সর্বপ্রথম ১৯২৮ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন নামক অ্যান্টিবায়োটিক (Antibiotics) আবিস্কার করেন যা চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল।

“বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) উদ্বিগ্নতার বিষয় হলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স যা বিশ্বের যেকোনো দেশের এবং যেকোনো বয়সের মানুষের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।”

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স রোধ করতে চাইলে এর সঠিক ব্যবহার করতে হবে। যথাযথ নিয়ম মেনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা না হলে শরীরের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ ব্যবহারের ক্ষেত্র, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং ঔষধ সম্পর্কে যেসব তথ্য জানা জরুরী সেই বিষয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও ভাইরাসজনিত রোগ কোনগুলো এবং ভাইরাসকে প্রতিহত করার জন্য কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সেই বিষয়ে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। (Cleveland Clinic, 2016) 

অ্যান্টিবায়োটিক কি এবং কিভাবে ব্যবহার করা হয়? 

পৃথিবীতে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া রয়েছে যার মধ্যে কোনোটি উপকারী আবার কোনোটি রোগ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। মানব শরীরে ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশন জনিত অসুস্থতা হওয়া খুব কমন ঘটনা। 

ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিশেষ করে শ্বেত রক্ত কণিকা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে। তবে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা অনেক বেশি হলে সেক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যুদ্ধ করে এদেরকে প্রতিহত করতে পারে না। এমতাবস্থায় ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার জন্য যে হাতিয়ার ব্যবহার করা হয় তা হলো অ্যান্টিবায়োটিক যা খুবই শক্তিশালী ঔষধ।

“অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ মানুষের শরীরে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি প্রতিহত করে অথবা সরাসরি ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলার মাধ্যমে ইনফেকশন দূর করে থাকে। “ 

অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের নিয়ম হলো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে সর্বপ্রথম রোগ নির্ণয় করতে হবে। চিকিৎসক রোগীর লক্ষণসমূহ জানার পর শারীরিক পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করার মাধ্যমে রোগের কারণ ব্যাকটেরিয়া জনিত কিনা সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হবেন। অতঃপর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার জন্য চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ প্রেসক্রাইব করেন যা ব্যাকটেরিয়া জনিত ইনফেকশন দূর করে। 

অ্যান্টিবায়োটিক সম্পর্কে যা জানা দরকার

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশন দূর করতে অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধের কার্যক্ষমতা দিন দিন কমে চলেছে। অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে যা আমাদের অসচেতনতার ফল। আমাদের দেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হওয়ার পেছনে দায়ী কারণ গুলো হলোঃ 

  • চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ সংগ্রহ ও সেবন করা, 
  • অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ম মেনে না খাওয়া এবং রোগ লক্ষণ কমে গেলে অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ শেষ না করেই ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া, 
  • সামান্য অসুস্থতা অথবা ভাইরাস জনিত রোগে অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ ব্যবহার করা।

অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে সতর্কতা 

  • অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়া জনিত ইনফেকশন দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। ভাইরাস ও ছত্রাকের সংক্রমণ হলে সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। 
  • অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ প্রেসক্রিপশনের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ চিকিৎসকের নির্দেশনা ব্যতীত ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক সংগ্রহ ও সেবন করা যাবে না। 
  • রোগের লক্ষণ কমে গেলেই ঔষধ বন্ধ করা যাবে না। বরং চিকিৎসক যতদিন ঔষধ সেবনের নির্দেশনা দিয়েছেন সেই নিয়ম মেনে অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ খেতে হবে।
  • টেট্রাসাইক্লিন (Tetracyclines) অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের সময় দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া যাবে না। কারণ,‌ এতে করে শরীরে ঔষধ শোষণে ব্যঘাত ঘটতে পারে। 
  • অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ প্রতিবার সেবনের মধ্যকার সময়ের পার্থক্য নির্দিষ্ট হতে হবে। অর্থাৎ দিনে ২ বার ঔষধ সেবন করতে বলা হলে ঠিক ১২ ঘন্টা পর পর প্রতিদিন একই সময়ে ঔষধ সেবন করতে হবে। 
  • অনেকেই ঔষধ খেতে ভুলে গেলে পরবর্তী ঔষধ খাওয়ার সময়ে দুই ডোজ ঔষধ একবারে খেয়ে থাকেন। অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধের ক্ষেত্রে এই ভুলটি কখনোই করা যাবে না। 
  • অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধের সাথে অন্য কোনো ঔষধ সেবন করা হলে প্রতিক্রিয়া (Interaction) হতে পারে। আর তাই অ্যান্টিবায়োটিক চলাকালীন সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অন্য কোনো ঔষধ সেবন করা যাবে না। আগে থেকেই কোনো ঔষধ সেবন করলে সেই ব্যাপারে চিকিৎসককে জানাতে হবে। 
  • অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করার সময় মদ্যপান করা হলে শরীরে নানাবিধ সমস্যা হতে পারে। আর তাই অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ চলাকালীন সময়ে মদ্যপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। 
  • ঔষধ চলাকালীন সময়ে খাবার গ্রহণের ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হবে কিনা সেই ব্যাপারে চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। 

অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া 

অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ সেবনের ফলে ইনফেকশন দূর হওয়ার পাশাপাশি শরীরে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তীব্রতা ঔষধের ধরন, মাত্রা ও রোগীর শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে কম বা বেশি হতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলো হলোঃ (Felman, 2023)

কমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া 

  • বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া
  • ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য
  • পেটে ব্যথা (upset stomach) 
  • ত্বকে র‍্যাশ (Rash) হওয়া 
  • যৌনাঙ্গে ছত্রাকের সংক্রমণ

বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া 

  • রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে যায়
  • শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা অনুভব হয় 
  • কানে কম শোনা (hearing loss)
  • কিডনিতে পাথর হওয়া ইত্যাদি 

“কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলে এলার্জিক রিয়াকশন (Allergic reaction) দেখা যায়। ত্বকে র‍্যাশ (Rash) হওয়া, মুখ ও জিহ্বা ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে ঔষধ সেবন বন্ধ রেখে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।”

ভাইরাস বনাম ব্যাকটেরিয়াঃ এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার

antibiotics 2

ভাইরাস অতিক্ষুদ্র আকৃতির অণুজীব যার আকার ১০ থেকে ৩০০ ন্যানো মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ১ মিলিমিটারের ১০ লাখ ভাগের ১ ভাগ হলো ১ ন্যানো মিটার অর্থাৎ ভাইরাস খুবই ক্ষুদ্র অণুজীব। ভাইরাস জড় ও জীব দুই অবস্থায় থাকতে পারে এবং পৃথিবীতে ভাইরাসের সংখ্যা ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে তুলনামূলক অনেক বেশি। 

ব্যাকটেরিয়া হলো এককোষী আণুবীক্ষণিক জীব যার আকার ০.২ থেকে ৫ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ১ মিলিমিটারের ১ হাজার ভাগের ১ ভাগ হলো ১ মাইক্রোমিটার অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়ার আকার ক্ষুদ্র তবে ভাইরাসের চেয়ে বড়। ভাইরাসের মতো ব্যাকটেরিয়া দুই অবস্থায় থাকতে পারে না বরং এটি শুধুমাত্র জীব অবস্থায় থাকতে পারে। 

মানব শরীরে ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশনের ফলে যেসব রোগ হয় তা হলো নিউমোনিয়া, টিউবারকুলোসিস, অ্যানথ্রাক্স (Anthrax), টিটেনাস, কলেরা, ফুড পয়জনিং, প্লেগ (Plague), সেলুলাইটিস (Cellulitis), ডিপথেরিয়া, গলা ব্যথা (Sore throat), হুপিং কাশি, মেনিনজাইটিস, টাইফয়েড, প্রস্রাবের ইনফেকশন (UTI- Urinary tract infection), গনোরিয়া, সিফিলিস ইত্যাদি। 

ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশন জনিত রোগে অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ ব্যবহার করা হয়। 

কোন রোগগুলো ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয় এবং অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসা করা যায় না? 

antibiotics 3

খাবার, মাটি, পানি, বায়ু সহ অসুস্থ ব্যক্তির মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং ভাইরাস জনিত রোগ সৃষ্টি করে থাকে। মানুষের শরীরে ভাইরাস জনিত যেসব রোগ হয়ে থাকে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রোগ হলোঃ 

  • ফ্লু (Flu): ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট সংক্রামক রোগ যার সংক্রমণ নাক, গলা ও ফুসফুসে হয়ে থাকে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য ভ্যাকসিন রয়েছে।  
  • ঠান্ডা লাগা (Common cold): ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে ঠান্ডা লাগা খুব কমন ঘটনা তবে এটি শরীরের জন্য তেমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না। এর জন্য কোনো ঔষধ খাওয়ার দরকার পড়ে না। 
  • ব্রংকাইটিস (Bronchitis): ফুসফুসে ভাইরাসের সংক্রমণ যার ফলে বুকের ভেতর প্রদাহ ও শব্দ হয়। ধুমপান করেন এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি রয়েছে। 
  • হাম (Measles): ভাইরাস জনিত মারাত্মক ছোঁয়াচে প্রকৃতির রোগ যার ফলে ত্বকে র‍্যাশ হয় ও উচ্চ জ্বর থাকে।‌ এই রোগ প্রতিরোধে শিশুদের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। 
  • ডেঙ্গু (Dengue) ও চিকুনগুনিয়া (Chikungunya): ভাইরাস জনিত জ্বর যার ফলে শরীরে প্রচন্ড ব্যথা থাকে। এই রোগের কোনো ভ্যাকসিন নেই।  
  • জলাতঙ্ক (Hydrophobia): অসুস্থ কুকুর (Rabies ভাইরাসে আক্রান্ত) কামড়ালে এই রোগ হয়। এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই তবে প্রতিষেধক হিসেবে ভ্যাকসিন রয়েছে।  
  • হেপাটাইটিস বি ও সি (Hepatitis B & C): হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে লিভার রোগাক্রান্ত হয়ে থাকে। অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক স্থাপন, একই সুচ সিরিঞ্জ বারবার ব্যবহার করা এবং আক্রান্ত ব্যক্তির দেহ থেকে রক্ত নেওয়ার মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। তবে এই ভাইরাসের জন্য ভ্যাকসিন রয়েছে।  
  • এইডস (AIDS): HIV (human immunodeficiency virus) ভাইরাসের সংক্রমণে এইডস হয় যা একটি প্রাণঘাতী রোগ। এই রোগের জন্য কোনো ভ্যাকসিন নেই। 
  • জরায়ু মুখের ক্যান্সার (Cervix cancer): মহিলাদের জরায়ু ক্যান্সার হওয়ার জন্য HPV (Human Papiloma Virus) ভাইরাসকে দায়ী মনে করা হয়। তবে আশার কথা হলো এই‌ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য ভ্যাকসিন রয়েছে। 

ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট রোগে অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসা করা যায় না কারণ এক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম নয়। ভাইরাস জনিত রোগের জন্য এন্টি ভাইরাল ঔষধ ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য ভ্যাকসিন বা টিকা নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। 

 References

cleveland clinic. (2016, November 20). Antibiotics. Retrieved from cleveland clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/drugs/16386-antibiotics
Felman, A. (2023, January 03). What to know about antibiotics. Retrieved from medical new stoday: https://www.medicalnewstoday.com/articles/10278#side-effects

Last Updated on April 5, 2023