রক্তস্বল্পতা (Anemia) হলো রক্তের রোগ যার ফলে রক্তের লোহিত কণিকার পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায়। নানাবিধ কারণে রক্তস্বল্পতা হতে পারে যার মধ্যকার একটি হলো ফলিক অ্যাসিডের অভাব। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে ফলিক অ্যাসিডের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায় যার জন্য গর্ভস্থ শিশুর গঠনগত ত্রুটি হতে পারে। 

শরীরে ফলিক অ্যাসিডের অভাব হলে কি কি লক্ষণ দেখা যায়, কাদের ক্ষেত্রে ফলিক অ্যাসিডের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে, ফলিক অ্যাসিডের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

ফলিক এসিড কি? 

ফলিক অ্যাসিড (Folic acid) হলো ভিটামিন বি৯ বা ফোলেটের কৃত্রিম ধরন যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে লোহিত রক্ত কণিকা উৎপাদন, কোষ বিভাজন সহ কোষের DNA তৈরি ও মেরামতের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

লোহিত রক্ত কণিকা মূলত হাড়ের মজ্জায় (Bone marrow) উৎপাদন হয়। পরবর্তীতে এই রক্ত কণিকা পরিপক্ক হওয়ার ক্ষেত্রে ফলিক অ্যাসিডের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। শরীরে ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি থাকলে লোহিত রক্ত কণিকার গঠন ও সংখ্যার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা দেখা যায় তথা রক্তস্বল্পতার সৃষ্টি হয়। 

ফলিক অ্যাসিডের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতার কারণ কী? 

ফলিক অ্যাসিডের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা হওয়ার কারণ হলো দৈনিক চাহিদার চেয়ে কম পরিমাণে গ্রহণ করা অথবা শরীরে ভিটামিন শোষণ বিঘ্নিত হওয়া। 

সাধারণত ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার (শিম, মটরশুটি, বাঁধাকপি, পালংশাক, লেটুসপাতা, লেবু, কমলা, মাল্টা, আঙ্গুর, বাদাম, কলিজা, মাছ, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, গরুর মাংস, মুরগির মাংস, সামুদ্রিক খাবার ইত্যাদি) পর্যাপ্ত পরিমাণে না খাওয়ার ফলে রক্তস্বল্পতা হয়ে থাকে।  

আবার অনেকেই ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া সত্তেও শরীরে ঘাটতি রয়ে গেছে। এর কারণ হতে পারে অধিক সময় পর্যন্ত খাবার রান্না করা। কারণ তাপে ফলিক অ্যাসিড নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। আবার পরিপাকতন্ত্রের রোগের (সিলিয়াক ডিজিজ) কারণেও এমন হতে পারে। অর্থাৎ পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার খাওয়া হয় ঠিকই কিন্তু পরিপাকতন্ত্রের রোগের প্রভাবে অন্ত্রে (Intestine) ফলিক অ্যাসিড শোষণ ব্যাহত হয়। 

ফলিক অ্যাসিডের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতার ঝুঁকিতে কারা? 

Various Types of Fruits

যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে ফলিক অ্যাসিডের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা হতে পারে। তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই ধরনের সমস্যা হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। কারণ তাদের ক্ষেত্রে অন্ত্রে ফলিক অ্যাসিড শোষণের সক্ষমতা কমে যায়। এছাড়াও আরো যাদের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকি রয়েছে তা হলোঃ (Kahn, 2017)

  • গর্ভবতী নারী (গর্ভস্থ বাচ্চার সঠিক গঠন ও বৃদ্ধির জন্য চাহিদা বেড়ে যায় কিন্তু সেই অনুপাতে খাবার খাওয়া হয় না। আবার গর্ভাবস্থায় বমি হওয়ার প্রবণতা থাকে যার ফলে শরীর থেকে ফলিক অ্যাসিড বেরিয়ে যায়) 
  • স্তন্যদানকারী মা (সাধারণ মহিলার তুলনায় যারা শিশুকে বুকের দুধ পান করান তাদের ক্ষেত্রে চাহিদা বেশি থাকে)  
  • যাদের মদ্যপানের অভ্যাস রয়েছে (মদ্যপানের ফলে অন্ত্রে ফলিক অ্যাসিড শোষণ ব্যাহত হয়) 
  • পরিপাকতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি (রোগের ফলে অন্ত্রে ফলিক অ্যাসিড শোষণ ব্যাহত হয়) 

লক্ষণ ও উপসর্গ 

Man Suffering From Deficiency

শরীরে ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি খুব কম হলে সেক্ষেত্রে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে দীর্ঘদিন ধরে ঘাটতি থাকলে রক্তস্বল্পতার সৃষ্টি হয় যার লক্ষণ হিসেবে দেখা যায়- (Johns Hopkins Medicine)

  • দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ 
  • ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া 
  • মুখ ও জিহ্বায় ঘা হওয়া
  • ক্ষুধার অনুভূতি কমে যাওয়া 
  • খিটখিটে মেজাজ
  • ডায়রিয়া  

রক্তস্বল্পতার লক্ষণ দেখা দিলে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জন্য মোটেও বিলম্ব করা যাবে না।

কিভাবে ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি জনিত অ্যানিমিয়া নির্ণয় করা হয়? 

