ডেঙ্গু জ্বর এ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে। এছাড়াও আরেকটি দুঃখজনক বিষয় হলো, সারাবিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ ডেঙ্গু আক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। (Paddock, 2018)

এই অনুচ্ছেদে ডেঙ্গু‌ কিভাবে ছড়ায়, কি কি লক্ষণ দেখা দিতে পারে, ডেঙ্গু হলে করণীয় কি, চিকিৎসা ব্যবস্থা কেমন এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায় সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও অনুচ্ছেদের শেষের দিকে ডেঙ্গু সম্পর্কিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর সহ ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ার মধ্যকার পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে।

ডেঙ্গু কি? (What is dengue )

ডেঙ্গু হলো মশাবাহিত একটি রোগ যা সাধারণত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে বেশি হয়ে থাকে। এই রোগের জন্য দায়ী হলো একটি ভাইরাস যাকে Dengue fever virus বলা হয়।

ডেঙ্গু জ্বরের এই ভাইরাসটি বহন করে ‘স্ত্রী এডিস মশা’ অর্থাৎ এই মশার কামড়েই ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে। তবে মশাটি যে সবসময় ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে তা নয়, বরং ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে কামড়ানোর মাধ্যমে এই ভাইরাস মশার শরীরে প্রবেশের সুযোগ পায়। অতঃপর আক্রান্ত মশা অন্য মানুষদের কামড়ানোর ফলে ডেঙ্গু সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ (Symptoms of Dengue Fever)

Symptoms of Dengue Fever

ডেঙ্গু রোগের (Dengue Fever) লক্ষণ এর ধরনের উপর নির্ভর করে। সাধারণত এটি ৩ ধরনের হয়ে থাকে। যথাঃ (Paddock, 2018)

  • সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর
  • রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গু জ্বর (DHF- Dengue hemorrhagic fever)
  • ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS- Dengue shock syndrome)

সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর

ডেঙ্গু জ্বর/ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী ‘এডিস মশা’ কামড়ানোর ৭ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। আবার ক্ষেত্রে বিশেষে কোনো লক্ষণ ছাড়াই সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর ভাল হয়ে যেতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হলে এবং জীবাণুর পরিমাণ কম হলে উপসর্গ খুব বেশি প্রকাশ পায় না। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ গুলো হলোঃ

  • ৫ থেকে ৭ দিন গায়ে জ্বর থাকবে (তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে)
  • প্রচন্ড শরীর ব্যথা বিশেষত হাড় ও জয়েন্টে প্রচুর ব্যথা হয় বলে ডেঙ্গুকে হাড়ভাঙা জ্বরও (breakbone fever) বলা হয়।
  • বিরামহীন মাথাব্যথা (Headache)
  • চোখের কোটরে ব্যথা
  • প্রচুর পানি পিপাসা দেখা যায়
  • শরীরে হামের মত র‍্যাশ উঠে এবং চুলকানি থাকতে পারে
  • খাবারে অরুচি এবং বমি বমি ভাব হয় অথবা বমি

 

৮০% জ্বরই সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর হয় এবং তা লক্ষণ প্রকাশের পর সর্বোচ্চ ৭ দিনের মধ্যে ভাল হয়ে যায়। তবে জ্বর ভালো হয়ে গেলেও কিছুদিন পর্যন্ত অবসাদ ও ক্লান্তি থেকে যায়। মাত্র ৫% ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বর খুব মারাত্মক আকার নেয় এবং খুবই কম ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

রক্তক্ষরণ জনিত ডেঙ্গু জ্বর

এক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণ গুলো মৃদু প্রকৃতির হয়ে থাকে। তবে পরবর্তীতে আস্তে আস্তে তা জটিল আকার ধারণ করে। যেমনঃ

  • ডেঙ্গু জ্বরের সাধারণ উপসর্গ গুলোর সাথে সাথে শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়
  • দাঁত ও মাড়ির গোঁড়া থেকে এবং নাক দিয়ে রক্ত পড়ে
  • সমস্ত শরীরে জায়গায় জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে যায়
  • রক্ত বমি হতে পারে
  • পায়খানার সাথেও রক্ত যেতে পারে
  • রক্ত পরীক্ষায় (Blood test) প্লাটিলেটের সংখ্যা কম দেখা যায়

 

ডেঙ্গু শক সিনড্রোম

এটি খুবই জটিল প্রকৃতির ডেঙ্গু জ্বর যেখানে রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এক্ষেত্রে যে সমস্ত লক্ষণ গুলো দেখা যায় তা হলোঃ

