অতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলে শারীরিক, মানসিক ও আচরণগত বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যায়। যেমনঃ মাথাব্যথা, হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, ক্ষুধা কমে যাওয়া, যৌন সমস্যা, কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে না পারা, ক্রমাগত দুশ্চিন্তা, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হওয়া, খিটখিটে মেজাজ, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি। (National Health Service, UK, 2022)
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরী। এই অনুচ্ছেদে স্ট্রেস বা অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের ১০টি সহজ উপায় বর্ণনা করা হয়েছে।
Table of Contents
১। শরীরচর্চা
শারীরিক সুস্থতার জন্য যেমন নিয়মিত শরীরচর্চা বা ব্যায়াম করার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে তেমনিভাবে মানসিক সুস্থতা অর্জন তথা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যায়ামের গুরুত্ব অপরিসীম।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের ব্যায়াম করা উপকারী হবে। তবে ব্রিদিং এক্সারসাইজ (গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস), ইয়োগা, মেডিটেশন ইত্যাদি সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
মানসিক সুস্থতার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম (প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট সময়) করতে হবে।
২। স্বাস্থ্যকর খাদ্য
শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার ব্যাপারে খাবার মুখ্য ভূমিকা পালন করে। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে। যেমনঃ
- চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার যতটা সম্ভব পরিহার করতে হবে।
- প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ রয়েছে এমন খাবার খেতে হবে।
- শরীরের ভিটামিন ও মিনারেলের চাহিদা পূরণ করতে হবে।
- ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় যতটা সম্ভব বর্জন করতে হবে।
- খাবার তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল, শাকসবজি, বাদাম, মাছ, ডিম, ডাল ইত্যাদি রাখতে হবে।
ফাইবার সমৃদ্ধ ১৪টি খাবার সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
৩। ক্যাফেইন গ্রহণ কমিয়ে দিন
কাজের ফাঁকে ক্লান্তি দূর করার জন্য চা বা কফি পান করার বিষয়টি খুব কমন দেখা যায়। চা ও কফিতে থাকা ক্যাফেইন ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ করার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
কাজের চাপে খুব ক্লান্তি লাগলে অল্প একটু সময়ের জন্য কাজ বন্ধ রেখে হাঁটাহাঁটি বা বিশ্রাম করা উপকারী হবে। এছাড়াও দিনে ৩ থেকে ৪ কাপ গ্রিন টি পান করা যেতে পারে। কারণ গ্রিন টি হলো সবচেয়ে কম ক্যাফেইন সমৃদ্ধ চা এবং এতে প্রচুর পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্ট (Antioxidants) রয়েছে যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
গ্রিন টিতে চিনি মেশানো যাবে না। যাদের ঘুমের সমস্যা হয় তাদের জন্য সন্ধ্যার পর গ্রিন টি খাওয়া যাবে না।
৪। ফোন ব্যবহার কমাতে হবে
বর্তমান সময়ে মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ ছাড়া দিন কাটানো কল্পনা করা যায় না। এই ডিভাইসগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এগুলোর অতিরিক্ত ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, একটানা দীর্ঘসময় পর্যন্ত মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার করার ফলে মানসিক চাপ বেড়ে যায়। তাই মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপের ব্যবহার যেন অযাচিতভাবে বা অতিরিক্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। (Wade, 2022)
বিশেষ করে রাতে বিছানায় শুয়ে মোবাইল ব্যবহার করার ফলে ঘুমের সমস্যা হয় যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই রাতে বিছানায় শুয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যাবে না। বরং বিছানা থেকে মোবাইল দূর রাখতে পারলে ভালো।
৫। বন্ধু ও পরিবারের সাথে সময় কাটান
