থ্যালাসেমিয়া একটি জিনঘটিত রোগ যা বংশানুক্রমে মা-বাবা থেকে সন্তানদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এটি একটি রক্তের রোগ যার প্রধান লক্ষণ হলো এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা। এনিমিয়ার জন্য আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য আয়রন সাপ্লিমেন্ট প্রযোজ্য নয়। বরং থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।  

থ্যালাসেমিয়া জনিত রক্তস্বল্পতা দূর করার জন্য করণীয় কি, এক্ষেত্রে আয়রন সাপ্লিমেন্ট কেন প্রযোজ্য নয়, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত কেউ আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে কি হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

থ্যালাসেমিয়ার‌ রোগীদের জন্য আয়রন সাপ্লিমেন্ট 

লোহিত রক্ত কণিকার (রক্তের কোষ) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো হিমোগ্লোবিন যা অস্থিমজ্জায় তৈরি হয় এবং হিমোগ্লোবিনের কাজ হলো ফুসফুস থেকে শরীরের সকল কোষে অক্সিজেন পরিবহন করা। 

হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের জন্য আয়রনের প্রয়োজন হয় যা বিভিন্ন খাবার থেকে পাওয়া যায়। পর্যাপ্ত আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা না হলে হিমোগ্লোবিন উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং রক্তস্বল্পতা দেখা যায় যাকে আয়রনের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা (Iron deficiency anemia) বলা হয়। এই জাতীয় রক্তস্বল্পতার চিকিৎসা হলো আয়রন সাপ্লিমেন্ট (যেমনঃ আয়রন বড়ি) গ্রহণ করা এবং সেই সাথে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার বেশি বেশি খাওয়া যেন শরীরে আয়রনের চাহিদা পূরণ হয়।  

থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে জিনগত ত্রুটি থাকার ফলে হাড়ের অস্থিমজ্জা থেকে ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়। লোহিত রক্ত কণিকার আয়ুস্কাল ১২০ দিন অর্থাৎ ১২০ দিন পর লোহিত রক্ত কণিকা ভেঙে যায়। তবে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের কারণে স্বাভাবিক আয়ুস্কালের অনেক আগেই লোহিত রক্ত কণিকা ভেঙে যায়। ফলে রক্তস্বল্পতা দেখা যায়। তবে এক্ষেত্রে রক্তস্বল্পতার সাথে শরীরে আয়রনের অভাবের কোনো যোগসূত্র থাকে না।

বরং লোহিত রক্ত কণিকা ভেঙে যাওয়ার পর শরীরে কিছু আয়রন নিঃসৃত হয়‌। তাই থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণ লোহিত রক্ত কণিকা ভেঙে রক্তস্বল্পতার সৃষ্টি হয় এবং একইসাথে শরীরে আয়রনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। 

সাধারণত রক্তস্বল্পতার রোগীদের ক্ষেত্রে শরীরে আয়রনের ঘাটতি থাকে। তবে থ্যালাসেমিয়া জনিত রক্তস্বল্পতায় শরীরে‌ আয়রনের ঘাটতি নয়, বরং আয়রনের পরিমাণ বাড়তে দেখা যায়। তাই থ্যালাসেমিয়া রোগীদের রক্তস্বল্পতা দূর করার জন্য আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা কোনো উপকারিতা বয়ে আনতে পারে না,‌ বরং ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

প্রশ্ন হলো তাহলে থ্যালাসেমিয়া জনিত রক্তস্বল্পতা দূর করতে করণীয় কি?

থ্যালাসেমিয়া জনিত রক্তশূন্যতার চিকিৎসা

bag of blood

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য রক্তস্বল্পতা একটি কমন সমস্যা। অর্থাৎ সারাবছর ধরেই শরীরে রক্তস্বল্পতার লক্ষণ (দুর্বলতা, ক্লান্তিবোধ, ত্বক ফ্যাকাশে বর্ণের হয়ে যাওয়া, শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া ইত্যাদি) দেখা যায়। এছাড়াও রক্ত পরীক্ষায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অনেক কম দেখা যায়। তাই রক্তস্বল্পতা দূর করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। 

