মেন্সট্রুয়াল কাপ কি?

মেন্সট্রুয়াল কাপ (Menstrual cup) হলো মেডিকেল গ্রেড রাবার বা সিলিকন দিয়ে তৈরি ফানেল আকৃতির ছোট্ট কাপ যা মেয়েদের পিরিয়ডের সময় ট্যাম্পুন ও স্যানেটারি প্যাডের পরিবর্তে ব্যবহার করা যায়।‌ মেন্সট্রুয়াল কাপ পিরিয়ডের রক্ত প্যাডের মতো শুষে নেয় না বরং কাপের মধ্যে ধারণ করে রাখে।‌ আমাদের দেশে মেন্সট্রুয়াল কাপের ব্যবহার খুব বেশি জনপ্রিয় নয় কারণ এটির ব্যবহার ও সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও কুসংস্কার। এই অনুচ্ছেদে মেন্সট্রুয়াল কাপ‌ ব্যবহার করার নিয়ম ও সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

মেন্সট্রুয়াল কাপ কিভাবে ব্যবহার করে?

একজন নারীর বয়স কত, শারীরিক গঠন কেমন, বিবাহিত কিনা, পিরিয়ডের সময় কতটুকু রক্তক্ষরণ হয়, নরমাল ভাবে বাচ্চা প্রসব করার ইতিহাস রয়েছে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলোর সাথে কাপ ব্যবহারের সম্পর্ক রয়েছে। যেমনঃ কম বয়স্ক ও অবিবাহিত নারী যাদের শরীরের গঠন বেশ হালকা এবং মাসিকের সময় খুব বেশি পরিমাণে ব্লিডিং হয় না তাদের জন্য ছোট আকৃতির কাপ ব্যবহার করতে হবে। আবার ৩০ বছরের বেশি, বিবাহিত, সন্তান প্রসব করেছেন এবং যাদের মাসিকের সময় খুব বেশি পরিমাণে ব্লিডিং হয় এমন নারীদের জন্য তুলনামূলক একটু বড় সাইজের কাপ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। কাপের সাইজ সম্পর্কে নিজে নিজে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সেক্ষেত্রে একজন গাইনী ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। যা হোক, মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের জন্য কয়েকটি সহজ ধাপ অনুসরণ করতে হয় যা নিচে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হলো। (Scaccia, 2019)

মেন্সট্রুয়াল কাপ রাখার আগে করনীয়?

মেন্সট্রুয়াল কাপ যোনীতে প্রবেশ করানোর আগে নিজের দুই হাত খুব ভালো ভাবে ধুয়ে নিতে হবে। কেননা হাতের সাথে ময়লা ও রোগজীবাণু থাকলে কাপের গায়ে লেগে যেতে পারে। আর কাপ যেহেতু যোনীর ভেতরে প্রবেশ করিয়ে রাখা হয় আর তাই কাপে জীবাণু লেগে থাকলে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

মেন্সট্রুয়াল কাপ যোনীতে প্রবেশের সময় ব্যথা ও ঘর্ষণ এড়াতে কাপের গায়ে সামান্য পরিমাণ নারিকেল তেল অথবা অলিভ অয়েল মেখে নিলে কাপ পিচ্ছিল হয় এবং সহজে ভেতরে প্রবেশ করানো যায়। তেল ব্যবহারের ফলে কাপের জীবনকাল কমে যেতে পারে আর তাই তেলের পরিবর্তে ‘ওয়াটার বেসড লুব্রিকেন্ট’ ব্যবহার করতে পারেন যা বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ড নামে কিনতে পাওয়া যায়।‌

মেন্সট্রুয়াল কাপ কীভাবে রাখবেন?

