ব্ল্যাক, গ্রিন, হোয়াইট, ওলোং, ম্যাচা চা (Matcha tea) ইত্যাদি সব চায়ের উৎস একটাই অর্থাৎ Camellia sinensis নামক চা গাছ। চা গাছ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় চা তৈরি করা হয় যার উপর ভিত্তি করে চায়ের ধরন আলাদা হয়ে থাকে। ম্যাচা চা তৈরির জন্য চা গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করার ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ আগে চা গাছের উপরে ছাউনি দিয়ে ছায়ার ব্যবস্থা করা হয় যেন পাতায় থাকা ক্লোরোফিল জমা হয়ে গাঢ় সবুজ বর্ণ ধারণ করে। পাতা সংগ্রহ করার পর কচি কান্ড ও পাতার শিরা ফেলে দিয়ে পাউডার বানানো হয় যাকে ম্যাচা বা মাচা চা বলা হয়। (Ajmera, 2020)

সাধারণত চা পাতা অথবা টি ব্যাগ গরম পানিতে নিমজ্জিত করে চা বানানো হয় কিন্ত ম্যাচা চায়ের ক্ষেত্রে পাউডার অবস্থায় পাওয়া যায় বলে পুরোটাই পানিতে মিশে যায়। ম্যাচা চা অন্যান্য চায়ের তুলনায় বেশি পুষ্টিগুণ, ক্যাফেইন ও এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। এই অনুচ্ছেদে ম্যাচা চা পান করার ৭ টি উপকারিতা সহ ম্যাচা চা তৈরির সঠিক নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও কাদের জন্য মাচা চা পান করার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত সেই বিষয়ে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

মাচা চা এর  উপকারিতা

১. উচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট

ভিন্নধর্মী একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ম্যাচা চা প্রস্তুত করা হয় আর তাই এই চায়ে অনেক বেশি পরিমাণে পলিফেনল (Polyphenols) সহ শরীরের জন্য উপকারী নানাবিধ প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে।‌ ম্যাচা চায়ের এন্টি অক্সিডেন্ট গুণাবলী শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণে ফ্রি রেডিক্যাল (free radicals) বাড়তে দেয় না এবং প্রদাহজনিত কোষের ক্ষতিগ্রস্ততা হ্রাস করে। নিয়মিত ম্যাচা চা পান করলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।‌ এছাড়াও এন্টি অক্সিডেন্টের প্রভাবে ত্বক ও চুল ভালো থাকে। এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ চা পান করার মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায় যা সুস্থ থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। 

২. লিভার সুরক্ষায় সহায়তা করে 

লিভার মানুষের শরীরের সবচেয়ে বড় গ্রন্থি যেখানে ৫০০ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিক্রিয়া ঘটে থাকে। শরীর থেকে ক্ষতিকর উপাদান বের করে দেওয়ার কাজে কখনো কখনো লিভার নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তথা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ম্যাচা চা এক্ষেত্রে লিভারের জন্য উপকারী ভূমিকা রাখে। বিশেষত লিভারের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রতিরোধ করে এবং ফ্যাটি লিভার ডিজিজে (NAFLD– non alcoholic fatty liver disease) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও নিয়মিত ম্যাচা চা পান করা লিভারের এনজাইমের মাত্রা ভালো রাখতে সহায়তা করে। 

৩. মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায় 

ম্যাচা চায়ে প্রাকৃতিক অনেকগুলো উপাদান যেমন- পলিফেনল, ক্লোরোফিল, ক্যাফেইন, L-theanine ইত্যাদি রয়েছে যা মস্তিষ্কের জন্য বেশ উপকারী। বিশেষ করে কাজে মনোযোগ বৃদ্ধি করা, উদ্দীপনার প্রতি দ্রুত সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা সহ স্মৃতি শক্তি ভালো রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও বয়স্কদের ক্ষেত্রে আলজেইমার্স (Alzheimer’s) ও পারকিনসন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। 

প্রতি ১ গ্রাম গ্রিন টিতে সর্বোচ্চ ২৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে আর প্রতি ১ গ্রাম ম্যাচা চায়ে সর্বোচ্চ ৪৪ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। ক্যাফেইন সরাসরি স্নায়ুতন্ত্রের উপর কাজ করে এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। 

৪. মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে 

ম্যাচা চায়ে L-theanine নামক অ্যামাইনো এসিড রয়েছে যা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এছাড়াও ক্লান্তি দূর করা সহ মন‌ ভালো রাখে। যারা‌ নিয়মিত ম্যাচা চা পান করেন তাদের ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন বা বিষন্নতায় ভোগার সম্ভাবনা কম থাকে।‌ আর তাই মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য ম্যাচা চা পান করা খুব উপকারী‌ হবে।  

৫. ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে 

ম্যাচা চায়ে বেশ কিছু প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো EGCG (epigallocatechin-3-gallate) যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে ত্বক, ফুসফুস ও লিভার ক্যান্সার সহ মহিলাদের স্তন ক্যান্সার এবং পুরুষের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। 

তবে ম্যাচা চায়ের ক্যান্সার প্রতিরোধী গুণাবলী শুধুমাত্র টেস্ট টিউব ও প্রাণীদের উপর পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে। এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য মানুষের উপর আরো অনেক গবেষণা করার প্রয়োজন রয়েছে। 

