সাইট্রিক এসিড কি? সাইট্রিক এসিড (Citric acid) হলো একটি জৈব এসিড যা সর্বপ্রথম ১৭৮৪ সালে একজন সুইডিশ বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন। লেবু ও কমলা সহ বিভিন্ন ফল ও সবজিতে প্রাকৃতিকভাবে সাইট্রিক এসিড থাকে। আবার খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করা ও সংরক্ষণের জন্য কৃত্রিম উপায়ে খাবারে সাইট্রিক এসিড যোগ করা হয়ে থাকে। (Walle, 2021) 

সাইট্রিক এসিড স্বাস্থ্যের জন্য নানাবিধ উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। এই অনুচ্ছেদে সাইট্রিক এসিডের স্বাস্থ্য উপকারিতা, কোন কোন খাবার থেকে পাওয়া যায়, নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

সাইট্রিক এসিড এর প্রাকৃতিক খাদ্য উৎস 

প্রাকৃতিক যেসব খাবারে প্রচুর পরিমাণে সাইট্রিক এসিড রয়েছে তা হলো লেবু, কমলা, মাল্টা, আঙ্গুর আমলকী। এক আউন্স (৩০ মিলিলিটার) লেবুর রসে ১.৩৮ থেকে ১.৪৪ গ্রাম সাইট্রিক এসিড রয়েছে। 

এছাড়াও অন্যান্য আরো যেসব ফল ও সবজি থেকে সাইট্রিক এসিড পাওয়া যায় তা হলো স্ট্রবেরি, চেরিফল, আনারস, কিসমিস, জাম, টমেটো, গাজর, ব্রকলি, লেটুসপাতা, ডুমুর ফল, ডালিম ইত্যাদি। 

সাইট্রিক এসিড এর কৃত্রিম উৎস এবং ব্যবহার 

স্বাদ ও ফ্লেভার বাড়ানো সহ দীর্ঘদিন পর্যন্ত সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে খাবারে কৃত্রিম উপায়ে সাইট্রিক এসিড ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে কৌটাজাত খাবারে ব্যাকটেরিয়ার (Clostridium botulinum) সংক্রমণ যেন না হয় সেজন্য সাইট্রিক এসিড ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি যেসব খাবার ও পানীয়তে সাইট্রিক এসিড পাওয়া যায় তা হলোঃ 

  • কোমল পানীয় 
  • এনার্জি ড্রিংকস 
  • জ্যাম ও জেলি 
  • আচার ও ক্যান্ডি  
  • কিছু কিছু আইসক্রিম
  • অ্যালকোহল ইত্যাদি 

এছাড়াও বিভিন্ন ওষুধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট,‌ টয়লেট্রিজ পণ্য ইত্যাদিতে সাইট্রিক এসিড ব্যবহার করা হয়। কোনো পণ্যে সাইট্রিক এসিড রয়েছে কিনা তা প্যাকেটের গায়ে উপাদানের বর্ণনায় লেখা‌ থাকে। তবে কোনো কোনো পণ্যে সাইট্রিক এসিডের পরিবর্তে রাসায়নিক সংকেত (C6H8O7) লেখা থাকতে পারে। 

সাইট্রিক এসিড এর স্বাস্থ্য উপকারিতা  

এসিড নাম শুনলেই ক্ষতিকর কিছু হবে ভেবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সাইট্রিক এসিড হলো মৃদু প্রকৃতির জৈব এসিড যা মোটেও ক্ষতিকর নয়। বরং প্রাকৃতিকভাবে যেসব খাবারে সাইট্রিক এসিড রয়েছে সেগুলো সহ কৃত্রিম পণ্য গুলোও নিরাপদ। কোমল পানীয় ও‌ এনার্জি ড্রিংকস ক্ষতিকর হলেও সেটা সাইট্রিক এসিডের জন্য নয়। বরং এতে থাকা চিনি ও ফসফরিক এসিড হলো প্রধান সমস্যা। 

সাইট্রিক এসিড সমৃদ্ধ ফলগুলোকে বলা হয় সাইট্রাস ফল। এগুলো খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য যেসব উপকারিতা বয়ে আনতে পারে তা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলোঃ (Jennings, 2017) 

১. কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি কমায় 

কিডনিতে পাথর হওয়া‌ একটি কমন রোগ যা প্রস্রাবে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ঘন মাত্রায় বিভিন্ন মিনারেলস থাকার ফলে হয়ে থাকে। শরীরে সাইট্রিক এসিডের অভাব জনিত কারণে কিডনিতে পাথর হতে পারে।  

যারা নিয়মিত সাইট্রিক এসিড সমৃদ্ধ ফল ও শাক-সবজি খেয়ে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কম দেখা যায়। পক্ষান্তরে গত ৪০ বছরে আমেরিকান মানুষের খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে, যারা সাইট্রিক এসিড সমৃদ্ধ ফল কম খেয়ে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। 

২. প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে 

সাইট্রিক এসিড এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী সম্পন্ন যা প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে এবং শরীরে অতিরিক্ত ফ্রি রেডিক্যালের (Free radicals) সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কোষের ক্ষতিগ্রস্ততা ঠেকায়। এছাড়াও প্রদাহ জনিত বিভিন্ন রোগের (অ্যাজমা, বাত ব্যথা, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি) উপসর্গ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।  