মেন্সট্রুয়াল কাপ রাখার জন্য বসে অথবা দাঁড়িয়ে যেরকম পজিশন আপনার জন্য সুবিধাজনক মনে হয় সেভাবেই চেষ্টা করুন। জীবনে প্রথমবার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছুটা ভয় লাগতে পারে তবে এক্ষেত্রে মনে সাহস জোগাতে হবে।‌ কেননা এটি জটিল কোনো কাজ নয় এবং শরীরের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না।

প্রথমে কাপের খোলা মুখটি উপরের দিকে রেখে ‘C’ এর মতো ভাজ করে নিতে হবে। অতঃপর একহাতে যোনীর একপাশে টেনে ধরে অন্য হাত দিয়ে কাপটি ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে।‌ ভেতরে ঢোকার পর কাপের ভাজ খুলে গিয়ে ছাতার মতো ছড়িয়ে থাকবে। কাপটি ভেতরে ঢোকার পর একটু ঘুরিয়ে নিলে বায়ু নিশ্ছিদ্র ভাবে আটকে যাবে যার ফলে পিরিয়ডের রক্ত বাইরে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাবে না বরং কাপের মধ্যে জমা হতে থাকবে।‌ যোনীপথ শরীরের সাথে ৪৫ ডিগ্রি কোণে থাকে আর তাই শরীরের সাপেক্ষে কাপটি ৪৫ ডিগ্রি কোণেই অবস্থান করবে। এমতাবস্থায় শুয়ে থাকা, বসে থাকা, হাঁটাহাঁটি সহ যেকোনো কাজ করা যাবে এবং তাতে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হবে না।

কখন মেন্সট্রুয়াল কাপ বের করবেন?

একটি মেন্সট্রুয়াল কাপের ধারণ ক্ষমতা সর্বনিম্ন ২০ মিলিলিটার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ মিলিলিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। অপরদিকে পিরিয়ডের সময় প্রতিদিন একজন নারীর ১০ থেকে ১৫ মিলিলিটার রক্তক্ষরণ হয়। তবে পিরিয়ডের প্রথম ২ দিন একটু বেশি রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। যা হোক, একবার কাপ ঢুকানোর পর ৬ ঘন্টা থেকে সর্বোচ্চ ১২ ঘন্টা পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। অর্থাৎ সারাদিনের জন্য নিশ্চিন্তে কাজকর্ম করা যাবে এবং দিন‌ শেষে কাপ বের করতে হবে।

কিভাবে মেন্সট্রুয়াল কাপ বের করবেন?

মেন্সট্রুয়াল কাপ বের করার জন্য প্রথমে হাত ধুয়ে নিতে হবে। অতঃপর তর্জনী ও বৃদ্ধ আঙ্গুলী যোনীর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দুই আঙ্গুল দিয়ে কাপের নিচের দিকে চাপ দিয়ে ধরে বের করতে হবে। কাপ বের করার পর জমা হওয়া রক্ত টয়লেটে ফেলে দিয়ে কাপটি ভালভাবে ধুয়ে পুনরায় আবার ব্যবহার করতে হবে। সাধারণত মেন্সট্রুয়াল কাপগুলো পুনরায় ব্যবহারযোগ্য হয়ে থাকে আর তাই পিরিয়ড শেষ হয়ে গেলে ফুটানো গরম পানি দিয়ে কাপ ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে। অতঃপর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে শুস্ক জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।‌

মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করার সুবিধা কি কি?

মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের কতিপয় সুবিধা রয়েছে যা নিচে বর্ণনা করা হলোঃ

১। মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো একটি কাপ অনেকদিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। প্রায় ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত যা একাধারে খরচের দিক দিয়ে বেশ সুবিধাজনক। এছাড়াও পরিবেশগত দিক বিবেচনায় খুব উপযোগী কারণ অধিকাংশ স্যানিটারি প্যাড পরিবেশ বান্ধব নয় বরং মাটি দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে যা পরিবেশ ও গাছপালার জন্য ক্ষতিকর। পক্ষান্তরে ১ টি মেন্সট্রুয়াল কাপ অনেকদিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যায় বলে পরিবেশের জন্য তেমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে না।

২। স্যানিটারি প্যাড ও ট্যাম্পুন ঘন ঘন পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ে কিন্তু মেন্সট্রুয়াল প্যাড বার বার পরিবর্তনের ঝামেলা নেই। যত বেশি রক্তক্ষরণ হোক না কেন দিন রাত‌ মিলিয়ে ২ বার পরিবর্তন করাই যথেষ্ট। বিশেষ করে যাদের পিরিয়ডের সময় তুলনামূলক একটু বেশি রক্তক্ষরণ হয় তাদের জন্য মেন্সট্রুয়াল কাপ খুব উপযোগী হবে। এছাড়াও যেসব নারী দিনের বেলা দীর্ঘসময় ধরে বাইরে থাকেন তাদের জন্য প্যাড পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে না। এমন‌ নারীদের জন্য স্যানিটারি প্যাড ও ট্যাম্পুনের পরিবর্তে মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা বেশ সুবিধাজনক হবে।‌

