ভার্টিগো কি? ভার্টিগো (Vertigo) হলো মস্তিষ্কের ভারসাম্যহীনতা জনিত মাথা ঘোরা যা নিজে কোনো রোগ নয় বরং অন্য রোগের লক্ষণ। বিভিন্ন কারণে ভার্টিগো হতে পারে যার মধ্যে সবচেয়ে কমন একটি কারণ হলো মধ্যকর্ণের (Inner Ear) সমস্যা। 

ভার্টিগো আক্রান্ত রোগীর কাছে মনে হয় যেন চারপাশ ঘুরছে অথবা চারপাশ স্থির রয়েছে কিন্তু মাথা ঘুরছে। এই অনুচ্ছেদে ভার্টিগোর কারণ, প্রকারভেদ, লক্ষণ সমূহ, রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও গর্ভকালীন ভার্টিগো এবং ভার্টিগো বংশগত কিনা তা জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

ভার্টিগোর প্রকারভেদ 

ভার্টিগো দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথাঃ

পেরিফেরাল ভার্টিগো (Peripheral vertigo)

ভার্টিগো মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত কোনো কারণে না হলে তাকে পেরিফেরাল ভার্টিগো বলা হয়। এই ধরনের ভার্টিগো মধ্যকর্ণের সমস্যার ফলে তথা কানের ভেস্টিবুলার নার্ভের সমস্যার ফলে হয়ে থাকে। 

সেন্ট্রাল ভার্টিগো (Central vertigo)

সেন্ট্রাল বলতে মস্তিষ্ককে বোঝানো হয়েছে অর্থাৎ মস্তিষ্কের যে অংশ শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার কাজ করে সেই অংশে কোনো সমস্যা হলে এই ধরনের ভার্টিগো হয়ে থাকে। যেমনঃ মাইগ্রেন, ব্রেইন টিউমার, স্ট্রোক, মস্তিষ্কে আঘাত লাগা ইত্যাদি। 

ভার্টিগোর প্রধান কারণগুলি কি কি?

যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে ভার্টিগো হতে পারে তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি রয়েছে ৬৫ বছরের বেশি বয়স্কদের ক্ষেত্রে। ভার্টিগোর প্রধান কারণগুলো সম্পর্কে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ (Cleveland Clinic, 2021) 

BPPV (Benign paroxysmal positional vertigo)

BPPV হলো মধ্যকর্ণের একটি সমস্যা যার ফলে সবচেয়ে বেশি ভার্টিগো হয়ে থাকে। মাথার পজিশন পরিবর্তন হওয়া অর্থাৎ শুয়ে থাকার পর উঠে বসা অথবা বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানোর পর মাথা ঘোরা হলো এই ধরনের ভার্টিগোর প্রধান লক্ষণ। এটি খুব জটিল ধরনের কোনো সমস্যা নয় বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপনাআপনি ভালো হয়ে যায়। 

Meniere’s disease 

মধ্যকর্ণে অতিরিক্ত পরিমাণে তরল জমা হওয়ার ফলে এই ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। এটি ভার্টিগো সৃষ্টি করা সহ শ্রবণশক্তি নষ্ট হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

Labyrinthitis

মধ্যকর্ণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো Labyrinth যেখানে ইনফেকশন বা প্রদাহ হলে মেডিকেলের ভাষায় Labyrinthitis বলা হয়। এক্ষেত্রে একটানা দীর্ঘক্ষণ মাথা ঘোরা হয় এবং মাথা ঘোরার ধরন তীব্র প্রকৃতির হয়ে থাকে।‌ এছাড়াও কানে ব্যথা, কানে কম শোনা, মাথাব্যথা সহ দৃষ্টিশক্তির সমস্যা হয়।

Vestibular neuritis

কানের ভেতরে থাকা ভেস্টিবুলার নার্ভের প্রদাহ হলে Vestibular neuritis বলা হয়। এক্ষেত্রে মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব এবং দৃষ্টিশক্তির সমস্যা হয় তবে শ্রবণশক্তি ঠিক থাকে।

