শরীরের ব্যথা ও প্রদাহ কমানোর জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে NSAIDs (Non-steroidal anti-inflammatory drugs) বা নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক ওষুধ। অর্থাৎ এটি স্টেরয়েড গ্রুপের ওষুধ নয়, তবে প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে। 

আমাদের শরীরে ব্যথার অনুভূতি সৃষ্টিকারী হরমোন সদৃশ রাসায়নিক উপাদান হলো Prostaglandins যা নার্ভে ব্যথা ও প্রদাহের অনুভূতি সৃষ্টি করে। NSAIDs গ্রুপের ওষুধ শরীরে প্রবেশ করে এই হরমোনের উৎপাদন কমাতে সাহায্য করে এবং এর ফলে ব্যথা ও প্রদাহ কমে যায়। 

এই অনুচ্ছেদে এনএসএআইডি (NSAIDs) গোত্রের ব্যথানাশক ওষুধের নাম, ব্যবহার, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও সতর্কতা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।‌ 

এনএসএআইডি (NSAIDs) ওষুধ ব্যবহারের কারণ 

সাধারণত ব্যথা, প্রদাহ ও জ্বর নিরাময়ের জন্য NSAIDs ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এই তিনটি লক্ষণ যেসব রোগের ক্ষেত্রে দেখা যায় সেগুলোর জন্য NSAIDs ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমনঃ (MacGill, 2021) 

  • ঠান্ডা জ্বর 
  • মাথাব্যথা (Headache)
  • পিরিয়ডের ব্যথা 
  • পেশীতে ব্যথা (Muscle pain)
  • শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা 
  • পিঠে ব্যথা (Back pain)
  • দাঁত ব্যথা (toothache) 
  • বাত ব্যথা (Gout) ইত্যাদি  

ঠান্ডা জ্বর সাধারণত ভাইরাস সংক্রমণের ফলে হয়ে থাকে। আর এক্ষেত্রে NSAIDs ওষুধ সেবন করার ফলে জ্বর ও শরীর ব্যথা দূর হয়ে যায়। তবে ভাইরাস ধ্বংস করতে ওষুধের কোনো ভূমিকা নেই। বরং এক্ষেত্রে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তার নিজস্ব শক্তি দিয়ে ভাইরাসকে পরাস্ত করে থাকে। 

দীর্ঘমেয়াদী হোক বা স্বল্পকালীন যেকোনো ধরনের রোগের মৃদু থেকে মাঝারি প্রকৃতির ব্যথা ও প্রদাহ দূর করতে NSAIDs ওষুধ ভালো কাজ করে। তবে তীব্র প্রকৃতির ব্যথা ও প্রদাহের জন্য Opioids বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়।

এনএসএআইডি (NSAIDs) এর প্রকারভেদ 

 ব্যবহারের দিক বিবেচনায় এনএসএআইডি (NSAIDs) ওষুধের প্রকারভেদ হলোঃ  

ওটিসি মেডিসিন 

ওটিসি (OTC– over the counter) বলতে এমন ওষুধকে বোঝানো হয় যেগুলো ডাক্তারের নির্দেশনা ছাড়াই ফার্মেসি থেকে কিনে সেবন করা যায়। ওটিসি মেডিসিনের অন্তর্ভুক্ত NSAIDs ওষুধগুলো হলোঃ  

প্রেসক্রিপশন ড্রাগ (Prescription drugs) 

যেসব ওষুধ শুধুমাত্র চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী সেবন করতে হয় সেগুলোকে প্রেসক্রিপশন ড্রাগ বলা হয়। NSAIDs গোত্রের প্রেসক্রিপশন ড্রাগ গুলো হলোঃ 

  • ডাইক্লোফেনাক (Diclofenac)
  • ইটোডোলাক (Etodolac) 
  • মেফেনামিক এসিড (Mefenamic acid) 
  • অক্সাপ্রোজিন (Oxaprozin) 
  • এন্ডোমেথাসিন (Indomethacin)
  • ফেনোপ্রোফেন (Fenoprofen)
  • কেটোরোলাক (Ketorolac) 