৩। স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করার ক্ষেত্রে রক্ত দ্বারা প্যাড ভিজে যায় যেখানে সহজেই ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটতে পারে। আর সংক্রমণের ফলে যৌনাঙ্গের উপরিভাগে র‍্যাশ (Rash) ও চুলকানি হয়ে থাকে যা খুবই যন্ত্রণাদায়ক একটি সমস্যা। অপরদিকে মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করলে সেক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করার অসুবিধা কি কি?

মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা সাশ্রয়ী ও পরিবেশ বান্ধব। তবে ‌এর পাশাপাশি কিছু অসুবিধা রয়েছে কাপ ব্যবহার করার যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ

১। প্রতিবার কাপ ঢুকানো ও বের করা ব্যাপারটি অনেকের কাছে ভালো লাগে না। আবার এই কাজের জন্য বার বার হাত ধুয়ে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কাপ এবং হাত ভালোভাবে ধুয়ে না নিলে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

২। কাপ যোনীর ভেতরে সঠিকভাবে ফিট করে রাখার জন্য যতটুকু দক্ষতা দরকার তা সবার থাকে না। অনেকেই এই কাজটি ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারেন না যার ফলস্বরূপ রক্তক্ষরণ হলে তা‌ বাইরে বেরিয়ে আসে এবং কাপড়ে লেগে যায়।

৩। যোনীর ভেতর একটি বহিরাগত বস্তু ঢুকিয়ে রাখার দরুন অস্বস্তিবোধ হতে পারে। তবে কিছুদিন মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করার পর অভ্যস্ত হয়ে গেলে তখন এই অস্বস্তিবোধ তেমন একটা থাকে না।

৪। অনেকের ক্ষেত্রে রাবার বা সিলিকন দিয়ে তৈরি মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের ফলে এলার্জিক রিয়েকশন সৃষ্টি হয়ে থাকে। এলার্জিক রিয়েকশন‌ হলে তাদের জন্য মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা‌ থেকে বিরত থাকতে হবে।

তবে মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের ফলে প্রস্রাব ও মলত্যাগের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয় না। এছাড়াও অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা অথবা যোনীর পেশী শিথিল হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর তাই মনের মধ্যে অহেতুক ভয় ও কুসংস্কার পুষে রাখার কোনো যুক্তি নেই।

মেন্সট্রুয়াল কাপ এর দাম

মেন্সট্রুয়াল কাপ এর দাম বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও গুণগত মান‌‌ভেদে ভিন্নতর হয়ে থাকে। তবে সাধারণত ১ থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যে ভালো মানের মেন্সট্রুয়াল কাপ কিনতে পাওয়া যায়। যেহেতু একটি কাপ সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা‌ যায় সেহেতু একটি কাপের দাম এতো বেশি মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে কাপ ব্যবহার করা বেশ সাশ্রয়ী হবে। তুলনা করার জন্য যদি প্যাডের কথা ধরা যায় সেক্ষেত্রে এক প্যাকেট প্যাডের নূন্যতম দাম ৬০ টাকা যা প্রতিবার পিরিয়ডের জন্য লাগবে। সেই‌ হিসেবে বছরে ৭২০ টাকা এবং ১০ বছরে ৭ হাজার টাকার বেশি।‌ যা হোক, শুধু দামের বিষয়টি বিবেচনা না‌ করে সামগ্রিক সুবিধা অসুবিধা চিন্তা করে কাপ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা অবিবাহিত মেয়েদের কাছে একটু অস্বস্তি দায়ক মনে হতে পারে তবে এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। সঠিক নিয়ম মেনে মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা সব দিক বিবেচনায় ভালো বলা যেতে পারে। তবে কারো ক্ষেত্রে জরায়ু বা যোনীতে কোনো সমস্যা থাকলে একজন গাইনী ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে কাপ ব্যবহারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

References

Scaccia, A. (2019, April 09). Everything You Need to Know About Using Menstrual Cups. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/womens-health/menstrual-cup

 

 

Last Updated on April 13, 2023