নিয়মিত রক্ত দেওয়া

থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তস্বল্পতা দূর করার জন্য নিয়মিত রক্ত দিতে হয়। অর্থাৎ একই রক্তের গ্রুপের দাতার (ব্লাড ডোনার) শরীর থেকে রক্ত সংগ্রহ করে শিরার মাধ্যমে রোগীর শরীরে রক্ত সরবরাহ করতে হয়। রোগের তীব্রতা অনুযায়ী ২ থেকে ৪ সপ্তাহ অন্তর অন্তর রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।

আয়রন চিলেশন

থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের দীর্ঘদিন ধরে রক্ত দেওয়ার ফলে শরীরে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে যেতে থাকে। তাই শরীর থেকে অতিরিক্ত মাত্রার আয়রন নিষ্কাশনের জন্য ওষুধ সেবন বা আয়রন চিলেশন করতে হয়।

আয়রন সমৃদ্ধ খাবার বর্জন 

আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যতটা সম্ভব বর্জন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। যেমনঃ কলিজা, গরুর মাংস, মুরগির মাংস, ডিমের কুসুম, সামুদ্রিক মাছ, ছোলা, ডাল, শিমের বিচি, মটরশুটি, মিষ্টি কুমড়ার বিচি, পালংশাক, কচু শাক, ডার্ক চকলেট, কিসমিস, খেজুর, বাদাম ইত্যাদি।

সার্জারী

থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা হিসেবে সার্জারীর মাধ্যমে প্লীহা অপসারণ (Splenectomy) করা হয়। এছাড়াও অস্থিমজ্জার সার্জারী (বোন ম্যারো ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট) ব্যবস্থা রয়েছে। (Mayo Clinic, 2021) 

থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত কেউ আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে কি হবে? 

থ্যালাসেমিয়ার অনেকগুলো ধরন বা প্রকরণ রয়েছে যার মধ্যে কোনোটি একদম মৃদু প্রকৃতির যেগুলোর জন্য কখনো কখনো আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের প্রয়োজন হতে পারে। যেমনঃ বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে গর্ভকালীন সময়ে শরীরে আয়রনের অভাব দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হয়। (Kubala, 2023) 

তবে প্রকৃত থ্যালাসেমিয়া (বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর) রোগীদের জন্য আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তারপরেও ভুলবশত কেউ যদি আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করে তাহলে শরীরে আয়রনের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে যাকে আয়রন ওভারলোড (Iron overload) বলা হয়। 

আয়রন ওভারলোড 

iron supplement

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের শরীরে আয়রনের মাত্রা জানার জন্য ফেরিটিন টেস্ট করা হয়। আয়রন শরীরে ফেরিটিন হিসেবে জমা থাকে যার স্বাভাবিক মাত্রা হলো ২৬ থেকে ৪০০ ন্যানোগ্রাম পার মিলিলিটার। এই মাত্রা ৪০০ এর চেয়ে বেশি হলে তা আয়রন ওভারলোড হিসেবে ধরা হয়।

আয়রনের মাত্রা বেড়ে গেলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে স্বাভাবিক মাত্রায় হরমোন নিঃসরণ ব্যাহত হয়। এছাড়াও তীব্র পর্যায়ে লিভার ও হার্ট ফেইলিউর হতে পারে।

আয়রন ওভারলোড এড়াতে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য নিয়মিত ফেরিটিন টেস্ট করতে হবে। এছাড়াও চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কখনো আয়রন সাপ্লিমেন্ট (ট্যাবলেট বা ইনজেকশন) গ্রহণ করা যাবে না।

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ

থ্যালাসেমিয়া খুব সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য বিয়ের পূর্বে থ্যালাসেমিয়া টেস্ট করতে হবে এবং দুইজন থ্যালাসেমিয়ার বাহকের বিয়ে দেওয়া যাবে না। 

একজন বাহক এবং একজন সুস্থ ব্যক্তির বিয়ে হলে সেক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর জন্ম হয় না। 

শেষ কথা

আয়রনের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতায় আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। তবে থ্যালাসেমিয়া জনিত রক্তস্বল্পতায় আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা হলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। তাই থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে এবং আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না। 

Bibliography

Kubala, J. (2023, March 02). What to Know About Iron Supplements for Thalassemia. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/anemia/thalassemia-and-iron-supplements

Mayo Clinic. (2021, November 17). Thalassemia. Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/thalassemia/diagnosis-treatment/drc-20355001

Last Updated on January 7, 2024