Cholesteatoma

এটি একটি বিরল রোগ যেখানে মধ্যকর্ণে অস্বাভাবিক কোষ বিভাজন হয় তথা ছোট টিউমার হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ভার্টিগো সহ শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া লক্ষণগুলো দেখা যায়। 

উল্লেখিত বিষয়গুলো ছাড়াও আরো যেসব কারণে ভার্টিগো হতে পারে তা হলোঃ

  • স্ট্রোক
  • মাইগ্রেন
  • হার্টের অস্বাভাবিক স্পন্দন
  • ডায়াবেটিস  
  • মাথায় আঘাত লাগা
  • দীর্ঘসময় শুয়ে কাটানো
  • কানের ভেতরে দাদ হওয়া
  • কানে সার্জারির ইতিহাস
  • কানের ভেতর পুঁজ হওয়া
  • কানের ভেতর হাড় বেড়ে যাওয়া
  • কানের ভেতর টিউমার
  • রক্তচাপ কমে যাওয়া
  • সিফিলিসের প্রভাব
  • উদ্বিগ্নতা বা প্যানিক অ্যাটাক
  • মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস 
  • ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

ভার্টিগোর প্রধান লক্ষণ কি কি?

ভার্টিগোর প্রধান লক্ষণ হলো মাথা ঘোরা যা মাথার অবস্থানের পরিবর্তন সহ অতিরিক্ত আলো, শব্দ ইত্যাদির প্রভাবে বেড়ে যেতে পারে। মাথা ঘোরা ছাড়াও ভার্টিগোর ক্ষেত্রে আরো যেসব লক্ষণ থাকতে পারে তা হলোঃ

  • মাথাব্যথা
  • বমি বমি ভাব 
  • বমি হওয়া
  • শরীরের ভারসাম্যহীনতা
  • কানে ব্যথা
  • কানের ভেতর শব্দ হওয়া
  • শ্রবণশক্তির সমস্যা
  • দৃষ্টিশক্তির সমস্যা
  • অতিরিক্ত ঘাম হওয়া ইত্যাদি

ভার্টিগোর প্রধান লক্ষণ মাথা ঘোরার তীব্রতা ও সময়কাল রোগের কারণ এবং রোগী ভেদে ভিন্নতর হয়ে থাকে। সাধারণত ভার্টিগোর লক্ষণ কয়েক সেকেন্ড থেকে শুরু করে কয়েক মিনিট অথবা ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। 

ভার্টিগো কোনো জটিল সমস্যা নয় তবে যেসব কারণে ভার্টিগো হয়ে থাকে সেগুলোর মধ্যে কিছু জটিল সমস্যা রয়েছে যার জন্য যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। তীব্রতর মাথাঘোরা সহ বমি হওয়া, ঘন‌ ঘন ভার্টিগো আক্রমণ এবং দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার জন্য যত দ্রুত সম্ভব একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

ভার্টিগো রোগ নির্ণয়

ভার্টিগো চিকিৎসার প্রথম ও প্রধান ধাপ হলো রোগের কারণ নির্ণয় করা। অর্থাৎ ঠিক কি কারণে ভার্টিগো হচ্ছে তা জানা জরুরী। এর জন্য চিকিৎসক শারীরিক পর্যবেক্ষণ এবং পরবর্তীতে কতিপয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। যেমনঃ

  • মস্তিষ্কের সিটিস্ক্যান (CT scan) অথবা এমআরআই (MRI)
  • Fukuda-Unterberger’s test
  • Vestibular test battery
  • Head impulse test
  • Romberg’s test

ভার্টিগোর চিকিৎসা

ভার্টিগোর কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্নতর হয়ে থাকে। ভার্টিগোর জন্য যেসব চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে তা হলোঃ

ওষুধ

ভার্টিগোর লক্ষণ সমূহ (মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, বমি, মোশন সিকনেস ইত্যাদি) নিরাময়ের জন্য Meclizine ওষুধটি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে এই ওষুধটি যেসব নামে কিনতে পাওয়া যায় তা হলোঃ

