মুখে ঘা (Mouth sores) একটি কমন রোগ যার অনেক গুলো কারণ ও ধরন রয়েছে। মুখের বিভিন্ন অংশ যেমন- ঠোঁট, গালের ভেতরের দিক, মাড়ি, জিহ্বা এবং তালুতে ঘা হতে পারে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের সংক্রমণ, ভিটামিনের অভাব সহ নানাবিধ কারণ রয়েছে মুখের ঘা হওয়ার। এই অনুচ্ছেদে মুখে ঘা এর কারণ, ধরন, লক্ষণ, কখন চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও মুখে ঘা এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
মুখের ঘা দেখতে কেমন?
মুখের ঘা এর অনেক গুলো ধরন রয়েছে যার কোনটির জন্য তেমন গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন হয় না আবার কোনটি অনেক জটিল রোগের ইঙ্গিত বহন করে। যেমনঃ মুখ গহ্বরের ক্যান্সার। মুখের ঘা এর ধরন অনুযায়ী দেখতে সাদা, হলুদ অথবা লাল বর্ণ সহ বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে যা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলোঃ (Roddick, 2022)
Canker sores:
এটি সবচেয়ে কমন এবং নিরাপদ ধরনের ক্ষত যা অ্যাপথাস আলসার নামে পরিচিত। জিহ্বায়, ঠোঁট বা গালের ভেতরের দিকে গোলাকার সাদা, ধূসর অথবা হলুদ বর্ণের একদম ছোট ছোট ক্ষতস্থান তৈরি হয় যার চারপাশে লাল হয়ে থাকে এবং ব্যথা হয়। বিশেষ করে খাবার খাওয়া, ব্রাশ করা ও কথা বলার সময় ক্ষতস্থানে ব্যথা লাগে। তবে এইধরনের ক্ষত ছোঁয়াচে প্রকৃতির নয় এবং সাধারণত ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে আপনাআপনি ভালো হয়ে যায়। ঠোঁট, গাল ও জিহ্বায় দাত দিয়ে কামড় লাগার ফলে অ্যাপথাস আলসার হয়ে থাকে। তবে এর বাইরেও অন্যান্য অনেক কারণে হতে পারে। যেমনঃ দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, হরমোনজনিত সমস্যা, ভিটামিনের অভাব, মানসিক চাপ, ধুমপানের অভ্যাস ইত্যাদি।
জ্বর ঠোসা (Cold sores):
জ্বর ঠোসা দেখতে পানি পূর্ণ ছোট ফোস্কার মতো যা লাল অথবা কালো বর্ণের হয়ে থাকে। এটি সাধারণত ঠোঁটের কোনায় হয় এবং সেই সাথে শরীরে জ্বর, হালকা ব্যথা সহ লিম্ফ নোড ফুলে যেতে দেখা যায়। হার্পিস সিমপ্লেক্স টাইপ-১ ভাইরাস ঘটিত এই রোগটি ছোঁয়াচে প্রকৃতির হয়ে থাকে।
Gingivostomatitis:
মুখ গহ্বরের ভেতর ও মাড়িতে ক্ষত হয় যা অ্যাপথাস আলসারের মতো দেখায়। এটি সাধারণত শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায় যার কারণ হলো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। সাধারণত কোনো চিকিৎসা গ্রহণ করা ছাড়াই ২ থেকে ৩ সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায় এবং নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
Folate deficiency and anemia:
শরীরে ফলেট বা ভিটামিন বি৯ এর অভাব হলে রক্তস্বল্পতার সৃষ্টি হয়। রক্তস্বল্পতার একটি লক্ষণ হিসেবে মুখে ঘা হতে পারে। এই ধরনের মুখের ঘা দেখতে ছোট গোলাকৃতির সাদা, ধূসর, লাল অথবা হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে। ফলেট সমৃদ্ধ খাবার যেমন- সবুজ শাকসবজি, বাদাম, ফলমূল, ডিম, কলিজা এবং সামুদ্রিক মাছ গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়।
Infectious mononucleosis:
EBV (Epstein-Barr virus) ভাইরাসের আক্রমণে হয়ে থাকে যার ফলে মুখের ভেতর বিশেষ করে জিহ্বায় র্যাশ (Rash) হয় যা দেখতে ময়লা জমে আছে বলে মনে হয়। সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায় তবে কখনো কখনো আরো অধিক সময় লাগতে পারে।