শিশু এবং গর্ভবতী নারীদের ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ

এছাড়াও শিশু এবং গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও জটিলতার ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়। যেমনঃ

✓ শিশুদের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় সাধারণ ঠান্ডা জ্বর অথবা পেটে সমস্যার (বমি ও ডায়রিয়া) মতো লক্ষণগুলো দেখা যায়। তবে পরবর্তীতে লক্ষণ পরিবর্তন হতে থাকে যেই পর্যায়ে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

✓ গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বরের প্রভাবে গর্ভপাত (Miscarriage), কম ওজন নিয়ে বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করা এবং গর্ভকালীন পূর্ণ সময় শেষ হওয়ার আগেই প্রসব হতে পারে।   

ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা

ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা

ডেঙ্গু জ্বর হলে বিচলিত না হয়ে যথাসময়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ অবহেলায় এই রোগে মৃত্যুও হতে পারে। আবার যথাসময়ে সঠিক ব্যবস্থা নিলে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এই রোগের চিকিৎসা হলো-

  • জ্বর কমানোর জন্য ভেজা কাপড় দিয়ে বারবার শরীর মুছে দিতে হবে এবং মাথায় পানি দিতে হবে।
  • দৈনিক তিনবেলা ৫০০ মিলিগ্রাম অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আরো উচ্চ মাত্রায় প্যারাসিটামল ওষুধ খেতে হবে।
  • ব্যথা কমানোর জন্য এসপিরিন ও আইবুপ্রোফেন জাতীয় কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না। কারণ তাতে রক্তক্ষরণ আরো বেড়ে যেতে পারে।
  • এটি একটি ভাইরাস ঘটিত জ্বর। আর তাই কোনো এন্টি বায়োটিক এক্ষেত্রে কাজে আসবে না।
  • প্রেগন্যান্ট অবস্থায় এই রোগ হলে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না।
  • প্রয়োজনে স্যালাইন ও রোগীর শরীরে রক্ত দিতে হবে।
  • রক্তক্ষরণ শুরু হলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে ডাক্তারের নির্দেশ মত চিকিৎসা দিতে হবে।

ডেঙ্গু হলে করণীয়

  • যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্রাম নিতে হবে।
  • প্রচুর পরিমাণে পানি এবং তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে।
  • শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং রক্ত উৎপাদনে সহায়তা করে এমন খাবার খেতে হবে। যেমনঃ মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, কলিজা, মটরশুটি ইত্যাদি
  • প্রচুর ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে। সেই সাথে ডাবের পানি, গ্রিন টি, এলো ভেরার শরবত ইত্যাদি খাওয়া উপকারি হতে পারে।
  • ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির মশারী ছাড়া ঘুমানো যাবে না। অন্যথায় মশার কামড়ে ভাইরাস সুস্থ ব্যক্তিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায় কি?

সম্প্রতি ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য একটি ভ্যাকসিন (Dengvaxia) আবিষ্কৃত হয়েছে এবং তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদন পেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এই ভ্যাকসিন সবার জন্য দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়নি। (Wikipedia, 2022) আশার কথা হলো এই যে, ভ্যাকসিন ছাড়াও কতিপয় পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমনঃ

  • এডিস মশা যেন বংশবিস্তার করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর তাই ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের পাত্র, টিনের কৌটা, এসির জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
  • বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বিশেষত গরম এবং বর্ষায় সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে মশার ওষুধ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • মশা থেকে বাঁচার জন্য মশারী, মশার নেট, স্প্রে ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
  • সর্বোপরি সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে গণ সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

 

ডেঙ্গু সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর

১। ডেঙ্গু কোন ভাষার শব্দ?

উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু (Dengue) শব্দটি আফ্রিকার সোয়াহিলি (Swahili) ভাষার প্রবাদ ‘Ka-dinga pepo’ থেকে নামটি এসেছে যার অর্থ হলো শয়তানের শক্তি। ফিলাডেলফিয়ায় ১৭৮০ সালে ডেঙ্গু মহামারীর পর ১৭৮৯ সালে Benjamin Rush নামক একজন চিকিৎসক ডেঙ্গুকে “break-bone fever” নামে অভিহিত করেন। (Wikipedia, 2022)

২। ডেঙ্গু রোগের জীবাণুর নাম কি?

