জাতিসংঘের এইচআইভি-এইডস বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইডস (UNAIDS) এর সর্বশেষ জরিপ ২০২১ অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ১৫ হাজার এইডস আক্রান্ত রোগী রয়েছে যা মোট জনসংখ্যার ০.১ শতাংশের কম।‌ কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, প্রায় ৪৫ শতাংশ রোগী জানেন না যে তারা এইডস রোগে আক্রান্ত। যার ফলে অজ্ঞাতসারেই এইডস ছড়িয়ে পড়ছে সুস্থদের মাঝে। (UNAIDS, n.d.) এই অনুচ্ছেদে এইচআইভি সংক্রমণ বা এইডস বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে।

এইডস রোগ কি?

এইডস (AIDS- Acquired Immune Deficiency Syndrome) হলো একটি ভাইরাস (এইচআইভি; HIV- Human immunodeficiency virus) ঘটিত রোগ। এই ভাইরাস দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিশেষ করে শ্বেত রক্ত কণিকাকে (CD4 cells) আক্রমণ করে। যার ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যাপক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং খুব সহজেই ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাস ইনফেকশন সহ টিবি রোগ ও ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। (World Health Organization, 2022)

এইডস রোগ কেন হয়? 

১৮০০ সালের শুরুর দিকে আফ্রিকায় শিম্পাঞ্জির দেহ থেকে সর্বপ্রথম মানুষের শরীরে এইডস রোগের জন্য দায়ী এইচআইভি ভাইরাস  প্রবেশ করে। ধারণা করা হয় যে, শিকারকৃত শিম্পাঞ্জির রক্ত মানুষের শরীরে প্রবেশের মাধ্যমে সংক্রমণ শুরু হয়। (US Centers for Disease Control and Prevention, 2022) অতঃপর, সংক্রমিত ব্যক্তির দ্বারা চারপাশের অন্যান্য মানুষজন আক্রান্ত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এইডস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত, বীর্য, স্ত্রী যৌনাঙ্গের রস (vaginal fluids) বুকের দুধ ইত্যাদি মাধ্যমে এই ভাইরাস অন্য সুস্থ ব্যক্তির দেহে ছড়িয়ে পড়ে। এইচআইভি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে চিহ্নিত বিষয়গুলো হলোঃ

  • অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক স্থাপন
  • পায়ুপথে যৌনসঙ্গম (Anal Sex)
  • মদ্যপান ও মাদক সেবন করা
  • একই সুচ সিরিঞ্জ একাধিক বার ব্যবহার করা
  • যৌন বাহিত রোগে (STDs) আক্রান্ত ব্যক্তি যেমনঃ সিফিলিস, গনোরিয়া, হার্পিস, ক্ল্যাম্যাইডিয়া
  • অপরিচিত ব্যক্তি বা নেশাগ্রস্ত মানুষের কাছ থেকে রক্ত নেওয়া
  • আক্রান্ত মায়ের দুধ পান করা

এইডস রোগের লক্ষণ 

এইডস রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে ফ্লু এর মতো লক্ষণ (flu-like symptoms) দেখা যায়। যেমনঃ

  • জ্বর ও শীতবোধ
  • মুখের ভেতর ঘা
  • গলাব্যথা (Sore throat)
  • গলার আশেপাশে লিম্ফনোড ফুলে যাওয়া
  • ত্বকে র‍্যাশ (Rash) দেখা যায়
  • মাংসপেশিতে ব্যথা
  • দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ

এইডস রোগের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষণের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে জ্বর, ঘন ঘন ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব, শারীরিক দুর্বলতা, শরীরের ওজন অস্বাভাবিক ভাবে কমতে থাকা, সহজেই রোগাক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি।

এইডস রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় কত মাসে? 

এইচআইভি ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পর লক্ষণ প্রকাশ পায় যা পরবর্তী কয়েক দিন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে শুরুর দিকে তেমন কোনো লক্ষণ নাও দেখা যেতে পারে। আবার কেউ কেউ হয়তোবা প্রাথমিক পর্যায়ের লক্ষণ বুঝতে পারেন না এবং রোগের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়ে যায়। আর এই পর্যায়ে সাধারণত তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশিত অবস্থায় থাকে না।

এইডস নির্ণয় 

শুধুমাত্র লক্ষণ দেখে এইডস নির্ণয় করা যায় না বরং নিশ্চিত হওয়ার জন্য একমাত্র উপায় হলো পরীক্ষা করানো। এইচআইভি ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশের পরবর্তী ২৮ দিনের মধ্যে এন্টিবডি তৈরি হয় যার উপস্থিতি নির্ণয়ের মাধ্যমে এই পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। তবে এইডস হয়েছে সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য শুধুমাত্র একবার পরীক্ষা করানো নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন ল্যাব থেকে ২/৩ টা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। কারণ, অনেক সময় কোনো একটা ত্রুটির ফলে ভুল ফলাফল চলে আসতে পারে আর যা দেখে অনেকেই ভেঙ্গে পড়তে পারেন।

এইডস রোগী কতদিন বাঁচে?

কোন প্রকার চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা না হলে একজন এইডস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত ৩ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেন। তবে আশার কথা হলো, বর্তমানে এইডস রোগের কার্যকরী চিকিৎসা রয়েছে যা একদম রোগ মুক্তি করতে সক্ষম না হলেও রোগীকে স্বাভাবিক ভাবে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। শরীরের মধ্যে এইচআইভি ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করার জন্য antiretroviral (ARV) ঔষধ গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় ১৮৯ টি দেশ এই ঔষধ গ্রহণের ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া নির্দেশনা গ্রহণ করেছে এবং আমাদের দেশে সরকারি ভাবে ফ্রিতে এইডস রোগের চিকিৎসা করা হয়। ARV ঔষধ গ্রহণ করা হলে তা রোগীকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করার পাশাপাশি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে দেয় না। অর্থাৎ, একজন এইডস রোগী যথাযথ ভাবে ARV ঔষধ গ্রহণ করলে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন এবং অন্যদের মাঝে এইচআইভি ছড়াবেন না।

এইডস রোগ প্রতিরোধের উপায়

এইডস রোগের কারণ তথা এইডস রোগ কিভাবে ছড়ায় সেই সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আবিষ্কৃত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে এইচআইভি সংক্রমণ সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমনঃ

  • অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক স্থাপন না করা
  • প্রয়োজনে কনডম ব্যবহার করা
  • একই সুচ‌ সিরিঞ্জ মাত্র একবার ব্যবহার করা
  • অপরিচিত মাধ্যমে রক্ত না নেওয়া
  • আক্রান্ত মায়ের বুকের দুধ শিশুকে না খাওয়ানো
  • এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য নিয়ম মেনে ARV ঔষধ গ্রহণ করা
  • মাদক সেবন না করা ইত্যাদি।
References

UNAIDS. (n.d.). Country factsheets. Retrieved from UNAIDS

US Centers for Disease Control and Prevention. (2022, June 30). HIV. Retrieved from CDC

World Health Organization. (2022, November 9). HIV. Retrieved from WHO

Last Updated on April 15, 2023