বুকের বাম পাশে ব্যথা হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো হৃদরোগ। তবে হৃদরোগ ছাড়াও আরো বিভিন্ন কারণে বুকের বাম পাশে ব্যথা হতে পারে। যেমনঃ পাকস্থলীতে অতিরিক্ত গ্যাস, ফুসফুসের কোনো ধরনের রোগ, শ্বাসনালী অথবা খাদ্যনালীর সমস্যা, প্যানিক অ্যাটাক, মানসিক চাপ ইত্যাদি। 

বুকের বাম পাশে ব্যথা হওয়ার কারণ সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও বুকের বাম পাশে ব্যথা হলে করণীয় কি, কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

বুকের বাম পাশে ব্যথা হওয়ার কারণ কি কি? 

বুকের ভেতর হার্ট (মাঝ বরাবর খানিকটা বাম পাশে) ও ফুসফুস (দুই পাশে) থাকে। বুকের বাম পাশে ব্যথা হওয়ার সবচেয়ে কমন কারণ গুলো হলোঃ (Pietrangelo, 2022) 

এনজাইনা (Angina) 

হার্টের পেশীতে রক্ত সরবরাহের জন্য হার্টের গায়ে করোনারি ধমনী রয়েছে। কোনো কারণ বশত করোনারি ধমনীতে রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে তখন হার্টের পেশী রক্ত তথা পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। যার ফলে বুকে ব্যথা হয় যাকে এনজাইনা (Angina) বা এনজাইনা পেক্টোরিস (Angina pectoris) বলা হয়। এনজাইনা হলো করোনারি ধমনী রোগের (Coronary Artery Disease) একটি উপসর্গ। এনজাইনার ফলে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ 

  • বুকে ব্যথা
  • বুকে ভারী অনুভব হওয়া 
  • সাধারণত বাম হাত, বাম কাঁধ, ঘাড়ের বাম পাশে এবং চোয়ালের বাম পাশে ব্যথা হয়ে থাকে 
  • অস্থিরতা দেখা যায় 
  • দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ  
  • শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি  

এনজাইনার ব্যথা সাধারণত বিশ্রাম করা বা নাইট্রোগ্লিসারিন (Nitroglycerin) ঔষধ সেবনের মাধ্যমে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভালো হয়ে যায়। বার বার এনজাইনা হওয়া হার্ট অ্যাটাকের সংকেত দেয়।

হার্ট অ্যাটাক (Heart attack) 

করোনারি ধমনীতে রক্ত সঞ্চালন মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হলে তাকে হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (Myocardial infarction) বলা হয়। রক্ত প্রবাহ না হলে আক্রান্ত হার্টের পেশী মারা যেতে শুরু করে এবং রক্ত প্রবাহ দ্রুত পুনরুদ্ধার করা না হলে হার্ট ফেইলুর হয়ে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। হার্ট অ্যাটাকে সাধারণত বুকের বাম পাশে বা মাঝখানে তীব্র ব্যথা অনুভব হয়। এছাড়াও অন্যান্য লক্ষণগুলো হলোঃ 

  • বুকে চেপে ধরার মতো ব্যথা হয়
  • ব্যথা খুব দ্রুত কাঁধ, বাহু, গলা, চোয়াল, পিঠ এমনকি দাঁত ব্যথা হতে পারে
  • বুকজ্বালা (Heartburn)
  • নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
  • মাথাঘোরা ও ঝিমুনি ভাব
  • বমি বমি ভাব 
  • ক্লান্তি (Fatigue) 
  • ঘেমে যাওয়া ইত্যাদি 

মায়োকার্ডাইটিস (Myocarditis) 

হার্টের পেশীকে মায়োকার্ডিয়াম বলা হয় আর মায়োকার্ডিয়ামে প্রদাহ হলে তাকে মায়োকার্ডাইটিস বলে। এটি হার্টের পেশীকে দুর্বল করে দেয়, যার ফলে হার্ট সঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে পারে না। সাধারণত এটি ভাইরাল সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। মায়োকার্ডাইটিসের লক্ষণগুলো হলোঃ 

