তেঁতুল টক জাতীয় একটি ফল যার বৈজ্ঞানিক নাম হলো Tamarindus indica. পাকা তেঁতুল দেখতে যেমন লোভনীয় তেমনি নানাবিধ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। তেঁতুল শরীরের জন্য বিভিন্ন উপকারিতা বয়ে আনতে পারে।  

আমাদের দেশে তেঁতুল খুব সহজলভ্য এবং অহরহ কিনতে পাওয়া যায়। এই অনুচ্ছেদে তেঁতুল সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে। যেমনঃ তেