কতিপয় নারীদের জন্য কম্বিনেশন পিল না খেয়ে বরং মিনিপিল খাওয়ার ব্যাপারে চিকিৎসকেরা উৎসাহিত করে থাকেন। যেমনঃ

  • ৩৫ বছরের বেশি বয়সী নারী এবং যাদের ধুমপানের অভ্যাস রয়েছে
  • বাচ্চা প্রসব করেছেন এবং শিশুকে বুকের দুধ পান‌ করান এমন মহিলা
  • হার্টের রোগ ও স্ট্রোকের ইতিহাস অথবা অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের রোগী

আবার ব্রেস্ট ক্যান্সার, লিভার ডিজিজ বা জরায়ু থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয় এমন মহিলাদের জন্য মিনিপিল খাওয়া উচিত নয়। মোট কথা শারীরিক জটিল কোনো সমস্যা থাকলে তাদের জন্য কোন ধরনের পিল খেতে হবে সেই বিষয়ে চিকিৎসকের কাছে থেকে ভালোভাবে জেনে নিতে হবে।

পিল খাওয়ার নিয়ম

পিল খাওয়ার কিছু সাধারণ নিয়ম হলো প্রতিদিন ১ টি করে পিল খেতে হবে এবং একই সময়ে পিল খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। এছাড়াও আপনি কোন ধরনের পিল কিনেছেন তার উপর ভিত্তি করে খাওয়ার নিয়ম ভিন্নতর হয়ে থাকে। যেমনঃ

  • এক পাতায় ২১ টি পিল থাকলে সেক্ষেত্রে প্রতিদিন ১ টি করে খেতে হবে এবং ২৮ দিনের মাসিক চক্রে পিরিয়ডের ৭ দিন পিল খাওয়া‌ বন্ধ থাকবে।
  • ২৮ টি পিল থাকা পাতার ক্ষেত্রে ২১ টি থাকে হরমোন যুক্ত পিল আর বাকি ৭ টি ইনেকটিভ পিল‌ থাকে। এই ৭ টি পিল পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে খাওয়ার জন্য দেওয়া হয়। 
  • এছাড়াও ৮৪ টি পিল সম্বলিত বক্স পাওয়া যায় যেগুলো একটানা ৩ মাস খাওয়ার পর ৭ দিনের বিরতি দেওয়া হয়।‌ এক্ষেত্রে ৩ মাস পর পর পিরিয়ড অর্থাৎ বছরে মাত্র ৪ বার পিরিয়ড হয়ে থাকে। 

কত তাড়াতাড়ি পিল কাজ করে?

পিল খাওয়া‌ যেদিন থেকে শুরু করবেন সেদিন থেকেই আপনার জন্য যৌন সঙ্গম করার ফলে গর্ভধারণ হবে না বিষয়টি এমন নয়। বরং পিল গ্রহণের পর গর্ভধারণ প্রতিরোধে কার্যকর হতে ৭ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। এই কয়েকদিনের জন্য আপাতত কনডম ব্যবহার করা যেতে পারে।

পিল মিস করলে কি করা উচিত?

প্রতিদিন একই সময়ে পিল খেতে হবে কিন্তু আপনি যদি সঠিক সময়ে পিল খেতে ভুলে যান সেক্ষেত্রে মনে হওয়ার সাথে সাথে পিল খেয়ে নিতে হবে। যদি ভুলে যাওয়ার পরের দিন মনে পড়ে তবে সেই দিন আর আগের দিনের টা সহ দুইটা পিল খেয়ে নিতে হবে।

একটানা কয়েকদিন পর্যন্ত পিল খাওয়া ভুলে গেলে অথবা কোনো কারণবশত কয়েকদিন পিল খেতে না পারলে সেক্ষেত্রে পরবর্তী পিরিয়ড না হওয়া পর্যন্ত যৌন সঙ্গম করা থেকে বিরত থাকতে হবে অথবা এই সময়ের জন্য কনডম ব্যবহার করতে হবে। আর যদি এই সময়ের মধ্যে কনডম ব্যবহার না করে যৌন সঙ্গম করে ফেলেন তবে সেক্ষেত্রে একজন গাইনী ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিল খাওয়া যেতে পারে।‌

পিল গ্রহণের সুবিধা কি?

