লিম্ফোমা কি? মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো লিম্ফেটিক সিস্টেম বা লসিকাতন্ত্র। লসিকাতন্ত্রে লিম্ফোসাইট (Lymphocytes) নামক শ্বেত রক্ত কণিকা থাকে। লিম্ফোমা (Lymphoma) হলো ব্লাড ক্যান্সারের একটি বিশেষ ধরন‌ যেখানে লিম্ফেটিক সিস্টেম আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ লিম্ফোসাইট কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হতে থাকে। লিম্ফ নোড, থাইমাস গ্রন্থি (Thymus), প্লীহা (Spleen), টনসিল ও বোন‌ ম্যারোতে লিম্ফোমা ছড়িয়ে পড়ে। 

এই অনুচ্ছেদে লিম্ফোমা এর ধরন, কারণ, কাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

লিম্ফোমা এর ধরন

লিম্ফোমা প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে যা Reed-Sternberg lymphocytes এর উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির ভিত্তিতে আলাদা করা হয়েছে। যেমনঃ 

হজকিন লিম্ফোমা (Hodgkin’s lymphoma)

১৮০০ সালে ডা থমাস হজকিন সর্বপ্রথম এই ধরনের ক্যান্সার কোষ আবিষ্কার করেন যার নাম অনুসারে হজকিন লিম্ফোমা বলা হয়। হজকিন লিম্ফোমার ক্ষেত্রে Reed-Sternberg lymphocytes কোষ উপস্থিত থাকে। (Nall, 2022) 

হজকিন লিম্ফোমা সাধারণত কম বয়সী মানুষের ক্ষেত্রে (বাচ্চা এবং ২০ থেকে ৩৯ বয়সীদের) হয়ে থাকে। তবে বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এই ধরনের লিম্ফোমা একদম হয় না এমন নয়। 

নন-হজকিন লিম্ফোমা (Non-Hodgkin’s lymphoma) 

Reed-Sternberg lymphocytes নামক ক্যান্সার কোষ উপস্থিত না থাকলে তাকে নন-হজকিন লিম্ফোমা বলা হয়। হজকিন লিম্ফোমার তুলনায় নন-হজকিন লিম্ফোমা বেশি দেখা যায় যা সাধারণত বৃদ্ধ মানুষদের (৬০ থেকে ৮০ বছর বয়সীদের) আক্রমণ করে থাকে। 

দুই ধরনের লিম্ফোমার মধ্যে লক্ষণ বিচারে একটি পার্থক্য রয়েছে। হজকিন লিম্ফোমার ক্ষেত্রে সাধারণত শরীরের উপরের অংশের (ঘাড়, গলা, বুক, পিঠ, বগল) লিম্ফ নোড গুলো ফুলে যায়। নন-হজকিন লিম্ফোমার ক্ষেত্রে শরীরের উপর নিচ হিসেবে আলাদা কোনো পার্থক্য থাকে না।‌ বরং শরীরের সব অংশের লিম্ফ নোড ফুলে যায়।

হজকিন ও নন-হজকিন লিম্ফোমার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য ক্যান্সার কোষ সংগ্রহ করে মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন পড়ে।

লিম্ফোমা এর কারণ 

লিম্ফোসাইট কোষ নির্দিষ্ট নিয়মে বিভাজিত হয় এবং কিছুদিন পরে শরীরের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী মারা যায়। কোষের ভেতরে থাকে DNA যা এই পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো কারণে DNA এর মিউটেশন বা পরিবর্তন হলে কোষ বিভাজন ও মৃত্যু নির্দিষ্ট নিয়মে হয় না। অর্থাৎ অস্বাভাবিক হারে লিম্ফোসাইট কোষ বাড়তে থাকে এবং সহজে মৃত্যু বরণ করে না।‌ তবে ঠিক কি কারণে DNA এর এমন পরিবর্তন ঘটে তা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ লিম্ফোমার প্রকৃত কারণ জানা যায়নি।‌

লিম্ফোমা ক্যান্সার এর ঝুঁকি কাদের ক্ষেত্রে বেশি থাকে? 

