প্রত্যেক মানুষের শরীরে ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে যা শরীরে রোগজীবাণু ও ক্ষতিকর উপাদান প্রবেশ করলে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অর্থাৎ ইমিউন সিস্টেম হলো শরীরের জন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। 

ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট (Immunosuppressant) কি? 

ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট হলো এমন একধরনের ওষুধ যা ইমিউন সিস্টেমের সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। অর্থাৎ এই ধরনের ওষুধ গ্রহণ করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। 

সচরাচর সবাই চেষ্টা করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরো শক্তিশালী করতে। কারণ তা রোগজীবাণু থেকে বাঁচতে এবং সুস্থ থাকার জন্য অপরিহার্য। ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ওষুধ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাহলে এই ধরনের ওষুধ কেনো ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও ইমিউনোসাপ্রেসেন্টের প্রকারভেদ, সেবনের ফলে কি কি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা জটিলতা হতে পারে, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য এই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা যাবে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে পড়তে থাকুন। 

ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট কিসের জন্য প্রয়োজন? 

ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট সাধারণ প্রকৃতির কোনো ওষুধ নয় যা সচরাচর রোগের চিকিৎসার জন্য হরহামেশা ব্যবহার করা যাবে। বরং বিভিন্ন জটিল রোগের চরম পরিস্থিতিতে এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে এই ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 

ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ব্যবহারের তিনটি প্রধান ক্ষেত্র হলোঃ (cleveland clinic, 2021) 

  • অটোইমিউনো ডিজিজ (Autoimmune diseases
  • অঙ্গ প্রতিস্থাপন (Organ transplant) 
  • স্টেম সেল অথবা বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট (Stem cell or Bone marrow transplant) 

অটোইমিউন রোগে ইমিউনোসাপ্রেসেন্টের ভূমিকা কি? 

অটোইমিউনো রোগ‌ হলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিক আচরণ জনিত একটি সমস্যা। অর্থাৎ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সুস্থ কোষ বা টিস্যুকে ভুলবশত ক্ষতিকর উপাদান ভেবে আক্রমণ করে বসলে যে সমস্যার সৃষ্টি হয় তাকে অটোইমিউনো রোগ বলে। যেমনঃ 

  • লুপাস (Lupus
  • সোরিয়াসিস (Psoriasis) 
  • রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (Rheumatoid arthritis) 
  • ক্রনস ডিজিজ (Crohn’s disease) 
  • আলসারেটিভ কোলাইটিস (Ulcerative colitis) 
  • মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (Multiple Sclerosis)
  • এলোপেসিয়া এরিয়াটা (Alopecia areata) 

অটোইমিউনো রোগের চিকিৎসা ক্ষেত্রে ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ওষুধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে রোগের প্রাথমিক পর্যায়েই এই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয় না। বরং রোগের জটিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য চিকিৎসকেরা ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট প্রেসক্রাইব করেন।

অটোইমিউন রোগ একদম সারিয়ে ফেলার মতো কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। বরং এক্ষেত্রে চিকিৎসার উদ্দেশ্যেই হলো রোগ লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখা। তাই যেসব রোগের ক্ষেত্রে মৃদু থেকে মাঝারি প্রকৃতির ব্যথা ও প্রদাহ হয় তার জন্য সাধারণ ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করা এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক পদ্ধতি অবলম্বন করার মাধ্যমে অটোইমিউন রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। (Bandoim, 2021)

অঙ্গ প্রতিস্থাপনে ইমিউনোসাপ্রেসেন্টের ভূমিকা কি? 

কিডনি, লিভার সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ড্যামেজ হয়ে গেলে উন্নত চিকিৎসার বদৌলতে অন্য একজন ব্যক্তির সুস্থ অঙ্গ সংগ্রহ করে অসুস্থ ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। এই প্রক্রিয়ায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ওষুধ। 

শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এক্ষেত্রে প্রতিস্থাপিত অঙ্গকে ক্ষতিকর ভেবে তাকে আক্রমণ করে তথা শরীর থেকে বের করে দিতে চায়। শক্তিশালী ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ওষুধ ব্যবহার করার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। যার ফলে এই ধরনের সমস্যা হয় না। অর্থাৎ প্রতিস্থাপিত অঙ্গ শরীরে ভালো ভাবে অবস্থান করতে পারে। 

শুধুমাত্র সার্জারির সময়েই নয় বরং অঙ্গ প্রতিস্থাপন করার পরে দীর্ঘসময় পর্যন্ত (কিংবা সারাজীবন) চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বল্প ডোজে ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ওষুধ গ্রহণ করতে হয় যেন কখনোই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রতিস্থাপিত অঙ্গকে আক্রমণ করে বিকল করে দিতে না পারে।

স্টেম সেল (অস্থি মজ্জা) প্রতিস্থাপনে ইমিউনোসাপ্রেসেন্টের ভূমিকা কি? 