শরীরে ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি জনিত অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা নির্ণয়ের জন্য শারীরিক পর্যবেক্ষণের পর চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। যথাঃ 

CBC (Complete blood count) 

সহজলভ্য একটি রক্ত পরীক্ষার নাম হলো CBC যার মাধ্যমে রক্তে কোন কণিকা কত পরিমাণে আছে তা জানা যায়। স্বাভাবিকের চেয়ে কম পরিমাণে লোহিত রক্ত কণিকা থাকলে রক্তস্বল্পতা হয়েছে বলে নির্ধারণ করা হয়। এই পরীক্ষা করার জন্য স্যাম্পল হিসেবে শিরা থেকে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। 

Folic Acid Test 

CBC টেস্ট দ্বারা রক্তস্বল্পতা নির্ণয় করা যায় তবে ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি জনিত কিনা তা জানার জন্য Folic acid test করার প্রয়োজন পড়ে। এটি তুলনামূলক ব্যয়বহুল পরীক্ষা তবে জটিল কিছু নয়। স্যাম্পল হিসেবে শিরা থেকে রক্ত সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার মাধ্যমে রক্তে ফলিক অ্যাসিডের মাত্রা দেখা হয়। স্বাভাবিকের (প্রতি মিলিলিটার রক্তে ২.৭ থেকে ১৭ ন্যানোগ্রাম) চেয়ে কম মাত্রায় ফলিক অ্যাসিড থাকলে ফলিক অ্যাসিডের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা নির্ধারণ করা হয়।

Folic acid test করার ৬ ঘন্টা আগে থেকে প্রস্তুতি হিসেবে পানি, খাবার, ওষুধ ইত্যাদি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

ফলিক অ্যাসিডের অভাবজনিত অ্যানিমিয়া কীভাবে চিকিৎসা করা হয়?

ফলিক অ্যাসিডের অভাবজনিত অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতার চিকিৎসার উদ্দেশ্য থাকে রক্তে ফলিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধি করা। আর এর জন্য রয়েছে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট যা ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী সেবন করতে হবে। তবে কারো ক্ষেত্রে যদি পরিপাকতন্ত্রের কোনো রোগের দরুণ এই ধরনের অ্যানিমিয়া হয়ে থাকে তবে সেই রোগের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।  

সাধারণত প্রতিদিন ৫ মিলিগ্রাম মাত্রার ১টি ট্যাবলেট সেবন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। তবে তীব্র প্রকৃতির রক্তস্বল্পতার চিকিৎসার জন্য শিরায় ইনজেকশন দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট যেসব নামে পাওয়া যায় তা হলোঃ 

  • Folac®
  • Folate®
  • Folcid®
  • Folic acid®
  • Folic-son®
  • Folicare®
  • Folison®
  • Folus®
  • Refolic® 

ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট খুব সহজলভ্য একটি ওষুধ তবে চিকিৎসকের নির্দেশনা ব্যতীত সেবন করা যাবে না। কতদিন পর্যন্ত ওষুধ সেবন করতে হবে সেই ব্যাপারেও চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।  

ওষুধের পাশাপাশি ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবারগুলো বেশি বেশি খেতে হবে। আর কারো ক্ষেত্রে যদি মদ্যপানের অভ্যাস থাকে তবে তা অবশ্যই বর্জন করতে হবে।

যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে ফলিক অ্যাসিডের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা খুব দ্রুত ভালো হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগের জটিলতা হিসেবে তেমন কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয় না। তবে তাই বলে চিকিৎসা গ্রহণ না‌ করে অবহেলা করা যাবে না। 

Bibliography

Johns Hopkins Medicine. (n.d.). Folate-Deficiency Anemia. Retrieved from Johns Hopkins Medicine: https://www.hopkinsmedicine.org/health/conditions-and-diseases/folate-deficiency-anemia

Kahn, A. (2017, 09 29). Folic Acid Deficiency Anemia. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/folate-deficiency-anemia

Last Updated on October 31, 2023