ব্লাড (Blood) বা রক্ত প্রধানত তিন ধরনের কোষ নিয়ে গঠিত। যথাঃ লোহিত রক্ত কণিকা, শ্বেত রক্ত কণিকা ও অণুচক্রিকা। বয়স ভেদে শরীরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে রক্ত কণিকা থাকে যা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করে। অস্থিমজ্জা বা বোন ম্যারোতে (Bone marrow) প্রতিনিয়ত রক্ত কণিকা তৈরি হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পরে রক্তের কোষগুলো মারা যেতে থাকে।
ব্লাড ক্যান্সার (Blood Cancer) একটি জটিল প্রকৃতির রোগ যার ফলে কোষের সংখ্যা ও কার্যক্রমে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। এই অনুচ্ছেদে ব্লাড ক্যান্সারের কারণ, প্রকারভেদ, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
ব্লাড ক্যান্সার কি?
ক্যান্সার মানেই হলো অস্বাভাবিক কোষ বিভাজন। ব্লাড ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বোন ম্যারোতে অস্বাভাবিক সংখ্যক রক্ত কণিকা উৎপাদন হয়। ব্লাড ক্যান্সার মূলত শ্বেত রক্ত কণিকাতে (WBC- white blood cell) আক্রমণ করে। সুস্থ মানুষের শরীরে যত সংখ্যক শ্বেত রক্ত কণিকা থাকে তা নিচের ছকে তুলে ধরা হলো।
বয়স | শ্বেত রক্ত কণিকার সংখ্যা | Number in English |
প্রাপ্তবয়স্ক | প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে ৪০০০ – ১১০০০ | 4000 – 11000/mm^3 |
১ থেকে ১২ বছর | প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে ৫০০০ – ১৫০০০ | 5000 – 15000/mm^3 |
১ বছরের কম বয়সী বাচ্চা | প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে ৬০০০ – ১৮০০০ | 6000 – 18000/mm^3 |
ব্লাড ক্যান্সারের ক্ষেত্রে শ্বেত রক্ত কণিকার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায় এবং সেই সাথে লোহিত রক্ত কণিকা ও অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে যায়। উল্লেখ্য, ব্লাড ক্যান্সার ছাড়াও শরীরে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের সংক্রমণ, মানসিক চাপ, কঠোর পরিশ্রম, ভারী ব্যায়াম, ধুমপান, গর্ভাবস্থা ইত্যাদিতে শ্বেত রক্ত কণিকার সংখ্যা কিছুটা বেড়ে যায়। (Khaleque, 2016)
ব্লাড ক্যান্সারের কারণ কি?
কোষের ভেতরে থাকে DNA যেখান থেকে সিগন্যাল পেয়ে কোষ বিভাজন হয়ে থাকে। সুস্থ অবস্থায় সিগন্যাল ও কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। তবে DNA এর মিউটেশন বা পরিবর্তনের ফলে অস্বাভাবিক কোষ বিভাজন শুরু হয়। তবে ঠিক কেন DNA এর পরিবর্তন ঘটে তা জানা যায়নি। অর্থাৎ ব্লাড ক্যান্সারের প্রকৃত কারণ অজানাই রয়ে গেছে।
কতিপয় বিষয়কে (বয়স, লিঙ্গ, রেডিয়েশন) ব্লাড ক্যান্সারের রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমনঃ
- ব্লাড ক্যান্সার সাধারণত কম বয়সী বাচ্চা ও অধিক বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে হতে দেখা যায়।
- মহিলাদের তুলনায় পুরুষের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকি রয়েছে।
- মা বাবা বা ভাই বোনদের মধ্যে কারো ব্লাড ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে সেই সন্তান বা সহোদরের ক্ষেত্রে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- অন্য কোনো ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস এবং চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
- ধুমপানের অভ্যাস
- শরীরের অতিরিক্ত ওজন
- রাসায়নিক উপাদান ও রেডিয়েশনের ক্ষতিকর প্রভাব
- এইডস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি
ব্লাড ক্যান্সার কত প্রকার?