কিছু কিছু রোগের চিকিৎসায় স্টেম সেল (Stem cell) ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হয়। যেমনঃ 

রোগীর নিজের শরীরের কোষ ব্যবহার করে স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হলে তাকে Autologous transplant বলা হয়। এক্ষেত্রে ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ওষুধ ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে না। 

অসুস্থ ব্যক্তির শরীরের রোগাক্রান্ত কোষ যখন অন্য একজন দাতার (যাকে Graft বলা হয়) সুস্থ কোষ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয় তখন তাকে Allogeneic স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট বলে। এই ধরনের প্রতিস্থাপনের পরে দাতা কোষগুলি শরীরে (Host) একটি নতুন ইমিউন সিস্টেম তৈরি করে। কখনো কখনো এই নতুন ইমিউন সিস্টেম শরীরের সুস্থ টিস্যু ও অঙ্গকে আক্রমণ করে যাকে গ্রাফ্ট-বনাম-হোস্ট ডিজিজ অথবা GVHD (graft-versus-host disease) বলা হয়। 

ইমিউনোসপ্রেসেন্টস ওষুধ GVHD হওয়ার সম্ভাবনা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। Allogeneic স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্টের সময় এবং পরবর্তীতে (কয়েক সপ্তাহ থেকে সর্বোচ্চ কয়েক বছর পর্যন্ত) শিরায় বা মুখে ইমিউনোসপ্রেসেন্ট ওষুধ দেয়া হয়ে থাকে।  

ইমিউনোসাপ্রেসেন্টের প্রকারগুলো কী কী? 

ইমিউনোসাপ্রেসেন্টের প্রকারগুলো কী কী

ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ওষুধের অনেকগুলো প্রকরণ রয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে কমন হলো কর্টিকোস্টেরয়েড (Corticosteroid) বা প্রেডনিসোন। এছাড়াও অন্যান্য প্রকরণ গুলো হলোঃ (Giorgi, 2019)

  • Janus kinase inhibitors
  • Calcineurin inhibitors
  • mTOR inhibitors
  • IMDH inhibitors
  • Monoclonal antibodies
  • Biologics

অটোইমিউন রোগ নাকি অঙ্গ প্রতিস্থাপন কিসের জন্য ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে চিকিৎসক উল্লেখিত প্রকরণগুলো থেকে সুনির্দিষ্ট ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন

ইমিউনোসাপ্রেসেন্টের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি কি? 

ইমিউনোসাপ্রেসেন্টের ধরণের উপর নির্ভর করে শরীরে বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। যেমনঃ 

ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট সম্ভাব্য ঝুঁকি বা জটিলতা কি কি হতে পারে? 

ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ওষুধ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। যার ফলে শরীরে সহজেই রোগজীবাণু আক্রমণ করতে পারে তথা ইনফেকশন হয়ে থাকে। ইমিউনোসাপ্রেসেন্টের সম্ভাব্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি বা জটিলতা গুলো হলোঃ 

কিভাবে ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট গ্রহণ করা হয়? 

ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, সিরাপ ও ইনজেকশন হিসেবে ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ওষুধ পাওয়া যায়। আপনার জন্য কোনটি উপযোগী হবে তা চিকিৎসক নির্ধারণ করে দেবেন। 

চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে সঠিক নিয়মে ওষুধ খাওয়া উচিত। বিশেষ করে প্রতিদিন একই সময়ে ওষুধ খেতে হবে। একদিনের ওষুধ বাদ পরলে অটোইমিউন রোগের লক্ষণ বেড়ে যেতে পারে। অঙ্গ প্রতিস্থাপন রোগীদের ক্ষেত্রে একটি ডোজ মিস হলে প্রতিস্থাপিত অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বা GVHD ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে ওষুধ সেবনের জন্য। যদি কখনো ওষুধ বাদ পরে তাহলে অবশ্যই অতি শীঘ্রই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারীর জন্য ইমিউনোসাপ্রেসেন্টস গ্রহণ করা নিরাপদ হবে কি? 

গর্ভবতী নারী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ওষুধ সেবন করা হলে তা মা ও শিশুর জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। আর তাই এমন পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য অন্যধরনের ওষুধ ব্যবহার করতে হবে বিশেষত অটোইমিউন রোগের ক্ষেত্রে। তবে একান্তই ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট গ্রহণের প্রয়োজন হলে চিকিৎসককে সাথে পরামর্শ করে স্বল্প মাত্রায় ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।  

ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ওষুধ প্রেসক্রিপশনের অন্তর্ভুক্ত। আর তাই কখনোই চিকিৎসকের নির্দেশনা ব্যতীত এই ধরনের ওষুধ সেবন করা যাবে না। এছাড়াও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা জটিলতা কমানোর জন্য অবশ্যই নিয়ম মেনে ওষুধ সেবন করতে হবে। এই সময়ে অন্য কোনো ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন হলে বিষয়টি চিকিৎসককে আগে জানাতে হবে।

References

Bandoim, L. (2021, February 13). How Autoimmune Diseases Are Treated. Retrieved from very well health: https://www.verywellhealth.com/how-autoimmune-diseases-are-treated-5093794

cleveland clinic. (2021, March 17). Immunosuppressants. Retrieved from cleveland clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/drugs/10418-immunosuppressants

Giorgi, A. (2019, January 09). About Immunosuppressant Drugs. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/immunosuppressant-drugs

Last Updated on November 1, 2023