সামনেই আসছে কাঠফাটা গরমের গ্রীষ্মকাল। এসময় অসহ্য গরমে ঘামের সাথে শরীর হারায় আর্দ্রতা, শিকার হতে হয় ডিহাইড্রেশনের। রোজা আসতেও দেরী নেই বেশি। সারা দিনের রোজার শেষে পিপাসা মেটানোর সাথে সারাদিনের সতেজতা ফিরিয়ে আনতে চাই এক গ্লাস সতেজ পানীয়। আবার কেউ যদি ডায়েট সচেতন হয়, তারও প্রয়োজন পানির পাশাপাশি ভিন্ন কোন পানীয়, যা শরীরে আদ্রতা ধরে রাখার পাশাপাশি হবে সুস্বাদু, কিন্তু বাড়াবে না ক্যালোরি। এই সবকিছুর সমাধানই কিন্তু একটিমাত্র পানীয়তে পাওয়া যেতে পারে। আর সেটি হচ্ছে লেবু পানি। আজকে জানবো এই লেবু পানিরই কিছু উপকারি দিক। 

লেবু পানি পানের উপকারিতা গুলো কি কি? 

১. হজম শক্তি বাড়ায়

লেবুতে থাকা এসিড ও সাইট্রাস ফ্ল্যাভোনয়েড পাকস্থলীর খাবারকে সহজেই ভেঙ্গে হজম হতে সাহায্য করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের পাকস্থলীর এই প্রয়োজনীয় এসিডের পরিমাণ কমতে থাকে। তাই এসময় লেবু পানি খেলে, পাকস্থলীর উপকারি এসিডের ঘাটতি পূরণ হয় এবং কমে যায় হজমজনিত সমস্যা। এমনকি কোষ্ঠকাঠিন্য তে ভুক্তভোগীরাও নিশ্চিত উপকার পাবেন সকালে খালি পেটে এক গ্লাস লেবু পানি খেলে। 

২. শরীরের আর্দ্রতা বজায় রাখে

একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে দৈনিক পানির চাহিদা প্রায় ৮ গ্লাস। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেরই এই দৈনিক চাহিদাটা পূরণ হয় না। আর এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, শুধুমাত্র পিপাসা মিটে যাওয়ার পর আমরা স্বাদহীন পানি বেশি খাওয়ার আর আগ্রহ পাই না। এতে করে মনের অজান্তেই শরীরে তৈরি হয় ডিহাইড্রেশন জনিত বিভিন্ন সমস্যা। এই সমস্যা থেকে উত্তরনের একটি ভালো উপায় হচ্ছে লেবু পানি। ৮ গ্লাস পানির মধ্যে অন্তত ২-১ গ্লাস যদি লেবু পানি পান করা যায়, তবে স্বাদ যেমন পরিবর্তন হবে, তেমনি শরীরেও বজায় থাকবে আর্দ্রতা। 

৩. ওজন কমাতে সাহায্য করে

যারা স্বাস্থ্য সচেতন, ওজন কমাতে চান বা ডায়েট মেনে চলার চেষ্টা করেন, তাদের প্রিয় বন্ধু হতে পারে লেবু পানি। খাবারের আগে ও খাবারের মাঝে লেবু পানি পান করলে, এটি প্রাকৃতিকভাবে পেটের অতিরিক্ত ক্ষুধাবোধ কিছুটা কমিয়ে দিতে সাহায্য করে। যার ফলে, অতিরিক্ত খাওয়ার চাহিদাও কমে যায়। লেবুতে থাকা পলিফেনলস নামক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট এই কাজটি করে। 

শরীরের অতিরিক্ত ফ্যাট কাটাতেও অনেকটা কার্যকরী এটি। এছাড়াও যাদের চিনিযুক্ত জ্যুস বা কোমল পানীয় খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে, তারাও ওইসবের বদলে অভ্যাস করতে পারেন স্বাস্থ্যকর লেবু পানি খাওয়ার। 

৪. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

একটি স্বাভাবিক আকারের লেবুতে প্রায় ২০ মিলিগ্রাম পরিমাণ ভিটামিন সি থাকে, যা একজন মানুষের দৈনিক ভিটামিন সি এর চাহিদার ২০ শতাংশই পূরণ করতে সক্ষম। আর ভিটামিন সি আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। 

