মহিলাদের শরীরের স্বাভাবিক গঠন অনুযায়ী জরায়ুর দুই পাশে দুইটি ওভারি থাকে যেখান থেকে হরমোন ও ডিম্ব নিঃসরণ হয়। ওভারিতে সিস্ট হলে তাকে ওভারিয়ান সিস্ট বলা হয় যার অনেক গুলো প্রকরণ রয়েছে। তবে এর মধ্যে কমন ও জটিলতর একটি হলো পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম বা PCOS (Polycystic ovary syndrome)। এই অনুচ্ছেদে PCOS এর কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম কি (PCOS meaning in bengali)  

ওভারিয়ান সিস্ট বলতে এই অনুচ্ছেদে PCOS বা পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমকে বোঝানো হয়েছে। পলি অর্থ অনেকগুলো আর সিস্ট মানে‌ হলো পানিপূর্ণ থলে অর্থাৎ ওভারিতে ছোট ছোট অনেকগুলো সিস্ট হলে তাকে PCOS বলা হয়।‌ তবে এক্ষেত্রে ওভারিতে সিস্ট ছাড়াও আরো যেসব বৈশিষ্ট্য থাকে তা হলোঃ (Watson, 2021)

  • নিয়মিত পিরিয়ড না হওয়া
  • শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকে

উল্লেখ্য, মহিলাদের শরীরের প্রধান যৌন হরমোন হলো ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন আর পুরুষের প্রধান যৌন হরমোন হলো টেস্টোস্টেরন। তবে এর পাশাপাশি পুরুষের শরীরে সামান্য পরিমাণে মহিলাদের যৌন হরমোন নিঃসরণ হয় আর তেমনিভাবে মহিলাদের শরীরে সামান্য পরিমাণ টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণ হয়।

ওভারিতে সিস্ট কেন হয়?

ওভারিতে সিস্ট কেন হয় তার প্রকৃত কারণ এখনো জানা‌ যায়নি।‌ তবে ধারণা করা হয় যে জিনগত‌ প্রভাব, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহের (Inflammation) ফলে মহিলাদের শরীরে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি পরিমাণে টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণ হয় আর যার প্রভাবে ওভারি থেকে স্বাভাবিক মাত্রায় ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোন সহ নিয়মিত ডিম্ব নিঃসরণে ব্যঘাত ঘটে।

সাধারণত ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সের নারীদের ক্ষেত্রে এই‌ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। তবে এর চেয়ে কম বা বেশি বয়সের নারীদের ক্ষেত্রে একদম সম্ভাবনা নেই তা নয়। এছাড়াও যাদের শরীরের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি এবং পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের বংশগত ইতিহাস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে।

পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) এর লক্ষণ

পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কমন যে লক্ষণগুলো দেখা যায় তা হলোঃ

১। অনিয়মিত পিরিয়ড হওয়া। যেমনঃ প্রতিমাসে নির্ধারিত সময়ে পিরিয়ড না‌ হয়ে বরং দেরিতে হওয়া, কোনো মাসে পিরিয়ড না হওয়া, সারা বছরে মাত্র ৮ বার‌ বা তারও কম সংখ্যক বার পিরিয়ড হওয়া ইত্যাদি।

২। পিরিয়ডের সময় স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়া (প্রতিবার পিরিয়ডে স্বাভাবিক নিয়মে ২০ থেকে ৮০ মিলি পর্যন্ত রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে)

৩। ওভারি থেকে ডিম্ব নিঃসরণ হলে তা শুক্রাণুর সাথে মিলিত হওয়ার মাধ্যমে গর্ভধারণ হয়ে থাকে। PCOS এর ক্ষেত্রে যেহেতু ঠিকমতো ডিম্ব নিঃসরণ হয় না আর‌‌ তাই বিবাহিত মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভধারণে বিঘ্ন ঘটতে দেখা যায়।

৪। অতিরিক্ত পরিমাণ পুরুষ হরমোনের প্রভাবে মুখে, হাতে ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অস্বাভাবিক ভাবে লোম বড় হতে থাকে। এছাড়াও মাথার চুলের সামনের দিকের বর্ডার লাইন ছেলেদের মতো হয় এবং মুখে অতিরিক্ত ব্রণ উঠতে দেখা যায়।

৫। পরিমিত খাবার গ্রহণ এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করা সত্ত্বেও শরীরের ওজন অস্বাভাবিক ভাবে বাড়তে থাকে।

৬। হরমোনের ভারসাম্যহীনতার ফলে ত্বক কালো হয়ে যায় এবং মাথাব্যথা হতে পারে।

পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) হলে কি করনীয়?

পিরিয়ডের সমস্যা, অস্বাভাবিক লোম গজানো, শরীরের ওজন বৃদ্ধি হওয়া এবং বিবাহিত মহিলাদের ক্ষেত্রে ১ বছর চেষ্টা করার পরেও বাচ্চা না হলে ধারণা করা যেতে পারে যে, ওভারিতে সিস্ট হয়েছে। এমতাবস্থায় করণীয় হলো একজন গাইনী ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে কতিপয় পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। PCOS এর জন্য সাধারণত নিম্নলিখিত পরীক্ষা গুলো করার নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। যেমনঃ

  • আলট্রাসনোগ্রাফি
  • শরীরে হরমোনের মাত্রা সম্পর্কে জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা
  • ডায়াবেটিস টেস্ট ইত্যাদি

পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) দূর করার উপায়

পরীক্ষার মাধ্যমে যদি PCOS নির্ণয় হয় তবে সেক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, ব্যায়াম করা‌ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ওভারিয়ান সিস্ট ট্রিটমেন্ট হিসেবে চিকিৎসকেরা প্রাথমিক ভাবে শরীরে হরমোনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য হরমোন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ে‌ থাকেন। এর পাশাপাশি শরীরের অবাঞ্ছিত লোম দূর করার জন্য ক্রিম ব্যবহার অথবা লেজার চিকিৎসা গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে শুধু ঔষধের সাহায্যে ভালো ফলাফল পাওয়া না গেলে সার্জারি করার প্রয়োজন পড়ে। এছাড়াও-

  • ডায়াবেটিস থাকলে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধ সেবনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
  • শরীরের ওজন কমানোর জন্য ডায়েট কন্ট্রোল করতে হবে‌‌। বিশেষ করে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার (ভাত, নুডুলস, বিস্কুট, রুটি ইত্যাদি) কম খেতে হবে।
  • নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।

পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম বা PCOS রোগটি প্রতিরোধের‌ তেমন কোনো কার্যকরী উপায় নেই বললেই চলে। কিছু ঘরোয়া উপায় অবলম্বন এবং বাছায়কৃত খাবার খাওয়ার মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এছাড়াও শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

আর সেই সাথে কারো ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে শুরুতে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করলে খুব ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

References

Watson, S. (2021, April 19). Polycystic Ovary Syndrome (PCOS): Symptoms, Causes, and Treatment. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/polycystic-ovary-disease

 

 

Last Updated on November 21, 2023