  • বুকে‌ ব্যথা 
  • অনিয়মিত হৃদস্পন্দন (Arrhythmia) 
  • শ্বাসকষ্ট 
  • ক্লান্তি 

কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Cardiomyopathy)

কার্ডিওমায়োপ্যাথি হার্টের পেশির আরেকটি রোগ যা মায়োকার্ডাইটিসের প্রভাবেও হতে পারে। কার্ডিওমায়োপ্যাথির লক্ষণ হলোঃ 

  • বুকে ব্যথা 
  • শ্বাসকষ্ট 
  • অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন 
  • মাথাঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া 
  • গোড়ালি, পা, হাত বা পেট ফুলে যাওয়া
  • ক্লান্তি 

পেরিকার্ডাইটিস (Pericarditis) 

পেরিকার্ডিয়াম হলো হার্টের বাইরের দিকে টিস্যুর দুটি পাতলা স্তর যা হার্টকে যথাস্থানে রাখতে সাহায্য করে। পেরিকার্ডাইটিস হলো পেরিকার্ডিয়ামের প্রদাহ। 

পেরিকার্ডাইটিসের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো বুকের বাম পাশে বা মাঝখানে ধারালো ছুরিকাঘাতের মতো ব্যথা অনুভব হয়। এছাড়াও কাঁধে (এক বা উভয় পাশে) ব্যথা হতে পারে। 

বুকজ্বালা, অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা জিইআরডি (Heartburn, Acid reflux, GERD) 

খাবার হজমের জন্য পাকস্থলীতে তীব্র প্রকৃতির (pH 1.5 – 3.5) এসিড নিঃসরণ হয়ে থাকে যা খাদ্যনালীর মাধ্যমে প্রবাহিত হলে বুকে ব্যথা এবং অস্বস্তি হয় যাকে অ্যাসিড রিফ্লাক্স বলা হয়। এর ফলে আরো যেসব লক্ষণ দেখা যায়- 

  • উপরের পেট ও বুকে জ্বালাপোড়া
  • মুখে টক স্বাদ 
  • খাবার গলার দিকে ফিরে আসা 

অ্যাসিড রিফ্লাক্সের প্রভাবে একসময় আরো জটিল সমস্যা তথা গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD) হতে পারে। এক্ষেত্রে বুকজ্বালা ও বুকে‌ ব্যথা সহ খাবার গিলতে সমস্যা হয়।‌ 

নিউমোনিয়া (Pneumonia) 

নিউমোনিয়া হলো ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকজনিত ফুসফুসের ইনফেকশন। নিউমোনিয়ায় বাম ফুসফুস আক্রান্ত হলে বুকের বাম পাশে ব্যথা অনুভব হবে। নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো হলোঃ 

  • কাশি ও শ্বাস নেওয়ার সময় বুকে ব্যথা 
  • কাশির সাথে কফ নির্গত হয় 
  • শ্বাসকষ্ট 
  • জ্বর ও শীত বোধ 
  • ক্লান্তি 
  • বমি বমি ভাব বা বমি 
  • শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়
  • মানসিক অবস্থার পরিবর্তন 

পালমোনারি হাইপারটেনশন (Pulmonary Hypertension) 

হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের সংযোগকারী রক্তনালীতে উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হলে তাকে পালমোনারি হাইপারটেনশন বলা হয়। এর প্রভাবে বুকে ব্যথা সহ আরো যেসব লক্ষণ দেখা যায়- 

  • শ্বাসকষ্ট 
  • মাথাঘোরা
  • অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
  • অনিয়মিত হৃদস্পন্দন 
  • দুর্বলতা ও ক্লান্তি 
  • ঠোঁট ও ত্বক নীল দেখায়
  • পেট ও পা ফুলে যেতে পারে 

পালমোনারি এমবোলিজম (Pulmonary embolism) 

ফুসফুসের ধমনিতে রক্ত ​​​​জমাট বেঁধে যাওয়াকে পালমোনারি এমবোলিজম বলে। এর ফলে সঠিক ভাবে রক্ত প্রবাহিত হতে পারে না বলে বুকে তীব্র ব্যথা হয়। এছাড়াও অন্যান্য লক্ষণগুলো হলোঃ 

