রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা কি?

বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হলো অক্সিজেন যা শ্বাস গ্রহণের সময় ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে মিশে গিয়ে শরীরের প্রত্যেকটি কোষে পৌঁছে যায়। সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা থাকে ৯৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। তবে ফুসফুসের রোগ সহ বিভিন্ন কারণে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যেতে পারে যার ফলে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই অনুচ্ছেদে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণ, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপের উপায়, কমে গেলে কি কি লক্ষণ দেখা যেতে পারে, এক্ষেত্রে করণীয় কি, কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। (Holland, 2022)

রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা কীভাবে পরিমাপ করা হয়?

রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপ করার দুইটি পদ্ধতি রয়েছে। যথাঃ

Arterial blood gas (ABG)

ABG টেস্ট করার জন্য শরীর থেকে রক্ত সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা সহ পিএইচ (pH) লেভেল সম্পর্কে জানা যায়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে একদম নির্ভুল তথ্য পাওয়া যায় তবে এই পরীক্ষা বাড়িতে বসে করা যায় না বরং ল্যাবে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে।

মানুষের শরীরে রক্ত বহনকারী দুই ধরনের রক্তনালী রয়েছে যার মধ্যে একটি হলো ধমনী (artery) আর অপরটি হলো শিরা (veins)। ধমনীর ভেতর দিয়ে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত সারা শরীরের সব কোষে পৌঁছে যায় এবং কোষে উৎপন্ন হওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইড শিরার মাধ্যমে হৃদপিন্ডে ফেরত আসে‌। অতএব ABG টেস্ট সম্পন্ন করার জন্য শিরা নয় বরং ধমনী থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে হবে।

পালস অক্সিমিটার (Pulse oximeter)

মহামারী করোনা সংক্রমণ কালে অনেকেই এই যন্ত্রটির সাথে পরিচিত হয়েছে যার সাহায্যে বাড়িতে বসে খুব সহজেই রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা জানা যায়। আঙ্গুলে এই যন্ত্রটি লাগালে সুক্ষ্ম রক্তনালীর ভেতর দিয়ে আলোক বিচ্ছুরণ ঘটানোর মাধ্যমে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ডিসপ্লেতে দেখায়। এই পরীক্ষার সুবিধা হলো এটি সম্পন্ন করার জন্য শরীর থেকে রক্ত বের করার প্রয়োজন পড়ে না। একটি অক্সিমিটার কিনে যে কেউ কারো সাহায্য ছাড়াই বাড়িতে বসে পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) এর তথ্য অনুযায়ী পালস অক্সিমিটার ব্যবহার করে যে তথ্য পাওয়া যাবে তা একদম নির্ভুল হবে না বরং ফলাফলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ পর্যন্ত কম বা বেশি দেখা যেতে পারে। তবে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেওয়ার জন্য যন্ত্রটি ব্যবহার করা যাবে।‌

তবে ধুমপান করেন এমন ব্যক্তিদের জন্য পালস অক্সিমিটার কোনো কাজে আসবে না। কারণ ধুমপানের ফলে রক্তে কার্বন মনোঅক্সাইড জমা হয়। পালস অক্সিমিটার অক্সিজেন ও কার্বন মনোঅক্সাইডের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। ফলে ভুল তথ্য প্রদান করে থাকে। যারা ধুমপান করেন তাদের জন্য শুধুমাত্র ABG টেস্টের মাধ্যমে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা দেখা যায়।

রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কেমন হওয়া উচিত?

আমরা অনেকেই জানি না মানুষের স্বাভাবিক অক্সিজেন লেভেল কত? সুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ABG টেস্টে রক্তে অক্সিজেনের স্বাভাবিক মাত্রা ৮০ থেকে ১০০ মিলিমিটার অফ মার্কারি থাকবে যা পালস অক্সিমিটারে শতকরা অনুপাতে ৯৫ থেকে ১০০ শতাংশ দেখা যাবে। রক্তে‌ অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কম হলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় হাইপোক্সেমিয়া (Hypoxemia) বলা হয়। সুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পালস অক্সিমিটারে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯৫ শতাংশের নিচে দেখা গেলে তা হাইপোক্সেমিয়া হিসেবে ধরা হয়। তবে যারা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত বিশেষ করে সিওপিডি (COPD- chronic obstructive pulmonary disease) রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পালস অক্সিমিটারে ৮৮ থেকে ৯২ শতাংশ পর্যন্ত স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হবে।‌

রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা খুব কম হলে কি হবে?

