মাল্টিপল মায়েলোমা কি? শ্বেত রক্ত কণিকার একটি বিশেষ ধরন হলো প্লাজমা সেল যা বোন ম্যারোতে পাওয়া যায়। এই প্লাজমা সেলের ক্যান্সারকে মাল্টিপল মায়েলোমা (Multiple myeloma) বলা হয় যা একটি বিরল প্রকৃতির ব্লাড ক্যান্সার।
মাল্টিপল মায়েলোমার ক্ষেত্রে প্লাজমা সেল অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সেই সাথে M (Monoclonal) proteins নামক অস্বাভাবিক এন্টিবডি তৈরি করে। এই ধরনের ক্যান্সার লোহিত রক্ত কণিকা, অণুচক্রিকা, কিডনি ও হাড়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এই অনুচ্ছেদে মাল্টিপল মায়েলোমা এর ধরন, কারণ, কাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, কিভাবে রোগ নির্ণয় করা হয় এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
মাল্টিপল মায়েলোমা এর ধরন
মাল্টিপল মায়েলোমা সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথাঃ
ইনডোলেন্ট মায়েলোমা (Indolent Myeloma)
হাড়ে কোনো অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা টিউমার সৃষ্টি করে না। এই ধরনের ক্যান্সার খুব ধীর গতি সম্পন্ন হয়ে থাকে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
সলিটারি প্লাজমাসাইটোমা (Solitary Plasmacytoma)
এই ধরনের ব্লাড ক্যান্সারের ক্ষেত্রে হাড়ে টিউমার হয়। ধীর গতি সম্পন্ন ক্যান্সার এবং চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
মাল্টিপল মায়েলোমা এর কারণ
মাল্টিপল মায়েলোমার প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। কোনো কারণবশত একবার একটি অস্বাভাবিক প্লাজমা সেল তৈরি হলে সেটি থেকে অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনের মাধ্যমে অসংখ্য ক্যান্সার কোষের সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিক কোষের মতো এই কোষগুলোর মৃত্যু হয় না। বরং প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ক্যান্সার কোষগুলো ছড়িয়ে পড়ে।
মাল্টিপল মায়েলোমার ঝুঁকি কাদের ক্ষেত্রে বেশি থাকে?
যেকোনো মানুষের ক্ষেত্রে মাল্টিপল মায়েলোমা হতে পারে। তবে কতিপয় বিষয় এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় যাদেরকে রিস্ক ফ্যাক্টর (Risk factors) বলা হয়। যেমনঃ
- মহিলাদের তুলনায় পুরুষের ক্ষেত্রে মাল্টিপল মায়েলোমায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে।
- সাধারণত ৫০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তবে কম বয়সীদের ক্ষেত্রে হওয়ার সম্ভাবনা নেই এমনটি বলা যায় না।
- শরীরের অতিরিক্ত ওজনের সাথে মাল্টিপল মায়েলোমায় আক্রান্ত হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে।
- যারা টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
- যারা রাসায়নিক উপাদান, সার কারখানা অথবা পেট্রোলিয়াম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকি রয়েছে।
- ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস।
মাল্টিপল মায়েলোমা এর লক্ষণ
মাল্টিপল মায়েলোমার প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে বমি বমি ভাব, ক্লান্তি, হাড়ে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
ইংরেজি বর্ণমালার চারটি বর্ণ (CRAB) দ্বারা মাল্টিপল মায়েলোমার লক্ষণ সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। যথাঃ
C- Calcium
মাল্টিপল মায়েলোমার ক্ষেত্রে হাড় আক্রান্ত হয়ে রক্তে ক্যালসিয়াম নিঃসরণ হয় যার ফলে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়।
- বমি বমি ভাব ও বমি হওয়া
- ঘন ঘন তৃষ্ণা পাওয়া
- পেটে ব্যথা
- ক্ষুধা কমে যাওয়া
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- বিভ্রান্তি (Confusion)
R- Renal
Renal মানে হলো কিডনি। অর্থাৎ M proteins এর প্রভাবে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার লক্ষণ হিসেবে দেখা যায়-
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া
- পায়ে পানি জমে ফুলে যাওয়া
- শ্বাসকষ্ট হওয়া
