ব্যথানাশক ঔষধ কি

ব্যথানাশক ঔষধ (Analgesics) অথবা পেইনকিলার বলতে এমন ওষুধগুলোকে বোঝানো হয় যা ব্যথার কারণ নির্ণয় করা ছাড়াই সেবন করার মাধ্যমে ব্যথার অনুভূতি কমাতে সাহায্য করে। ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, সিরাপ, ইনজেকশন, ক্রিম, জেল, স্প্রে ও সাপোজিটরি সহ বিভিন্ন ফর্মে ব্যথানাশক ঔষধ পাওয়া যায়। আবার ব্যথানাশক ঔষধের রয়েছে বিভিন্ন ধরন (Types) যার কোনোটি চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়াই সেবন করা যায় আবার কোনোটির জন্য চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কখন কোন ধরনের ব্যথানাশক ঔষধ সেবন করতে হবে, ব্যথানাশক‌ ঔষধ শরীরে প্রবেশ করার পর কিভাবে কাজ করে, ঔষধের ক্ষতিকর প্রভাব কি কি এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে সেই বিষয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।‌

কিভাবে ব্যথানাশক ঔষধ কাজ করে?

ব্যথানাশক ঔষধের বৈশিষ্ট্য হলো এটি ঘুম ও অচেতনতা সৃষ্টি না করে শরীরে ব্যথা ও প্রদাহের অনুভূতি হ্রাস করতে পারে। এই ঔষধ সেবনের জন্য ব্যথার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা জরুরী নয়। ব্যথানাশক ঔষধের অনেকগুলো ধরন রয়েছে যার একেকটি একেক ভাবে ব্যথা নিরাময় করে থাকে। যেমনঃ (Cleveland Clinic, 2021)

এসিটামিনোফেন (Acetaminophen)

এসিটামিনোফেন গ্রুপের একটি ঔষধের নাম হলো প্যারাসিটামল যা মস্তিষ্কে ব্যথার অনুভূতি রিসিপ্টরের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় যার ফলে ব্যথা কম অনুভব হয়। এটি শুধুমাত্র মৃদু প্রকৃতির ব্যথার ক্ষেত্রে ভালো কাজ করে থাকে তবে প্রায় সবার জন্যই এটি তুলনামূলক নিরাপদ প্রকৃতির ঔষধ। 

এনএসএআইডি (NSAIDs)

শরীরে ব্যথা ও প্রদাহ কমানোর জন্য সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত ওষুধ হলো NSAIDs যার পূর্ণরূপ হলো Nonsteroidal anti-inflammatory drugs অর্থাৎ এটি স্টেরয়েড গ্রুপের ওষুধ নয় তবে ব্যথা ও প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে। আমাদের শরীরে ব্যথার অনুভূতি সৃষ্টিকারী একটি হরমোন সদৃশ রাসায়নিক উপাদান হলো prostaglandins যা নার্ভে ব্যথা ও প্রদাহের অনুভূতি সৃষ্টি করে থাকে। NSAIDs গ্রুপের ঔষুধ শরীরে প্রবেশ করে এই হরমোনের উৎপাদন কমায় যার ফলে ব্যথা ও প্রদাহ কমে যায়। এসপিরিন, আইবুপ্রোফেন ও ন্যাপরোক্সেন হলো NSAIDs গ্রপের ঔষধ।  

কম্বিনেশন (Combination)

কিছু কিছু ব্যথানাশক ঔষধ রয়েছে যা এসিটামিনোফেন ও NSAIDs গ্রুপের ঔষধের সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়েছে। আবার এসিটামিনোফেন ও ক্যাফেইনের সংমিশ্রণে তৈরি কম্বিনেশন ঔষধ পাওয়া যায় যা মাথাব্যথার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ক্যাফেইন মস্তিষ্কে ব্যথার অনুভূতি কমাতে সাহায্য করে থাকে। এই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত একটি ঔষধ হলো নাপা এক্সট্রা যা ৫০০ মিগ্রা প্যারাসিটামল ও ৬৫ মিগ্রা ক্যাফেইনের সংমিশ্রণে তৈরি। 

বাহ্যিক ব্যবহারের ঔষধ (Topical)

ব্যথার স্থানে বাহ্যিকভাবে ক্রিম, জেল বা স্প্রে আকারে পাওয়া ঔষধ ব্যবহার করা হয় যা ব্যথার স্থানের স্নায়ুর অনুভূতি কমানো অথবা ত্বকে ঠান্ডা/গরমের অনুভূতি সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যথা নিরাময়ে সাহায্য করে।

Antidepressants 

এই গ্রুপের ঔষধগুলো মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের উপর কাজ করে এবং দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা নিরাময়ের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়ে থাকে। 

Anti-seizure medications

এটি মস্তিষ্কে ব্যথার অনুভূতি পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করার মাধ্যমে কাজ করে থাকে। 

Muscle relaxers

মাংসপেশীকে শিথিল করার মাধ্যমে ব্যথা নিরাময় করে থাকে। বিশেষ করে মাশল স্পাজম (Muscle spasm) এর ক্ষেত্রে কার্যকর হয়ে থাকে। 

Opioids

মস্তিষ্কের ব্যথার অনুভূতি গ্রহণের ক্ষমতা পরিবর্তনের মাধ্যমে তীব্র ব্যথার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। 

স্টেরয়েড (Steroids) 

স্টেরয়েড হলো সবচেয়ে শক্তিশালী প্রদাহ নাশক ঔষধ যা শরীরে ব্যথার অনুভূতি সৃষ্টিকারী রাসায়নিক উপাদান তৈরি করতে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে কাজ করে থাকে।  

ব্যথানাশক ঔষধ কি জন্য ব্যবহৃত হয়?

আঘাত সহ‌ নানাবিধ রোগের কারণে শরীরে ব্যথার অনুভূতি হতে পারে। আবার শরীরের কিছু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার (যেমনঃ পিরিয়ড) ক্ষেত্রেও ব্যথা হতে পারে। ব্যথানাশক ঔষধ ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলোঃ 

  • আর্থ্রাইটিস (Arthritis)
  • কোমড় ব্যথা (Back pain)
  • হাত ও পায়ের মচকানো ব্যথা 
  • পুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানের ব্যথা
  • মাথাব্যথা 
  • ফ্লু, ঠান্ডা লাগা ও কানে ব্যথা
  • ঘাড়ে ব্যথা  
  • মাংসপেশিতে ব্যথা
  • মাসিকের ব্যথা 
  • দাঁত ব্যথা ইত্যাদি 

এছাড়াও জটিল প্রকৃতির কিছু সমস্যার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব ঔষধের পাশাপাশি ব্যথা কমানোর জন্য চিকিৎসকেরা কিছু ব্যথানাশক‌ ঔষধ সেবনের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এমন কতগুলো ক্ষেত্র হলোঃ

  • মাইগ্রেন (Migraine)
  • Fibromyalgia 
  • diabetes-related neuropathy
  • সার্জারি পরবর্তী ব্যথা 
  • বড় ধরনের আঘাত লাগা 
  • আর্থ্রাইটিসের তীব্র ব্যথা
  • ক্যান্সার ইত্যাদি

কিভাবে ব্যথানাশক ঔষধ গ্রহণ করা যায়?

ব্যথানাশক ঔষধ সংগ্রহ করার দুটি পদ্ধতি রয়েছে। যেমনঃ

  • ওটিসি মেডিসিন (OTC- over the counter) চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়াই ফার্মেসি থেকে সংগ্রহ করে সেবন করা যায়। তবে একটানা দীর্ঘদিন ধরে ওটিসি মেডিসিন খাওয়া যাবে না। ওটিসি মেডিসিনের অন্তর্ভুক্ত ঔষধগুলো হলো এসিটামিনোফেন, NSAIDs, কম্বিনেশন, ক্রিম বা জেল ইত্যাদি। 
  • প্রেসক্রিপশন মেডিসিন সংগ্রহ করার জন্য একজন চিকিৎসকের নির্দেশনা লাগে। এসিটামিনোফেন, NSAIDs, কম্বিনেশন ও ক্রিম ব্যতীত বাকি সবগুলো ঔষধ প্রেসক্রিপশনের অন্তর্ভুক্ত। 

ব্যথা নিরাময়ের জন্য বিভিন্নভাবে ঔষধ সেবন করা যেতে পারে। যেমনঃ 

  • ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল ঔষধগুলো ভরাপেটে মুখে সেবন করতে হবে।
  • ছোট বাচ্চাদের জন্য তরল সিরাপ ঔষধ পাওয়া যায় যা ভরাপেটে খেতে হবে। 
  • দ্রুত ব্যথা নিরাময়ের জন্য তরল ব্যথানাশক ঔষধ শিরা অথবা মাংসপেশিতে ইনজেকশন দেওয়া হয়। 
  • পাউডার ঔষধ হলে পরিমাণ মতো পানিতে গুলিয়ে খেতে হবে। 
  • ব্যথার স্থানে বাহ্যিকভাবে ক্রিম বা জেল ব্যবহার করা হয়।
  • ব্যথানাশক সাপোজিটরি পায়ুপথে ব্যবহার করা হয়।

ব্যথার ওষুধ কি কিছুক্ষণ পরে কাজ করা বন্ধ করে দেয়?