সাইট্রিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া ত্বকের প্রদাহ কমানোর মাধ্যমে বয়সের ছাপ দূর করতে সাহায্য করে। এছাড়াও রূপচর্চায় বাহ্যিকভাবে সাইট্রিক এসিড সমৃদ্ধ লেবু ব্যবহার করে উপকার পাওয়া যেতে পারে। 

৩. অন্ত্রে (Intestine) পুষ্টি উপাদান শোষণে সহায়তা করে  

Intestine

আমরা যে খাবার খাই তা থেকে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সমূহ অন্ত্রের মাধ্যমে শোষণ হয়। সাইট্রিক এসিড এই কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মিনারেলস (ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম) শোষণে সহায়তা করে। 

বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান অন্ত্রে শোষণ হওয়ার পরে রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে কোষে প্রবেশ করে। কোষের ভেতরে মেটাবলিসম (Metabolism) বা বিপাক প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন হয়। মেটাবলিসমে সাইট্রিক এসিড সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। 

৪. ভিটামিন সি সমৃদ্ধ 

সাইট্রাস ফলগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায় যা শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পুষ্টি উপাদান। ভিটামিন সি এর অভাবে স্কার্ভি রোগ (Scurvy) হয়। নিয়মিত ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। 

সাইট্রিক এসিড মানেই কিন্তু ভিটামিন সি নয়। বরং সাইট্রিক এসিড সমৃদ্ধ ফলে ভিটামিন সি থাকে। ভিটামিন সি এর অন্য নাম হলো এসকরবিক এসিড যা সাইট্রিক এসিড থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি উপাদান।   

৫. ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে

সাইট্রিক এসিডের এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। বিশেষ করে সাইট্রাস ফল ও সবজিগুলো নিয়মিত খাওয়া হলে ফুসফুস, খাদ্যনালী ও পাকস্থলীর ক্যান্সার সহ মহিলাদের ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।

৬. হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায় 

সাইট্রিক এসিড সমৃদ্ধ ফলমূল ও সবজি খাওয়া হার্টের রোগে (হার্ট অ্যাটাকস্ট্রোক) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। 

সাইট্রাস ফল ও সবজিগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার ও ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে যা রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের (LDL– low density lipoprotein) মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকলে হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। 

৭. মস্তিষ্কের রোগ প্রতিরোধ করে   

সাইট্রিক এসিডের এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী প্রদাহ কমানোর মাধ্যমে মস্তিষ্কের কোষ ভালো রাখে। বিশেষ করে বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে পারকিনসন ও আলজেইমার্স রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাইট্রিক এসিড সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

৮. ওজন কমাতে সাহায্য করে 

সাইট্রাস ফলগুলো কম ক্যালোরিযুক্ত হয়ে থাকে এবং সেই সাথে এর এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলীর জন্য শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে সকালে খালিপেটে লেবুর পানি পান করার মাধ্যমে ওজন কমানোর পদ্ধতি অনেকেই অনুসরণ করে থাকেন। এছাড়াও সাইট্রাস ফল ও সবজিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে যা শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে। 

নিরাপত্তা এবং ঝুঁকি 

A smiling face

সাইট্রিক এসিডের পিএইচ (pH) মান হলো ৩ – ৬ অর্থাৎ মৃদু প্রকৃতির এসিড। তীব্র এসিডের পিএইচ মান ১ – ৩ হয়ে থাকে। ৩ – ৬ মানের এসিড শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে সাইট্রিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া যাবে না। কারণ এতে পেটে গ্যাসের সমস্যা হতে পারে।  

সাইট্রিক এসিড মৃদু প্রকৃতির এসিড হলেও তা দাঁতের এনামেল ক্ষয় করতে পারে। তাই সাইট্রিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পর কুলি করতে হবে। তবে ব্রাশ করা যাবে না। 

সাইট্রিক এসিড সমৃদ্ধ পণ্য ত্বকে ব্যবহারের ফলে সাধারণত কোনো সমস্যা হয় না।‌ তবে সংবেদনশীল ত্বক অথবা অতিরিক্ত বেশি পরিমাণে সাইট্রিক এসিড রয়েছে এমন পণ্য ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। 

সাইট্রিক এসিড সাধারণত কোনো ওষুধের  কার্যকারিতা হ্রাস করে দেয় না। তবে আঙ্গুর (সাইট্রাস ফল) কতিপয় ওষুধ অন্ত্রে শোষণ হতে বাধা দেয়।‌ যেমনঃ এলার্জির ওষুধ, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার ওষুধ, রক্তে কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ, ইমিউনোসাপ্রেসান্ট ওষুধ, মানসিক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ ইত্যাদি। 

Bibliography

Jennings, K.-A. (2017, 01 27). 7 Reasons to Eat More Citrus Fruits. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/citrus-fruit-benefits

Walle, G. V. (2021, September 30). What Is Citric Acid, and Is It Bad for You? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/citric-acid

Last Updated on October 31, 2023