  • শ্বাসকষ্ট 
  • অজ্ঞান হয়ে যাওয়া 
  • কাশি, শ্বাস নেওয়া এবং সামনের দিকে ঝুঁকলে বুকে ব্যথা বেশি হয়
  • অতিরিক্ত ঘাম হওয়া 
  • লম্বা শ্বাস নেওয়া যায় না 

ফুসফুস ক্যান্সার (Lung Cancer) 

ফুসফুসের ক্যান্সার অথবা শরীরের অন্য অঙ্গ থেকে ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সারের জন্য বুকে ব্যথা হতে পারে। ফুসফুস ক্যান্সারের অন্যান্য লক্ষণগুলো হলোঃ 

  • প্রচন্ড কাশি 
  • কাশির সাথে রক্ত বের হয় 
  • শ্বাসকষ্ট 
  • বুকে ব্যথা 
  • ব্যথা কাঁধে ও পিঠে ছড়িয়ে পড়ে 
  • শরীরের ওজন কমে যায় 

বুকের পাঁজরে ব্যথা 

বুকের বাম পাশে ব্যথার আরেকটি কারণ হতে পারে পাঁজর ও মাংসপেশীতে আঘাত লাগা। শ্বাস গ্রহণের সময় এবং কাশি দিলে তীব্র ব্যথা হয়। 

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন? 

বুকে ব্যথা হলে স্থির হয়ে বসে অথবা শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে এবং স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর চেষ্টা করতে হবে। তবে নিচের লক্ষণ গুলো দেখা দিলে বুঝতে হবে যে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। যেমনঃ 

  • শ্বাস নিতে সমস্যা হয়
  • দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না 
  • বুকে চাপ বোধ হয়
  • ব্যথা বুকের বাম পাশ থেকে বাহু ও কাঁধে ছড়িয়ে পড়ে
  • ব্যথা সময়ের সাথে সাথে তীব্র হতে থাকে
  • ঘেমে যাওয়া ইত্যাদি

এমতাবস্থায় রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। হার্ট অ্যাটাকে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে করণীয় বিষয়াবলী হলোঃ 

  • Aspirin (Disprin®, Ecosprin®, S pirin®, Solrin®) ৭৫ মিলিগ্রাম ৪ টি ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে। 
  • নাইট্রোগ্লিসারিন (Nitroglycerin) স্প্রে রোগীর জিহ্বার নিচে দিতে হবে। এটি সাময়িক ভাবে হার্টের কোষের অক্সিজেনের চাহিদা কমায় যার ফলে হার্টের পেশী কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।  
  • এছাড়াও রোগীর শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে হলে সেক্ষেত্রে CPR (cardiopulmonary resuscitation) দিতে হবে। 

বুকের বাম পাশে ব্যথা হলে করণীয় কি? 

বুকের বাম পাশে ব্যথার কারণ নির্ণয়ের জন্য ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী কিছু পরীক্ষা করতে হবে। যেমনঃ (Nall, 2019) 

  • ইসিজি (ECG)
  • রক্ত পরীক্ষা (CBC)
  • বুকের এক্সরে (x-ray)
  • আল্ট্রাসনোগ্রাফি
  • এনজিওগ্রাফি ইত্যাদি 

কারণের উপর নির্ভর করে বুকে ব্যথার চিকিৎসা ভিন্নতর হয়ে থাকে। এসিডিটির ফলে বুকে ব্যথা হলে নিয়মমাফিক জীবন যাপন এবং গ্যাসের ঔষধ খেতে হবে। ফুসফুসের সংক্রমণের জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা মোতাবেক এন্টি-বায়োটিক সেবন করতে হয়। আর হার্টের সমস্যা হলে কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। 

 

References

Nall, R. (2019, December 20). What causes chest pain on the left side? Retrieved from Medical new stoday: https://www.medicalnewstoday.com/articles/327375#diagnosis

Pietrangelo, A. (2022, May 06). What’s Causing Pain in the Left Side of My Chest? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/left-chest-pain

 

Last Updated on May 20, 2023