ব্যথানাশক ঔষধের ধরন ও সেবনের নিয়ম অনুযায়ী কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে তারতম্য দেখা যায়। যেমনঃ আইবুপ্রোফেন ট্যাবলেট সেবনের ৩০ মিনিটের মধ্যে কাজ শুরু করে এবং পরবর্তী ৪ থেকে সর্বোচ্চ ৬ ঘন্টা পর্যন্ত কার্যকর থাকে। আবার একই ঔষধ ইনজেকশনের মাধ্যমে অথবা সাপোজিটরি হিসেবে নেওয়া হলে আরো দ্রুত কাজ শুরু করে। 

ব্যথার ঔষধের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঔষধের প্রতি শরীরের সংবেদনশীলতা। যারা দীর্ঘদিন যাবত ব্যথার ঔষধ সেবন করেন তাদের ক্ষেত্রে ঔষধের প্রতি সংবেদনশীলতা কমে যেতে থাকে যাকে tolerance বলা হয়। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাত্রায় ঔষধ সেবন করার প্রয়োজন পড়ে। 

ব্যথানাশক ঔষধ গ্রহণ করার ঝুঁকি কি কি?

অন্যান্য সব ঔষধের মতোই ব্যথানাশক ঔষধ সেবন করার ফলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। যেমনঃ (Ames, 2022)

  • বুকজ্বালা
  • হজমের সমস্যা
  • বমি বমি ভাব অথবা বমি 
  • ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য
  • মাথাব্যথা ও ঝিমুনিভাব 
  • ত্বকে র‍্যাশ‌ (Rash) হওয়া 
  • পাকস্থলীতে আলসার
  • লিভারের সমস্যা 
  • কিডনি ড্যামেজ হওয়া 

এছাড়াও অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যথানাশক ঔষধ সেবন করা হলে কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। ঔষধের ধরন অনুযায়ী সৃষ্ট ঝুঁকি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। যেমনঃ 

  • এসিটামিনোফেন লিভারের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে উচ্চ মাত্রায় এসিটামিনোফেন (দিনে ৩ হাজার মিলিগ্রামের বেশি) সেবন করা হলে লিভার‌ ড্যামেজ হতে পারে। 
  • ১৮ বছরের কম বয়সীদের জন্য এসপিরিন সেবন‌ করা যাবে না। কারণ, তাতে Reye’s Syndrome নামক একধরনের জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে। 
  • এছাড়াও NSAIDs গ্রুপের অন্যান্য ঔষধগুলো দীর্ঘদিন ধরে সেবন করা হলে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত একটানা ১০ দিনের বেশি সময় ধরে NSAIDs গ্রুপের ঔষধ সেবন করা যাবে না। 
  • ব্যথানাশক প্রেসক্রিপশন মেডিসিন গুলোর স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়া, অনিদ্রা, ক্লান্তি, প্রস্রাবের সমস্যা, ওজন কমতে থাকা, মানসিক সমস্যা ইত্যাদি। 

গর্ভবতী নারীদের জন্য ওটিসি মেডিসিনের অন্তর্ভুক্ত এসিটামিনোফেন সেবন করা নিরাপদ তবে NSAIDs গ্রুপের ঔষধগুলো সেবনের ফলে গর্ভস্থ বাচ্চার গঠনগত ত্রুটি হতে পারে। শিশুকে বুকের দুধ পান করান এমন মায়েদের জন্য ওটিসি মেডিসিনের অন্তর্ভুক্ত সব ঔষধ সেবন‌ করা নিরাপদ। 

ব্যথানাশক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য কখন ডাক্তার দেখানো উচিত? 

ব্যথানাশক ঔষধ চলাকালীন সময়ে যে সমস্ত অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে তা হলোঃ

  • সারা শরীরে র‍্যাশ‌ (Rash) হওয়া 
  • শরীর ফুলে যাওয়া 
  • কালো বর্ণের পায়খানা হওয়া 
  • বমির সাথে রক্ত ক্ষরণ 
  • তীব্র পেট ব্যথা অথবা মাথাব্যথা
  • শুনতে বা দেখতে সমস্যা
  • প্রস্রাব না হওয়া
  • শরীরের ওজন অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া ইত্যাদি 

ব্যথানাশক ঔষধের যত্রতত্র ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, অতিরিক্ত ব্যথানাশক সেবন করা হলে শরীরে ঔষধের কার্যকারিতা কমে যাওয়া সহ নানাবিধ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এছাড়াও কিডনি ও লিভারের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা ব্যতীত ব্যথানাশক ঔষধ সেবন করা যাবে না। 

References

Ames, H. (2022, June 28). What to know about analgesics. Retrieved from medical news today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/analgesics#side-effects

Cleveland Clinic. (2021, 04 13). Pain Relievers. Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/treatments/12058-pain-relievers

Last Updated on April 12, 2023