এছাড়াও লেবুতে থাকা উচ্চমাত্রার এন্টি-অক্সিডেন্ট শরীরে বাইরের রোগ-জীবাণুর আক্রমণ প্রতিরোধ করে। শরীরে কোন জ্বর, ইনফেকশন বাসা বাধলেও, লেবু পানি খাওয়ার মাধ্যমে এসকল অসুস্থতা দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। 

৫. পটাশিয়ামের চাহিদা পূরণ করে

মানবদেহে পটাশিয়াম এমন একটি প্রয়োজনীয় উপাদান, যাকে ছাড়া একজন মানুষের শরীর স্বাভাবিকভাবে কাজ করতেই পারবে না। মাংসপেশির কার্যক্ষমতা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন, হৃদযন্ত্রের কাজ স্বাভাবিক রাখা, নার্ভ ও কোষের যোগাযোগ, খাবার থেকে পাওয়া পুষ্টি রক্তে সরবরাহ করা, সবখানেই চাই পটাশিয়ামকে। আর পটাশিয়ামেরই ভালো একটি উৎস হচ্ছে লেবু। তাই বলাই যায় যে, আমাদের শরীরে পটাশিয়ামের চাহিদার প্রতিদিনের বড় একটি অংশ পূরণ করা যেতে পারে লেবু পানি পানের মাধ্যমে। 

৬. কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি কমায়

কিডনিতে পাথর হওয়া একটি যন্ত্রণাদায়ক অসুখ। ওষুধ, অপারেশন, লেজার নানা ব্যায়বহুল পদ্ধতি আছে এই পাথর অপসারনের। তবে যদি কোনভাবে এই পাথর হওয়াই রোধ করা যায়, তাহলে যেতে হবে না সেই যন্ত্রণাদায়ক অসুস্থতা ও চিকিৎসার মধ্য দিয়ে। নিয়মিত লেবু পানি পান করলে ঝুঁকি কমানো যেতে পারে কিডনিতে পাথরের। কারণ কিডনিতে পাথর হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে পানি স্বল্পতা বা ডিহাইড্রেশন। 

এছাড়াও লেবুতে থাকা সাইট্রেট কিডনির পাথরকে গলাতেও সাহায্য করে। 

৭. লিভার ভালো রাখে

একজন মানুষের শরীরের ফিল্টার হচ্ছে তাঁর লিভার। শরীরের নানা ধরণের বর্জ্য এই লিভারের মাধ্যমেই শরীর থেকে দূর হয়। এই লিভারের কার্যকারিতা কমে গেলে, বা ফ্যাট জমলে বিভিন্ন অসুস্থতা বাসা বাধে শরীরে। তবে এই ঝুঁকিও কমাতে প্রস্তুত লেবু পানি। লেবুতে থাকা সাইট্রাস ফ্ল্যাভোনয়েড লিভারকে বর্জ্য অপসারনে সাহায্য করে, জমতে দেয় না লিভারে ক্ষতিকর ফ্যাট। 

৮. ত্বকের সৌন্দর্য ধরে রাখে

আমাদের ত্বকের সতেজতা, মসৃণতা ও উজ্জ্বলতা ধরে রেখে ত্বককে স্বাস্থ্যকর রাখতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে পর্যাপ্ত আদ্রতা, ভিটামিন সি ও এন্টি-অক্সিডেন্ট। আর এর সবই পাওয়া যায় লেবু পানি থেকে। তাই, ত্বককে বলিরেখা থেকে দূরে রাখতে কিংবা উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে, নিয়মিত লেবু পানি পান করার কোন তুলনা হয় না। 

লেবু পানি কীভাবে তৈরি করবেন?

Benefits-of-lemon-water

সাধারনত কমবেশি সবাই একইভাবে লেবু পানি তৈরি করে থাকেন। আর সেটা হলো, ঠাণ্ডা বা কুসুম গরম পানিতে লেবুর রস চিপে নিয়ে খোসাটা ফেলে দেয়া। আর এখানেই করা হয় মস্ত বড় ভুলটা। কারণ, লেবুর শুধু খোসাই যে শুধু ফেলা হয়, তা না। ফেলা হয়ে যায় প্রচুর পরিমাণের ভিটামিন সি, ফাইবার, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়ামসহ বিভিন্ন খনিজ। লেবু পানিতে লেবুর খোসা যোগ করার ক্ষেত্রে, লেবুর খোসা ভালোভাবে পরিষ্কার করে গ্রেট করে নিয়ে তবেই মেশানো যাবে লেবু পানিতে। 