Hand, foot, and mouth disease:
এটি ভাইরাস জনিত একটি রোগ যা সাধারণত ৫ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের আক্রান্ত করে। মুখ, জিহ্বা, মাড়িতে লাল বর্ণের ছোট ছোট ফুস্কুড়ি হয় যা হাত ও পায়ের তালুতেও দেখা যেতে পারে। এর পাশাপাশি জ্বর থাকে তবে ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই সমস্যা সমাধানে হয়ে যায়।
জিহ্বায় সাদা প্রলেপ (Oral thrush):
এটি ছত্রাকের সংক্রমণ জনিত একটি সমস্যা যা শিশু বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। জিহ্বায় দুধের মতো সাদা প্রলেপ পড়ে এবং ব্যথা হয় যার ফলে শিশু ঠিকমতো খেতে চায় না। সাধারণত ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে এমনিতেই ভালো হয়ে যায় তবে কখনো কখনো এন্টি ফাংগাল জাতীয় ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হয়ে থাকে।
Leukoplakia:
মুখের ভেতরে সাদা ছোপ ছোপ দেখা যায় যা সাধারণত ধুমপায়ী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। এটি নিরাপদ এবং আপনাআপনি ভালো হয়ে যায়। তবে দীর্ঘদিন ধরে থাকলে তা জটিল কোনো সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে।
Oral lichen planus:
এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহজনিত সমস্যা যার ফলে মুখের ভেতরে সাদা ছোপ ছোপ দেখা যায়। ব্যথা থাকে এবং কখনো কখনো রক্ত বের হতে দেখা যায়। সাধারণত ভালো হয় না তবে ছোঁয়াচে প্রকৃতির নয়।
Celiac disease:
এটি মূলত অন্ত্রের (Intestines) রোগ যার ফলে শরীরে ভিটামিন বি, ভিটামিন ডি, আয়রন, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি শোষণে ব্যঘাত ঘটে এবং ফলশ্রুতিতে রক্তস্বল্পতার সৃষ্টি হয়। আর রক্তস্বল্পতার ফলে মুখে ঘা হয়।
মুখের ক্যান্সার (Mouth cancer):
মুখের ভেতর অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধি যা দেখতে সাদা অথবা লাল বর্ণের ছোপ ছোপ বা ক্ষতের মতো মনে হয় এবং দিন দিন বাড়তে থাকলে তা মুখের ক্যান্সারকে ইঙ্গিত করে। এক্ষেত্রে অন্যান্য লক্ষণ হিসেবে ব্যথা, মাড়ি থেকে সহজেই রক্তপাত, কানে ব্যথা, লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া সহ শরীরের ওজন কমতে থাকে।
Pemphigus vulgaris:
খুব বিরল প্রকৃতির রোগ যা শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিক আচরণ জনিত সমস্যার ফলে হয়ে থাকে। মুখের ভেতর ফোস্কার মতো হয়, ব্যথা ও চুলকানি থাকে এবং সহজেই ফোস্কা ফেটে গিয়ে রক্ত বের হতে দেখা যায়। মুখ ছাড়াও চোখ, নাক সহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এই রোগের আক্রমণ হতে পারে।
কি কারণে মুখ ঘা হয়?
উল্লেখিত ধরন গুলো ছাড়াও আরো যেসব কারণে মুখে ঘা হতে পারে তা হলোঃ
- গাল, ঠোঁট ও জিহ্বায় কামড় লাগা
- চুন বা এমন কোনো খাবার খেয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেলা
- শক্ত ব্রাশ ব্যবহার করা অথবা খুব জোরে জোরে ব্রাশ করা
- ধুমপানের অভ্যাস
- ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের সংক্রমণ
- ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি
মুখের ঘাগুলির লক্ষণগুলি কী কী?