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো উপকারী হতে পারে। প্রায় সবার ক্ষেত্রেই জীবনের কোনো না কোনো সময় নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় যার জন্য মানসিক চাপ অনেক বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় পরিবারের সদস্য অথবা বন্ধুদের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমবে এবং সমস্যার সমাধান পাওয়া যেতে পারে।
৬। নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানুন
কোনো কাজের দায়িত্ব নেওয়ার পূর্বে সেই কাজ করার সক্ষমতা নিজের রয়েছে কিনা সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। একান্তই যদি কোনো কাজ করতে অপারগতা থাকে তবে সেই কাজের দায়িত্ব বিনয়ের সাথে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। নিজের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে জেনে সেই মোতাবেক দায়িত্ব নিতে হবে।
কোনো কাজ অনেক কঠিন বা কষ্টসাধ্য মনে হলে ছোট ছোট টার্গেটে ভাগ করে কাজ করতে হবে। এতে করে মানসিক চাপ কিছুটা কম অনুভূত হবে। ছোট ছোট গোল বা টার্গেট সেট করে কাজ করলে কাজের একেকটা মাইলস্টোন সম্পন্ন করার পর মানসিক প্রশান্তি আসবে এবং চাপমুক্ত মনে হবে।
৭। কাজে বিলম্ব এড়াতে শিখুন
যেকোনো কাজের ব্যাপারে সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সঠিক সময়ে কাজ সম্পন্ন করা উচিত। অহেতুক বিলম্ব করা ভালো নয়। এটিকে ইংরেজিতে Procrastination বলা হয় যা মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে।
কাজ যত বড় বা কঠিন হোক না কেন তা যদি বিলম্ব না করে সময় থাকতে শুরু করা যায় তবে তা মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয় না। পক্ষান্তরে যদি সময় ফুরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেও কাজ শেষ হতে না থাকে তবে শেষ পর্যায়ে প্রচুর মানসিক চাপের মধ্যে পড়তে হয়।
৮। প্রকৃতিতে সময় কাটান
অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও একঘেয়েমি দূর করার জন্য মাঝেমধ্যে সুযোগ বুঝে কাজ থেকে বিরতি নিয়ে প্রকৃতির মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে। একা একা অথবা পরিবার সহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা কোনো স্থানে ঘুরে আসতে পারলে মানসিক চাপ কমে যাবে এবং সেই সাথে পরবর্তীতে কাজের প্রতি উৎসাহ ও উদ্দীপনা বেড়ে যাবে।
৯। নেশা দ্রব্য গ্রহণ করা যাবে না
অনেকেই অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে পরিত্রাণের জন্য ধুমপান, মদ্যপান বা মাদকদ্রব্য গ্রহণ করেন যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। নেশা কখনো মানসিক চাপ থেকে বাঁচতে সাহায্য করতে পারে না বরং আরো জটিলতার সৃষ্টি করে। তাই মানসিক চাপের কোনো পর্যায়ে কখনোই নেশা করার কথা মনে স্থান দেওয়া যাবে না।
আবার অতিরিক্ত মানসিক চাপের দরুণ অনেক ছেলেমেয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেন। এই ধরনের কাজ (আত্মহত্যা করা) কখনো সমাধান হতে পারে না বরং নিজের জীবন ধ্বংস হয় এবং পরিবারের মানুষের জন্য সারাজীবন বিরাট কষ্ট বয়ে বেড়াতে হয়।
১০। সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রাখুন
জীবনে খারাপ সময়ে অবশ্যই সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা রাখতে হবে এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে যোগদান করা হলে তা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে। সকল ধর্মের মানুষের জন্য এই কথা সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।
দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকলে নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক রোগের সৃষ্টি হতে পারে। নিজে নিজে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম না হলে একজন সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হয়ে কাউন্সেলিং করাতে হবে।
শরীরের রোগের জন্য যেমন চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে তেমনিভাবে মন সম্পর্কিত যেকোনো সমস্যার সমাধানের জন্য সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হওয়ার ব্যাপারে কোনো সংকোচ বা অনীহা থাকলে চলবে না।
References
National Health Service, UK. (2022, November 22). Stress. Retrieved from NHS: https://www.nhs.uk/mental-health/feelings-symptoms-behaviours/feelings-and-symptoms/stress/
Wade, D. (2022, 1 20). 15 Simple Ways to Relieve Stress. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/16-ways-relieve-stress-anxiety
Last Updated on December 18, 2023
Leave A Comment