গতানুগতিক লেবু পানি খেতে খেতে যদি ভালো না লাগে, তবে বানাতে পারেন কিছুটা ভিন্নভাবে। আসুন দেখি অমনই কয়েকটি উপায়,

  • লেবু পানির সাথে অল্প মধু যোগ করলে পাওয়া যাবে সুমিষ্ট স্বাদ। সাথে যোগ হবে মধুর পুষ্টিগুণও। 
  • গ্রীষ্মকালে মৌসুমি ফল যেমন, আনারস, আম বা তরমুজের রস যোগ করতে পারেন আপনার লেবু পানিতে। এতে লেবু পানির সাথে পাওয়া যাবে মৌসুমি ফলের স্বাদও।
  • স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, ক্র্যানবেরি ইত্যাদি বিদেশী ফল হলেও, আজকাল বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয়। এসব ফলের রস যোগ করেও স্বাদ ও পুষ্টি বাড়ানো যেতে পারে লেবু পানির। 
  • পুদিনা, আদার রস ও শসার রস যোগ করলে লেবু পানির স্বাদ হবে আরো সতেজ। গলা খুশখুশ, হালকা কাশিতে পাওয়া যাবে আরাম। এমনকি উপকার পাওয়া যাবে হজম ও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাতেও। 

লেবু পানির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া 

যথেষ্ট সাবধানতা ও সচেতনতার অভাবে অজস্র গুনাগুন সম্বলিত লেবু পানি থেকেও হতে পারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। জেনে রাখুন লেবু পানির এমনই কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও তাঁর সাবধানতা।

  • লেবুতে থাকা এসিড দাঁতের এনামেলের জন্য ক্ষতিকর। তাই লেবু পানি থেকে দাঁতের ক্ষয় রোধ করতে চাইলে, লেবু পানি খাওয়ার পর অবশ্যই কুলি বা ব্রাশ করতে হবে।
  • লেবুতে টাইরামাইন (Tyramine) নামক একপ্রকার উপাদান থাকে, যা শরীরে অতিরিক্ত প্রবেশ করলে মাথা ব্যাথার কারণ হতে পারে। তাই যারা প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা বা মাইগ্রেনে ভোগেন, তাদের লেবু পানি স্বল্প পরিমাণে খাওয়াই ভালো।  
  • অতিরিক্ত পরিমাণে লেবু পানি খেতে থাকলে সেটা পেটে গ্যাস্ট্রিক এর কারণ হতে পারে। এর থেকে হতে পারে বুকে, পেটে জ্বালাপোড়া, পেট ফাঁপা, বমি ভাব ও অরুচি। তাই সারাদিনই পানির বদলে লেবু পানি খেলে চলবে না।
  • যদিও যেকোন ঘা, কাঁটাছেড়া ভালো করতে ভিটামিন সি উপকারী। তবে মুখের ঘা বা মাউথ আলসার দেখা দিলে লেবু পানি ঘা-এর কষ্ট বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই এসময় লেবু পানি না খাওয়াই ভালো। 
  • লেবুর খোসা ভালমতো পরিষ্কার না করে লেবু পানিতে ব্যবহার করলে এর সাথে পেটে যেতে পারে নানারকমের জীবাণু। অর্থাৎ, লেবুর খোসা খাওয়ার জন্য ব্যবহারের আগে খেয়াল রাখতে হবে এর পরিচ্ছন্নতার দিকে। (Gupta.A, 2022)

অনেকেরই অভ্যাস সকালটা চা-কফি দিয়ে শুরু করার। অথচ ক্যাফেইনযুক্ত এসব পানীয় শরীরে তৈরি করে পানিশূন্যতা। অপরদিকে সকালে পান করা লেবু পানি সারা রাতের পানিশূন্যতা কাঁটায়। তাই দিনটা যদি স্বাস্থ্যকর উপায়ে শুরু করতে চান, তবে আজ থেকেই সকালটা লেবু পানি দিয়ে শুরু করার অভ্যাসটা তৈরি করে ফেলুন। অসুখকে যতটা সম্ভব দূরে রেখে সুস্থ জীবনযাপন করতে চাইলে, জীবনধারায় এমন কিছু ছোটখাটো পরিবর্তন খুবই আবশ্যক। 

 

References

Gupta. A. (2022, May 3) Ladies, drinking too much lemon water for weight loss can be harmful, Retrieved from Healthshot: https://www.healthshots.com/healthy-eating/nutrition/beware-of-these-5-side-effects-of-lemon-water/ 

Last Updated on April 9, 2023

Was this article helpful?
YesNo