কার্যকারিতার সময় অনুযায়ী NSAIDs দ্রুত এবং ধীর গতি সম্পন্ন এই ধরনের হয়ে থাকে। অর্থাৎ কিছু কিছু ওষুধ সেবন করার কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজ করা শুরু করে। যেমনঃ আইবুপ্রোফেন মুখে সেবন করার মাত্র ৩০ মিনিটের ভেতর কার্যকারিতা শুরু হয়। আবার কিছু কিছু ওষুধ কার্যকর হতে একটু বেশি সময় (সর্বোচ্চ ২ সপ্তাহ) নেয়।   

এনএসএআইডি (NSAIDs) ওষুধের নাম 

NSAIDs (ওটিসি মেডিসিনের অন্তর্ভুক্ত) ওষুধ আমাদের দেশে জেনেরিক নামের পাশাপাশি যেসব ব্র্যান্ড নামে কিনতে পাওয়া যায় তা হলোঃ 

  • Ibuprofen (Advel®, Deflam®, Erofen®, Flamex®, Profen®, Reumafen®, Siflam®) 
  • Aspirin (Angin®, Disprin®, Ecosprin®, Spirin®, Solrin®) 
  • Naproxen (Anaflex®, Fritt®, Ecless®, Eprox®, Cosnap®, Diproxen®, Dolwin®, Naid®)

অ্যাসপিরিন (Aspirin) ওষুধটি একই সাথে ওটিসি মেডিসিন এবং প্রেসক্রিপশন ড্রাগের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ জ্বর, প্রদাহ ও ব্যথানাশক হিসেবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৩৫০, ৫০০ বা ৬৫০ মিলিগ্রাম মাত্রায় ওটিসি মেডিসিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

আবার হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে প্রতিরোধ মূলক ওষুধ হিসেবে ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বল্প মাত্রায় (৭৫ মিলিগ্রাম) প্রতিদিন সেবন করা যায়।‌ 

আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen) ও ন্যাপ্রোক্সেন (Naproxen) ওষুধের ক্ষেত্রে এমন দ্বিমুখী ব্যবহার হয় না। এছাড়াও তুলনামূলক অ্যাসপিরিনের চেয়ে এই দুইটি ওষুধ বেশি নিরাপদ ও সহজলভ্য। তাই জ্বর, ব্যথা ও প্রদাহ দূর করতে ওটিসি মেডিসিন হিসেবে সর্বপ্রথম এই দুইটির যেকোনো একটি ওষুধ সেবনের চিন্তা করা যেতে পারে।  

উল্লেখ্য, এনএসএআইডি গোত্রের এই ওষুধ গুলো ফার্মেসিতে বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায়। যেমনঃ ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, সিরাপ, ক্রিম, জেল, ইনজেকশন ও সাপোজিটরি। ছোট বাচ্চাদের জন্য সিরাপ এবং বড়দের জন্য সাধারণভাবে ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল ব্যবহার করতে হবে। তবে দ্রুত কার্যকরী হওয়ার উদ্দেশ্যে ইনজেকশন বা সাপোজিটরি আর বাহ্যিক ব্যবহারের জন্য রয়েছে ক্রিম বা জেল।‌    

এনএসএআইডি কারা সেবন করতে পারবেন? 

ব্যথানাশক হিসেবে এনএসএআইডি ওষুধ নিরাপদ এবং প্রায় সবাই ব্যবহার করতে পারবে। তবে নিচে উল্লেখিত ক্ষেত্রগুলোতে ব্যবহার করা যাবে না অথবা ব্যবহারের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। যেমনঃ (cleveland clinic, 2020) 

  • বয়স্ক ব্যক্তি (৬৫ বছরের বেশি)
  • গর্ভবতী নারী ও স্তন্যদানকারী মা 
  • যারা গর্ভধারণের চেষ্টা করছেন 
  • NSAIDs ওষুধের প্রতি এলার্জিক রিয়াকশনের ইতিহাস 
  • অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসউচ্চ রক্তচাপ 
  • লিভার ও কিডনির সমস্যা 
  • Crohn’s disease
  • Ulcerative colitis
  • Peptic ulcer disease
  • অ্যাজমা আক্রান্ত রোগী এবং ১৬ বছরের কম বয়সীদের জন্য অ্যাসপিরিন দেওয়া যাবে না।

NSAIDs এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া 

এনএসএআইডি ওষুধ সেবনের কমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো গ্যাসের সমস্যা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, বুকজ্বালা, পেট ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া ইত্যাদি। ভরাপেটে ওষুধ সেবন অথবা ওষুধ সেবনের সময় এন্টাসিড (Antacid) জাতীয় ওষুধ খেলে উল্লেখিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। 

অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলো হলোঃ

  • মাথা ঘোরানো
  • শরীরের ভারসাম্যহীনতা 
  • মনোযোগ দিতে অসুবিধা 
  • ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাওয়া

 

ওষুধ সেবনের পর এলার্জিক রিয়াকশন (শ্বাসকষ্ট, ঠোঁট ও জিহ্বা ফুলে যাওয়া, ত্বকে র‍্যাশ হওয়া, খাবার গিলতে সমস্যা ইত্যাদি) দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। 

অন্যান্য ঔষধের সাথে সেবনের ক্ষেত্রে সতর্কতা

NSAIDs গোত্রের দুইটি ওষুধ একসাথে সেবন করা যাবে না। এছাড়াও অন্যান্য আরো কিছু ওষুধ রয়েছে যেগুলো সেবন করার সময় NSAIDs গ্রহণের প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত তা হলোঃ 

  • উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ
  • স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ
  • হার্টের রোগ প্রতিরোধের জন্য স্বল্প মাত্রায় নিয়মিত অ্যাসপিরিন সেবন
  • ডিপ্রেশন নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ওষুধ  
  • মেথোট্রেক্সেট (Methotrexate

অতিরিক্ত ডোজের ফলাফল 

অতিরিক্ত মাত্রায় (Overdose) বা দীর্ঘদিন ধরে NSAIDs ওষুধ সেবনের ফলে কিডনি, পরিপাকতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র এবং হার্টের সমস্যা হতে পারে। আর তাই নির্দেশিত মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। 

বেশি মাত্রায় ওষুধ খেলে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ  

  • বমি হওয়া 
  • ঝাঁপসা দৃষ্টি 
  • প্রচন্ড মাথাব্যথা 
  • খিঁচুনি 
  • শ্বাসকষ্ট 
  • অজ্ঞান হয়ে যাওয়া 

এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সেক্ষেত্রে জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।‌ 

এনএসএআইডি (NSAIDs) এর বিকল্প 

ব্যথা কমানোর জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমনঃ ব্যথার স্থানে গরম বা ঠান্ডা সেঁক দেওয়া, আদা পানি পান করা, ইয়োগা, আকুপাংচার ও ফিজিওথেরাপি। 

এছাড়াও ব্যথার স্থানে NSAIDs ক্রিম বা জেল ব্যবহার করা যেতে পারে। বাহ্যিক ব্যবহারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিছুটা কম হয়। 

জ্বর ও ব্যথানাশক ওষুধ হিসেবে সবচেয়ে নিরাপদ হলো প্যারাসিটামল (Paracetamol) যা ছোট, বড়, গর্ভবতী নারী, স্তন্যদানকারী মা সহ প্রায় সবাই সেবন করতে পারবেন। 

খাবার ও পানীয়ের সাথে সম্পর্ক 

সাধারণত নন-স্টেরয়েডাল প্রদাহনাশক ওষুধের সাথে কোনো খাবার ও পানীয়ের ক্ষতিকর সম্পর্ক নেই। আর তাই ওষুধ চলাকালীন সময়ে নির্দিষ্ট কোনো খাবার এড়িয়ে চলার প্রয়োজন হয় না। তবে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে চিকিৎসক খাবারের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তা মেনে চলা জরুরী। তবে কোনো অবস্থাতেই ওষুধ চলাকালীন সময়ে মদ্যপান করা যাবে না। 

ব্যথানাশক ওষুধ হিসেবে এনএসএআইডি (NSAIDs) সেবন করা খুব ভালো অপশন। তবে ওটিসি মেডিসিন দীর্ঘদিন ধরে সেবন করা যাবে না আর প্রেসক্রিপশন ড্রাগের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের নির্দেশনা ব্যতীত সেবন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। 

নিয়ম মেনে ওষুধ খেতে হবে। নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম বা বেশি পরিমাণে ওষুধ খাওয়া যাবে না। ওষুধ চলাকালীন সময়ে কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। 

References

cleveland clinic. (2020, January 25). NonSteroidal Anti-Inflammatory Drugs (NSAIDs). Retrieved from cleveland clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/drugs/11086-non-steroidal-anti-inflammatory-medicines-nsaids

MacGill, M. (2021, July 21). Everything you need to know about NSAIDs. Retrieved from Medical news today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/179211#uses

 

Last Updated on April 26, 2023