  • Acliz®
  • Avert®
  • Clizin®
  • Emezin®
  • Meczin®
  • Melizin®
  • Nomosic®

Meclizine ওষুধটি প্রেসক্রিপশন মেডিসিনের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ চিকিৎসকের নির্দেশনা ব্যতীত সেবন করা যাবে না।

ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশন জনিত কারণে ভার্টিগো হলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসক এন্টি বায়োটিক (Antibiotic) সেবনের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তবে ভাইরাসের ইনফেকশন হলে সেক্ষেত্রে এন্টি বায়োটিক ওষুধ কাজে দেবে না।

ব্যায়াম 

ভার্টিগোর লক্ষণ নিরাময়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করা সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যায়ামের দ্বারা মূলত শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। তবে এটি কোনো সাধারণ প্রকৃতির ব্যায়াম নয় বরং এর জন্য একজন ফিজিওথেরাপিস্টের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন পড়ে।

সার্জারি

সাধারণত জটিল ধরনের ভার্টিগোর ক্ষেত্রে সার্জারি করার প্রয়োজন হয়ে থাকে। যেমনঃ কানের ভেতর অস্বাভাবিক কোষ বা হাড় বৃদ্ধি হওয়া, ব্রেন টিউমার, ঘাড়ের হাড়ের (Cervical spine) সমস্যা ইত্যাদি।

গর্ভাবস্থায় ভার্টিগো 

পুরুষ মানুষের তুলনায় মহিলাদের ক্ষেত্রে ভার্টিগোতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে ভার্টিগো হওয়া একটি কমন ঘটনা। 

গর্ভাবস্থায় মাথাঘোরা ও বমি বমি ভাব হওয়া প্রায় প্রত্যেক নারীর ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। শরীরে হরমোনের পরিবর্তন, দীর্ঘসময় ধরে শুয়ে থাকা, মেটাবলিসমে পরিবর্তন হওয়া ইত্যাদির ফলে গর্ভাবস্থায় ভার্টিগো হয়ে থাকে। (Krause, 2021)

গর্ভকালীন সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ভার্টিগোর ওষুধ সেবন করা যাবে না।

সচরাচর জিজ্ঞাসা সমূহ

ভার্টিগো কি বংশগত?

ভার্টিগোর অনেকগুলো কারণ রয়েছে যার মধ্যে কোনোটি বংশগত আবার কোনোটি বংশগত নয়। ইনফেকশন জনিত ভার্টিগোর ক্ষেত্রে ইনফেকশন বংশগত প্রভাবে হয় না। আবার মাইগ্রেন একটি বংশগত রোগ যার ফলে ভার্টিগো হয়ে থাকে। তাই ভার্টিগো বংশগত কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলার জন্য আগে কারণ সম্পর্কে জানতে হবে। 

মানসিক চাপের ফলে ভার্টিগো হতে পারে কি?

মানসিক চাপের সাথে ভার্টিগোর সরাসরি কোনো যোগসূত্র নেই। তবে পরোক্ষভাবে মানসিক চাপ ভার্টিগো সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেমনঃ মানসিক চাপের প্রভাবে মধ্যকর্ণের সমস্যা হয়ে থাকে যা ভার্টিগোর অন্যতম প্রধান কারণ। আবার অতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলে স্ট্রোক হতে পারে যা ভার্টিগো সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত।

ভার্টিগোর জন্য কোন ডাক্তার দেখাতে হবে?

ভার্টিগো সমস্যার জন্য সর্বপ্রথম একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ ভার্টিগোর সবচেয়ে কমন কারণ হলো কানের সমস্যা। তবে মস্তিষ্কের সমস্যার দরুণ ভার্টিগো হলে সেক্ষেত্রে নাক কান গলা চিকিৎসক একজন নিউরোলজিস্টের কাছে রেফার করেন।

References

Cleveland Clinic. (2021, September 09). Vertigo. Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/21769-vertigo

Krause, L. (2021, November 30). Vertigo: Symptoms, Causes, Treatment, and More. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/vertigo

 

Last Updated on May 21, 2023