ব্লাড ক্যান্সার প্রধানত তিন ধরনের হয়ে থাকে। যথাঃ (Watson, 2020)
- লিউকেমিয়া (Leukemia)
- লিম্ফোমা (Lymphoma)
- মাল্টিপল মায়েলোমা (Multiple Myeloma)
লিউকেমিয়ার চারটি ধরন রয়েছে। যথাঃ
- একিউট লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া (ALL- Acute lymphocytic leukemia)
- একিউট মাইলয়েড লিউকেমিয়া (AML- Acute myeloid leukemia)
- ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া (CLL- Chronic lymphocytic leukemia)
- ক্রনিক মাইলয়েড লিউকেমিয়া (CML- Chronic myeloid leukemia)
লিম্ফোমা প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথাঃ
- হজকিন লিম্ফোমা (Hodgkin’s lymphoma)
- নন- হজকিন লিম্ফোমা (Non-Hodgkin’s lymphoma)
মায়েলোমার প্রধান দুটি ধরন হলোঃ
- ইনডোলেন্ট মায়েলোমা (Indolent myeloma)
- সলিটারি প্লাজমাসাইটোমা (Solitary plasmacytoma)
ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কি?
ব্লাড ক্যান্সারের ধরন ভেদে লক্ষণের ক্ষেত্রে পার্থক্য হয়ে থাকে। তবে যেসব লক্ষণ কমন ভাবে দেখা যায় তা হলোঃ (Cleveland Clinic, 2022)
- দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ
- দীর্ঘদিন যাবত জ্বর
- রাতে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
- শরীরের ওজন কমে যাওয়া
- অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হওয়া
- সহজেই ইনফেকশন বা রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়
- লিম্ফ নোড (Lymph nodes) ফুলে যায়। বিশেষ করে ঘাড়, গলা ও কানের নিচে ছোট ছোট গোটার মতো ফোলাভাব দেখা যায়
- লিভার ও প্লীহা (Spleen) বড় হয়ে যাওয়ার ফলে পেট ফুলে যায়
ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষণ দেখা দিলে হেমাটোলজিস্ট (Hematologist) বা রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।
কিভাবে ব্লাড ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়?
ব্লাড ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য রোগীর মুখে রোগ লক্ষণের বিস্তারিত বর্ণনা শোনার পর চিকিৎসক রোগীকে শারীরিক পর্যবেক্ষণ করেন। অতঃপর রক্ত পরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।
রক্ত পরীক্ষা (CBC- Complete Blood Count)
ব্লাড ক্যান্সার নির্ণয়ের প্রাথমিক পর্যায়ের একটি সহজ পরীক্ষা হলো CBC যার জন্য নমুনা হিসেবে শিরা থেকে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। অতঃপর ল্যাবরেটরিতে রক্তকোষের সংখ্যা গণনা করা হয়। শ্বেত রক্ত কণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি (প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে ২০ হাজারের বেশি) এবং সেই সাথে লোহিত রক্ত কণিকা ও অণুচক্রিকার পরিমাণ কম থাকলে ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। উল্লেখ্য প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের রক্তে প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে ৪.২ থেকে ৫.৯ মিলিয়ন লোহিত রক্ত কণিকা এবং প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে ১.৫ লক্ষ থেকে ৪ লক্ষ অণুচক্রিকা থাকে।
রক্ত পরীক্ষায় অস্বাভাবিকতা দেখা গেলে ব্লাড ক্যান্সারের ধরন ও তীব্রতা সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে জানার জন্য আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে। যেমনঃ
- Blood chemistry test
- হাড়ের সিটি স্ক্যান (CT scan)
- হাড়ের এমআরআই (MRI)
- Positron emission tomography (PET) scan
- বোন ম্যারো বায়োপসি (Biopsy)
- Blood cell examination
চিকিৎসা
ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসায় যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে থাকে তা হলোঃ
কেমোথেরাপি (Chemotherapy)
প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা হিসেবে ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করার জন্য কেমোথেরাপি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতি তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল তবে কিছুটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে।
রেডিওথেরাপি (Radiation therapy)
শুধুমাত্র কেমোথেরাপির সাহায্যে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা সম্ভব না হলে সেক্ষেত্রে রেডিওথেরাপির সহায়তা নেওয়া হয়ে থাকে।
ইমিউনোথেরাপি (Immunotherapy)
এই পদ্ধতির চিকিৎসার উদ্দেশ্য হলো যেন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজে থেকে ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়।
বোন ম্যারো ট্র্যান্সপ্লান্ট (Bone Marrow Transplant)
ব্লাড ক্যান্সার আক্রান্ত হলে বোন ম্যারো ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা বোন ম্যারো ট্র্যান্সপ্লান্টের মাধ্যমে ঠিক করা হয়। এটি খুব ব্যয়বহুল তবে ব্লাড ক্যান্সার চিকিৎসায় সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। নিজের শরীর থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করে (Autologous stem cell transplant) অথবা অন্য কারো থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করে (Allogeneic stem cell transplant) বোন ম্যারো ট্র্যান্সপ্লান্ট সম্পন্ন করা হয়।
ব্লাড ক্যান্সার চিকিৎসায় সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি কী কী?
ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসায় শরীরে যেসব অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন দেখা যায় সেগুলোকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side effects) বলা হয়। রোগী ও চিকিৎসার ধরন ভেদে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভিন্নতর হয়ে থাকে। যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমন দেখা যায় তা হলোঃ
- চুল পড়ে যাওয়া (Hair loss)
- বমি বমি ভাব ও বমি হয়
- মুখে ঘা হয় (Sore mouth)
- স্মৃতি শক্তি কমে যায়
- ঘুমের সমস্যা হয়
- ডায়রিয়া
ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে সহজেই ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ফাংগাস ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই রোগীর জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরী।
- ফলমূল ও শাকসবজি ধুয়ে খেতে হবে।
- মাছ ও মাংস ভালোভাবে সিদ্ধ করতে হবে।
- বাসি খাবার খাওয়া যাবে না।
- অসুস্থ মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে।
- বাইরে থেকে ঘরে ফিরে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
- জনসমাগম ও ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে।
ব্লাড ক্যান্সার কি গুরুতর?
নিঃসন্দেহে ব্লাড ক্যান্সার একটি গুরুতর রোগ। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে যেসব জটিলতা (Complications) হতে পারে তা হলোঃ
- হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়ার ফলে হাড় ভঙ্গুর হয়ে যায়।
- রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায় যা কিডনি, মস্তিষ্ক ও হার্টের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
- কিডনির সমস্যা (Kidney failure)
- ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা
- তীব্র প্রকৃতির রক্তস্বল্পতা
- মানসিক সমস্যা
- অকাল মৃত্যু
এছাড়াও ব্লাড ক্যান্সারের জন্য খুব ব্যয়বহুল চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের জন্য অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় ব্লাড ক্যান্সার রোগটি একটি বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
ব্লাড ক্যান্সারে বেঁচে থাকার হার কত?
ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার হার কেমন তা ক্যান্সারের ধরন, রোগের তীব্রতা, রোগীর বয়স, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, শারীরিক সক্ষমতা এবং কত শিঘ্র চিকিৎসা গ্রহণ করা হয়েছে তার উপর নির্ভর করে।
রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা সম্ভব হলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
উন্নত বিশ্বে ক্যান্সার রোগীদের বেঁচে থাকার হার সম্পর্কিত তথ্য সংরক্ষিত থাকলেও আমাদের দেশে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে আমাদের দেশের মানুষ স্বাস্থ্য বিষয়ে খুব বেশি সচেতন নয়। যার ফলে রোগের প্রারম্ভিক অবস্থায় ডাক্তারের কাছে যাওয়া বা রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশে ব্লাড ক্যান্সার চিকিৎসার সফলতার হার কম দেখা যায়।
References
Cleveland Clinic. (2022, 04 27). Blood Cancer. Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/22883-blood-cancer
Khaleque, P. K. (2016). White Blood Cell Disorders. In P. K. Khaleque, Practical Pathology and Microbiology (p. 233). Dhaka: Authors.
Watson, S. (2020, June 12). Types of Blood Cancer. Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/cancer/lymphoma/types-and-differences
Last Updated on November 1, 2023
Leave A Comment