৬. হৃতপিন্ডের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে 

হার্ট বা হৃদপিন্ড মানুষের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ যা সারা শরীরে রক্ত পাম্প করে থাকে।‌ বিশ্বজুড়ে অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো হার্টের রোগ। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, গ্রিন টি ও ম্যাচা চায়ে এমন কিছু প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে যা হার্টের রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। (Ajmera , 2020)

হার্টের প্রধান শত্রু হলো ক্ষতিকর কোলেস্টেরল তথা LDL (low density lipoprotein) ও ট্রাইগ্লিসারাইড (triglycerides) যা হার্টের রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। 

ম্যাচা চায়ের এন্টি অক্সিডেন্ট গুণাবলী ক্ষতিকর কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং সেই সাথে হার্ট অ্যাটাকস্ট্রোক এর ঝুঁকি কমায়। তবে হৃদপিন্ডের কার্যকারিতা ভালো রাখার জন্য শুধুমাত্র চায়ের উপর ভরসা করলে চলবে না।‌ বরং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা, পর্যাপ্ত ঘুম, অতিরিক্ত মানসিক চাপ পরিহার করা এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাস করতে হবে। 

৭. ওজন কমাতে সাহায্য করে 

ম্যাচা চায়ের এন্টি অক্সিডেন্ট গুণাবলী ও ক্যাফেইন মেটাবলিসমের গতি বৃদ্ধি করে এবং শরীরের ফ্যাট বার্ন করার মাধ্যমে ওজন কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও ম্যাচা চা পান করার ফলে ক্ষুধা কমে যায় যা ডায়েট কন্ট্রোল করতে চান এমন মানুষদের জন্য সুবিধাজনক হবে।‌ 

বেশিরভাগ মানুষ ওজন কমানোর একমাত্র সহজ হাতিয়ার হিসেবে গ্রিন টি বা ম্যাচা‌ চা পান করাকে বেছে নেন। তবে এটি একটি ভুল ধারণা যে, শুধুমাত্র চা শরীরের ওজন কমাতে পারবে। শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য কম ক্যালরি‌‌ গ্রহণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার পাশাপাশি সহায়ক হিসেবে ম্যাচা চা পান করা যেতে পারে। 

মাচা চা প্রস্তুত করার নিয়ম

১ কাপ গরম পানিতে ১ থেকে ২ চা চামচ পরিমাণ মাচা চা দিয়ে ভালোভাবে নাড়তে হবে যেন একদম সমসত্বভাবে মিশে যায়‌। পানি একদম ফুটন্ত গরম না হওয়া ভালো, কারণ মাচা চায়ে অনেক বেশি পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে যা তাপের প্রভাবে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। যেকোনো ধরনের চা চিনি ছাড়া খাওয়া উত্তম তবে মাচা চায়ের ক্ষেত্রে মিষ্টি ছাড়া খেতে ভালো লাগবে না। আর তাই এক্ষেত্রে পরিমাণমতো মধু যোগ করা যেতে পারে। কারণ চিনির চেয়ে মধুর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম অর্থাৎ দ্রুত রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় না। এছাড়াও মধুতে শরীরের জন্য উপকারী অনেকগুলো প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে। 

সতর্কতা  

যদিও মাচা চা পান‌ করা নিরাপদ হিসেবে মনে করা হয় তবে উপকারিতা পাওয়ার আশায় অনেক বেশি পরিমাণে মাচা চা পান করা যাবে না।‌ 

               একজন মানুষের জন্য দিনে সর্বোচ্চ ২ কাপের বেশি মাচা চা পান করা উচিত নয়। 

 

এছাড়াও কতিপয় ক্ষেত্রে মাচা চা পান করার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমনঃ (Torrens, 2022)

  • মাচা চা প্রচুর পরিমাণ ক্যাফেইন সমৃদ্ধ। আর তাই যাদের রাতে ঘুমের সমস্যা বা অনিদ্রা হয় তাদের জন্য বিকাল ও রাতে মাচা চা পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। 
  • গর্ভবতী নারীদের জন্য মাচা চা পান করা নিরাপদ। তবে দিনে ১ কাপের বেশি পান করা যাবে না অথবা একজন গাইনী ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। 
  • আয়রনের অভাব জনিত রক্তস্বল্পতার রোগীদের জন্য মাচা চা পান করা উচিত নয়। কারণ মাচা চায়ে প্রচুর পরিমাণে ট্যানিন (tannins) রয়েছে যা খাবার থেকে অন্ত্রে আয়রন শোষণে বাঁধার সৃষ্টি করে। 

 

চা বাগানে ম্যাচা চা তৈরির জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচর্যার দরকার পড়ে। আর তাই ম্যাচা চায়ের দাম তুলনামূলক একটু বেশি হয়ে থাকে। তবে পুষ্টিগুণ বিবেচনায় নিঃসন্দেহে এটি শরীরের জন্য অনেক বেশি উপকারিতা বয়ে আনতে সক্ষম। ম্যাচা চায়ের প্রায় কাছাকাছি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন চা হলো গ্রিন টি। আর তাই কারো কাছে ম্যাচা চা পান করতে ভালো না লাগলে গ্রিন টি পান করতে পারেন। 

গ্রিন টির উপকারিতা সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।‌ 

 

References

Ajmera, R. (2020, February 24). 7 Proven Ways Matcha Tea Improves Your Health. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/7-benefits-of-matcha-tea

Torrens, K. (2022, December 16). top-7-health-benefits-of-matcha-tea. Retrieved from bbc good food: https://www.bbcgoodfood.com/health/top-7-health-benefits-of-matcha-tea/amp

 

Last Updated on April 12, 2023