ডেঙ্গু রোগের জীবাণুর নাম হলো Dengue fever virus (DENV) যার চারটি ধরন ডেঙ্গু জ্বর সৃষ্টির জন্য দায়ী। এই ভাইরাসটি প্রায় ৮০০ বছর আগে বানরের শরীর থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করেছে। (Paddock, 2018)

৩। ডেঙ্গু জ্বরের বাহক কোন মশা?

ডেঙ্গু জ্বরের বাহক মশাকে সাধারণ ভাবে ডেঙ্গু মশা বলা হয়ে থাকে। তবে এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো Aedes aegypti বা এডিস ইজিপ্টাই মশা। এটি ছাড়াও খুব বিরল ক্ষেত্রে Aedes albopictus মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়াতে পারে। উল্লেখ্য শুধুমাত্র মহিলা এডিস মশা তার ডিম পরিপক্ব করার জন্য রক্ত পান করে থাকে। পুরুষ মশা রক্ত খাওয়া অথবা রোগ ছড়ানো কোনোটির সাথেই জড়িত নয়।

৪। ডেঙ্গু মশা চেনার উপায় কি?

ডেঙ্গু মশা তথা এডিস মশা সর্বপ্রথম আফ্রিকা থেকে উৎপন্ন হয়েছে যা পরবর্তীতে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। এই মশা দেখতে কিছুটা ছোট আকৃতির এবং পায়ে সাদা সাদা চিহ্ন থাকে। এছাড়াও এর শরীরে কালো-সাদা ডোরাকাটা দাগ রয়েছে বলে এটিকে টাইগার মশাও বলা হয়। ডেঙ্গু মশা সাধারণত রাতের বেলায় কামড়ায় না, বরং সকালে এবং বিকেলের দিকে কামড়িয়ে থাকে।

৫। ডেঙ্গু কোথায় এবং কেন বেশী হয়?

শহর অঞ্চলে এই রোগ বেশি হয়ে থাকে। কারণ সেখানে আবদ্ধ পরিষ্কার পানিতে ডেঙ্গুর বাহক ‘এডিস মশা’ সহজেই বংশবিস্তার করতে পারে। উল্লেখ্য বর্ষা এবং গরমকাল ডেঙ্গু রোগের মৌসুম।

৬। ডেঙ্গু কাদের জন্য বেশী ঝুঁকিপূর্ণ?

  • সেকেন্ডারী ইনফেকশন এর ক্ষেত্রে অর্থাৎ এর আগেও যাদের ডেঙ্গু হয়েছিলো।
  • বাচ্চাদের ক্ষেত্রে।
  • প্রেগন্যান্ট মহিলাদের ক্ষেত্রে এই রোগের ঝুঁকি থাকে সবচেয়ে বেশি।

৭। ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া জ্বর এর পার্থক্য কি?

ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া জ্বর এর লক্ষণ অনেকটা একই রকম। এই দুটি ভাইরাসের বাহকও একই মশা- ‘এডিস মশা’। ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ার পার্থক্য হলো:

✓ ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে রক্তে প্লাটিলেট (Platelets) এর পরিমাণ অনেক কমে যায় যা চিকুনগুনিয়াতে হয় না।

✓ হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেশি, পক্ষান্তরে চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যু ঝুঁকি খুবই কম এমনকি নেই বললেই চলে।

✓ জ্বর কমে যাওয়ার পরও চিকুনগুনিয়াতে জয়েন্ট ব্যথা থাকতে পারে বেশ কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত। কিন্তু ডেঙ্গু জ্বর কমার পর শরীর ব্যথা খুব বেশি দিন থাকে না।

✓ ডেঙ্গু একবার হওয়ার পরও আরো ৩ বার হতে পারে। তবে চিকুনগুনিয়া সাধারণত ১ বারই হয়।

✓ চিকুনগুনিয়ায় হাত, পা এবং মুখে র‍্যাশ হয় আর ডেঙ্গুতে সমস্ত শরীরে র‍্যাশ হয়। চিকুনগুনিয়া বোঝার আরও ১টা বিশেষ উপায় হল, পায়ের গোড়ালীতে প্রচন্ড ব্যথা হয় যার কারণে উঠে দাঁড়াতেও প্রচন্ড যন্ত্রণা হয়।

 

 

References

Paddock, M. (2018, 11 2). Everything you need to know about Dengue fever. From Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/179471

Wikipedia. (2022, 1 31). Dengue fever. From Wikipedia: https://en.m.wikipedia.org/wiki/Dengue_fever

Last Updated on April 16, 2023