মুখের ঘা এর অনেকগুলো ধরন রয়েছে যা উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে ঘা এর প্রকৃতি নির্ধারণ করা অসাধ্য কাজ। সাধারণ ভাবে মুখের ঘা এর লক্ষণ এতটুকু জানা থাকলে যথেষ্ট যে লাল হয়ে যাওয়া, ব্যথা, খাবার গিলতে অসুবিধা ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়। নিচে উল্লেখিত লক্ষণ গুলো দেখা গেলে সেক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। যেমনঃ
- গভীর ক্ষত
- ঘন ঘন মুখে ঘা হওয়া
- র্যাশ (Rash)
- ব্যথা ও জ্বর
- ডায়রিয়া ইত্যাদি
কীভাবে মুখের ঘা থেকে মুক্তি পাবেন
মুখের ঘা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য যেসব ঘরোয়া পদ্ধতি গুলো সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে তা হলোঃ
- অতিরিক্ত গরম, ঝাল, লবণ, টক ও মিষ্টি পরিহার করা
- কুসুম গরম পানিতে অল্প একটু লবণ মিশিয়ে কুলি করা
- বরফ ও ঠান্ডা খাবার খাওয়া
- ক্ষতস্থানে হাত দেওয়া বা ফোস্কা ফাটানো থেকে বিরত থাকতে হবে
- প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে।
মুখের ঘা চিকিৎসা করা প্রয়োজন?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে মুখের ঘা এমনিতেই ঠিক হয়ে যায়। তবে ঠিক না হলে সেক্ষেত্রে রোগের প্রকৃত কারণ নির্ণয় করে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বিশেষ করে সাদা ছোপ ছোপ দাগ, যেসব ক্ষত সহজে ভালো হয় না, বার বার ফিরে আসে এমন ক্ষেত্রে জটিল কোনো সমস্যার ইঙ্গিত করছে কিনা তা জানার জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। মুখের ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য বায়োপসি করা হয়ে থাকে।
মুখের ঘা কি প্রতিরোধ করা যায়?
মুখের ঘা যেন না হয় সেজন্য কতিপয় ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। যেমনঃ
- তামাক, গুল, জর্দা, বিড়ি, সিগারেট ইত্যাদি বর্জন করতে হবে
- অতিরিক্ত গরম খাবার ও পানীয় পান করা যাবে না
- মনোযোগের সহিত খাবার ধীরে ধীরে চিবিয়ে খেতে হবে যেন মুখে আঘাত তথা কামড় না লাগে
- পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে
- দাত ও মাড়ির কোনো সমস্যা হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে
- মানসিক চাপ কমাতে হবে এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে
মুখের ঘাগুলির কোন দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আছে কি?
মুখের ঘা এর অধিকাংশ ধরন ততটা জটিল নয় এবং দীর্ঘমেয়াদী তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে থাকে। যেমনঃ
- হার্পিসের ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তি ঘটে
- জ্বর ঠোসার পরবর্তীতে দাগ থেকে যেতে পারে
- মুখের ক্যান্সার মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে
মুখের ঘা হলে প্রাথমিক অবস্থায় ঘরোয়া পদ্ধতি অনুসরণ করুন। তাতে কাজ না হলে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ওষুধ সেবন এবং মুখের ভেতরে ক্রিম/জেল ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও জটিল কোনো রোগের ইঙ্গিত মনে হলে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। আর সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য মুখের ঘা প্রতিরোধের নিয়মগুলো মেনে চলা জরুরী।
References
Roddick, J. (2022, May 03). Mouth Sores: Symptoms, Treatment, and Prevention Methods. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/mouth-sores
Last Updated on April 15, 2023
Leave A Comment