- ক্লান্তি বোধ ও ঝিমুনি ভাব
- বমি বমি ভাব
- বুকে ব্যথা
- খিঁচুনি
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
A- Anemia
লোহিত রক্ত কণিকার পরিমাণ কমে যায়। যার ফলে রক্তস্বল্পতা (Anemia) হয় যার লক্ষণগুলো হলোঃ
- দুর্বলতা
- ক্লান্তি বোধ
- ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যায়
- খিটখিটে মেজাজ
B- Bone damage
হাড়ের মজ্জা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়। যার ফলে সহজেই হাড় ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। অর্থাৎ সামান্য আঘাতেই শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড় ভেঙে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। সেই সাথে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ
- হাত ও পায়ে ব্যথা
- শিরদাঁড়া ও কোমড়ে ব্যথা
- মাথার খুলিতে ব্যথা ইত্যাদি
এছাড়াও সার্বিকভাবে আরো কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমনঃ শরীরের ওজন কমতে থাকা, শরীরের বিভিন্ন স্থান (নাক, মাড়ি ও পায়ুপথ) থেকে রক্তক্ষরণের প্রবণতা, কোনো কাজ না করেই দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ।
মাল্টিপল মায়েলোমা কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
লক্ষণ দেখে মাল্টিপল মায়েলোমা হয়েছে কিনা সেই সম্পর্কে ধারণা করা খুব কঠিন। সাধারণত এই রোগটি ধরা পড়ে অন্য কোনো রোগের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার করার সময়। যেমনঃ হাড়ে ব্যথা হলে অর্থোপেডিক ডাক্তারের কাছে গিয়ে হাড়ের এক্সরে করার পর যখন দেখা যায় যে, হাড়ের ঘনত্ব অনেক কমে গেছে তখন তাকে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করা হয়। মাল্টিপল মায়েলোমা নির্ণয়ের জন্য যেসব টেস্ট করা হয়ে থাকে তা হলোঃ
- শারীরিক পর্যবেক্ষণ (physical examination)
- রক্ত পরীক্ষা (CBC- Complete blood count)
- প্রস্রাব পরীক্ষা (Urine test)
- Biochemical blood test
- Quantitative immunoglobulin test
- Electrophoresis
- Bone marrow biopsies
- এক্সরে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই
চিকিৎসা
চিকিৎসার মাধ্যমে মাল্টিপল মায়েলোমা একদম ভালো হয়ে যায় না। তবে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ ও লক্ষণের উপশম করার মাধ্যমে রোগী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে সক্ষম হয়।
- ব্যথা নিরাময়ের জন্য ব্যথা নাশক ওষুধ সেবনের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার দরুণ ঘন ঘন ইনফেকশন হয় যার প্রতিকারে এন্টি বায়োটিক ওষুধ সেবনের প্রয়োজন পড়ে।
- প্রদাহ নিরাময়ের জন্য স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
- অস্বাভাবিক প্লাজমা সেল ধ্বংস করার জন্য কেমোথেরাপি দেওয়া হয়।
- ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য রেডিওথেরাপি গ্রহণের প্রয়োজন হতে পারে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেন নিজে থেকে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে পারে সেজন্য ইমিউনোথেরাপি দেওয়া হয়।
- সবচেয়ে উন্নত চিকিৎসা হিসেবে বোন ম্যারো ট্র্যান্সপ্লান্ট করার অপশন রয়েছে যা রোগীর শরীর থেকে স্টেম সেল নিয়ে অথবা অন্য কারো স্টেম সেল সংগ্রহ করে সম্পন্ন করা যেতে পারে।
মাল্টিপল মায়েলোমার রোগীদের জন্য সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের সান্নিধ্যে থাকতে হবে। অর্থাৎ সবসময়ের জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে এবং কখনো কোনো সমস্যা দেখা গেলে সাথে সাথে তা চিকিৎসককে অবহিত করতে হবে।
Bibliography
Cleveland Clinic. (2022, 5 4). Multiple Myeloma. Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/articles/6178-multiple-myeloma
Thomas, T. H. (2022, 12 7). What Is Multiple Myeloma? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/multiple-myeloma
Last Updated on October 31, 2023
Leave A Comment