অধিকাংশ মহিলা জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য পিল খেতে পছন্দ করেন। কারণ এটি গ্রহণ করা একদম সহজ, অনেক বেশি কার্যকরী এবং যেকোনো মুহূর্তে পিল বাদ দিয়ে বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা করা যায়। এছাড়াও জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিলের আরো কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমনঃ

  • পিরিয়ডের ব্যথা কমায়
  • কম পরিমাণে রক্তক্ষরণ হয়
  • রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে সাহায্য করে
  • ওভারি, জরায়ু ও কোলন‌ ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে
  • ব্রণ হওয়ার প্রবণতা কমায়
  • মাইগ্রেনের সমস্যা নিরাময় করে
  • এছাড়াও ওভারি ও জরায়ু রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়

পিল খাওয়ার কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি?

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পিল‌ খাওয়ার ফলে তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। তবে পিল গ্রহণ করার শুরুর দিকে কিছু সমস্যা দেখা যেতে পারে।‌ যেমনঃ

  • মাথাব্যথা
  • বমি বমি ভাব
  • অস্বাভাবিক পিরিয়ড হওয়া
  • স্তনে‌ ব্যথা অথবা ফুলে যাওয়া

পিল গ্রহণের কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে কি?

প্রজননক্ষম যেকোনো বয়সের নারীদের ক্ষেত্রে জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য পিল‌ গ্রহণ করা নিরাপদ এবং এতে কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে কতিপয় মহিলার ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ সহ রক্ত ও রক্তনালী সংক্রান্ত কিছু সমস্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।

পিল নেওয়ার সময় কি নির্দিষ্ট ওষুধ এড়ানো উচিত?

জন্ম নিয়ন্ত্রণের পিল খাওয়ার সময় অন্য কোনো ঔষধ এড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। তবে খিঁচুনি নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত ঔষধ সহ টিউবারকুলোসিসএইডস রোগের চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণের পিল গ্রহণ করলে পিলের কার্যকারীতা হ্রাস পায় এবং গর্ভধারণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

পিল কি যৌনবাহিত রোগ (STD) প্রতিরোধ করে?

যৌন বাহিত রোগ হলো সেই রোগ গুলো যা সাধারণত অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ফলে হয়ে থাকে।‌ যেমনঃ সিফিলিস, গনোরিয়া, ক্ল্যামিডিয়া, এইডস ইত্যাদি। জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য পিল খাওয়া বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারলেও যৌন বাহিত রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে পিল কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।

পিলের বিকল্প কি কি?

পিল খাওয়ার বিকল্প হিসেবে অনেকগুলো পদ্ধতি রয়েছে। তবে যৌন বাহিত রোগ প্রতিরোধের কথা বিবেচনায় একমাত্র পদ্ধতি হলো কনডম ব্যবহার করা। কনডম নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য রয়েছে তবে যেকোনো একজন কনডম ব্যবহার করলে দুইজনের জন্য যৌন বাহিত রোগ প্রতিরোধ হবে এবং সেই সাথে জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য মহিলাদের জন্য আরো যেসব পদ্ধতি রয়েছে সেগুলো হলো ‘কপার টি‘ ব্যবহার করা, ইমপ্লান্ট পদ্ধতি, যোনি রিং ইত্যাদি। এছাড়াও যেসব দম্পতি আর বাচ্চা নিতে চান‌ না‌ তাদের ক্ষেত্রে জন্ম নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি হিসেবে পুরুষের জন্য ভেসেকটমি এবং মহিলাদের জন্য টিউবেকটমি করা যেতে পারে। আপনার জন্য কোন পদ্ধতি গ্রহণ করা উত্তম হবে সেই ব্যাপারে নিজে নিজে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে একজন গাইনী ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

References

cleveland clinic. (21, July 2020). Birth Control: The Pill. Retrieved from cleveland clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/drugs/3977-birth-control-the-pill

mayo clinic. (2022, December 03). Choosing a birth control pill. Retrieved from mayo clinic: https://www.mayoclinic.org/healthy-lifestyle/birth-control/in-depth/best-birth-control-pill/art-20044807

Last Updated on April 13, 2023