হাইপোক্সেমিয়া হলে তথা রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে গেলে সেক্ষেত্রে যেসব লক্ষণ দেখা যেতে পারে তা হলোঃ (Silva, 2022)

  • শ্বাসকষ্ট
  • অস্থিরতা
  • মাথাব্যথা
  • বুকে‌ ব্যথা
  • ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাওয়া
  • শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা
  • চোখে‌ ঝাপসা দেখা ইত্যাদি

রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা খুব কমে গেলে তখন সায়ানোসিস (Cyanosis) দেখা যায় যার লক্ষণ হলো ঠোঁট, আঙ্গুল ও ত্বক নীল হয়ে যাওয়া।‌ এমতাবস্থায় জরুরী ভিত্তিতে শরীরে‌ অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে। অন্যথায় ফুসফুসের কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে মৃত্যু হতে পারে।

করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের হাইপোক্সেমিয়া দেখা যেতো যাকে মেডিকেলের ভাষায় Happy hypoxemia বলা হয়। এক্ষেত্রে রক্তে‌ অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় কিন্তু রোগীর শ্বাসকষ্ট বা অন্য কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। ফলে রোগী বুঝতে সক্ষম হয় না যে হাইপোক্সেমিয়া হচ্ছে তবে পালস অক্সিমিটারে টেস্ট করা হলে হাইপোক্সেমিয়া ধরা পড়ে।

রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কম হওয়ার কারণ কী?

রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণ সমূহ সাধারণত রক্ত, ফুসফুস ও হৃদপিন্ড কেন্দ্রীক হয়ে থাকে। বিশেষত ফুসফুসের রোগের কারণে হাইপোক্সেমিয়া দেখা যায়। হাইপোক্সিয়ার কারণ সমূহ নিচে তুলে ধরা হলোঃ

  • অ্যাজমা
  • কোভিড-১৯
  • নিউমোনিয়া
  • সিওপিডি (COPD)
  • Interstitial lung disease
  • Emphysema
  • ARDS- acute respiratory distress syndrome
  • Pulmonary fibrosis
  • রক্তস্বল্পতা
  • জন্মগত হার্টের রোগ

বায়ুতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন না থাকলে সেক্ষেত্রে হাইপোক্সেমিয়া হতে পারে। বিশেষ করে পাহাড়ের উপরে উঠলে সেখানে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। এছাড়াও ঘুমের সমস্যা এবং ব্যথানাশক ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে হাইপোক্সেমিয়া হতে পারে।

কিভাবে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ানো যায়?

রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে অথবা পালস অক্সিমিটারে হাইপোক্সেমিয়া দেখা গেলে প্রাথমিক অবস্থায় কতিপয় ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করার মাধ্যমে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ানো যায়। যেমনঃ

  • টাইট পোশাক, অন্তর্বাস ও মাস্ক পড়া থাকলে খুলে ফেলতে হবে অথবা পোশাক ঢিলেঢালা করতে হবে। কারণ, পোশাক টাইট ভাবে শরীরে লেগে থাকলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
  • লোক সমাগম করা যাবে না। কারণ বেশি লোক এক জায়গায় জড়ো হলে সেখানকার বায়ুতে অক্সিজেন কমে যেতে থাকে।
  • ঘরের মধ্যে থাকলে ঘরের দরজা জানালা খুলে দিতে হবে যেন বাইরে থেকে ঘরে অক্সিজেন ঢুকতে পারে।
  • নড়াচড়া ও হাঁটাহাঁটি সহ সকল প্রকার কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়াও মানসিক ভাবে অস্থির হওয়া যাবে না। কারণ এতে শরীরে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে যায়।
  • উপুড় হয়ে শুয়ে অথবা বসে থেকে লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে হবে।

কখন ডাক্তার দেখাবেন?

ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে সমাধান না হলে সেক্ষেত্রে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। এছাড়াও হঠাৎ করে তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হলে অথবা বিশ্রামে থাকা সত্ত্বেও ঘন‌ ঘন‌ শ্বাস প্রশ্বাস নিতে থাকলে সেক্ষেত্রে জরুরী ভাবে ন্যাজাল ক্যানোলার সাহায্যে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে। করোনা মহামারী কালে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে বাড়িতে ব্যবহার করার প্রচলন হয়েছিল। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে হাসপাতালে যাওয়া উত্তম। কারণ শ্বাসকষ্ট নিরাময় করার পর চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে হাইপোক্সেমিয়া কেন হয়েছে তা নির্ণয় করা যাবে। অতঃপর কারণ অনুযায়ী যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করা হলে পরবর্তীকালে হাইপোক্সেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। এছাড়াও ধুমপান বর্জন, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার মাধ্যমে হাইপোক্সেমিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।‌

যারা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত তাদের জন্য একটি পালস অক্সিমিটার কিনে ঘরে রাখা উপকারী হবে যার মাধ্যমে সহজেই রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা চেক করা যাবে এবং হাইপোক্সেমিয়া দেখা গেলে সেক্ষেত্রে দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে।

 

References

Holland, K. (2022, April 29). Is My Blood Oxygen Level Normal? Retrieved from healthline:
https://www.healthline.com/health/normal-blood-oxygen-level
Silva, J. C. (2022, December 23). Low and normal blood oxygen levels: What to know. Retrieved from medical news today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/321044

 

Last Updated on April 15, 2023