যেকোনো মানুষের ক্ষেত্রে লিম্ফোমা হতে পারে। তবে মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের ক্ষেত্রে লিম্ফোমায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে। এছাড়াও আরো যেসব বিষয়কে এই রোগের রিস্ক ফ্যাক্টর (Risk factors) বা ঝুঁকির কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা হলোঃ (Cleveland Clinic, 2021) 

  • এইডস আক্রান্ত রোগী (এই রোগে আক্রান্ত হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়)
  • যারা দীর্ঘদিন যাবত স্টেরয়েড (Steroids) জাতীয় ওষুধ সেবন করেন (স্টেরয়েড সেবনের ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়)
  • যাদের Epstein-Barr virus বা Helicobacter pylori ইনফেকশন হওয়ার ইতিহাস রয়েছে।
  • পরিবারের সদস্যদের কারো ক্ষেত্রে লিম্ফোমা আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকা
  • রেডিয়েশনের ক্ষতিকর প্রভাব
  • শরীরের অতিরিক্ত ওজন 

লিম্ফোমা এর লক্ষণ 

image3 6

প্রাথমিক পর্যায়ে লিম্ফোমার ক্ষেত্রে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কারো কারো শরীরের বিভিন্ন স্থানের লিম্ফ নোড ফুলে যেতে দেখা যায়। তবে ব্যথা থাকে না বলে অনেকেই তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে না। ভুলে গেলে চলবে না যে, ব্যথাহীন এমন লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া লিম্ফোমা নামক ভয়ংকর ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। এই রোগের ক্ষেত্রে আরো যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ

  • ঘাড়, গলা,‌ বগল, কানের পাশে, কুচকিতে ও পেটে ছোট গোটার মতো ফুলে যাওয়া এবং এতে ব্যথা থাকে না 
  • জ্বর ও শীত বোধ
  • দুর্বলতা ও ক্লান্তি
  • প্লীহা ফুলে যাওয়া (Splenomegaly)
  • রাতে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
  • ত্বকে চুলকানি (itchy rash)
  • ক্ষুধার অনুভূতি কমে যাওয়া
  • শরীরের ওজন কমতে থাকা
  • কাশি ও শ্বাসকষ্ট 

লিম্ফোমা কিভাবে নির্ণয় করা হয়? 

image2 4

লিম্ফোমা নির্ণয়ের জন্য একজন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের (Hematologist) শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসক সর্বপ্রথম রোগীর শারীরিক পর্যবেক্ষণ করেন। অতঃপর কতিপয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। যেমনঃ 

  • রক্ত পরীক্ষা (CBC- Complete Blood Count)
  • বুকের এক্সরে (Chest x-ray)
  • বায়োপসি (Biopsy)
  • Lumbar puncture (spinal tap)
  • Bone marrow aspiration
  • পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি
  • সিটি স্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি

চিকিৎসা 

লিম্ফোমার ধরন, তীব্রতা বা স্টেজ (Stages), রোগীর বয়স ও শরীরের সক্ষমতা অনুযায়ী চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্নতর হয়ে থাকে। ক্যান্সার কোষ শরীরের কতটুকু অংশে ছড়িয়ে পড়েছে তার উপর ভিত্তি করে ১ থেকে ৪ পর্যন্ত স্টেজে ভাগ করা হয়েছে যেখানে ৪ হলো সবচেয়ে জটিল অবস্থা। আশার কথা হলো যে, এই অবস্থার জন্যও চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। সাধারণত যেসব পদ্ধতি লিম্ফোমার চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে তা‌ হলোঃ 

  • কেমোথেরাপি (Chemotherapy) হলো লিম্ফোমার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা যার মাধ্যমে ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করা হয়।
  • কেমোথেরাপির সাহায্যে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস না হলে রেডিওথেরাপির (Radiation therapy) প্রয়োজন হয়। 
  • ইমিউনোথেরাপির মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উজ্জীবিত করা হয় যেন তা নিজে থেকে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়। 
  • লিম্ফোমার চিকিৎসায় বোন ম্যারো ট্র্যান্সপ্লান্টের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত বোন ম্যারো ঠিক করা হয়। এটি খুব ব্যয়বহুল একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যা রোগীর শরীর থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করে অথবা অন্য কারো থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করে সম্পন্ন করা হয়। 

চিকিৎসার মাধ্যমে হজকিন লিম্ফোমায় আক্রান্ত রোগীদের ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নন-হজকিন লিম্ফোমায় আক্রান্ত রোগীদের চেয়ে বেশি থাকে।

চিকিৎসার পাশাপাশি মৃদু প্রকৃতির ব্যায়াম করা, পুষ্টিবিদের (Dietitian) পরামর্শ মেনে খাবার খাওয়া, মেডিটেশন ও যোগব্যায়াম (Yoga) করা দ্রুত সুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

 

References

Cleveland Clinic. (2021, 11 02). Lymphoma. Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/22225-lymphoma

Nall, R. (2022, 02 08). Everything You Need to Know About Lymphoma. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/lymphoma

Last Updated on December 18, 2023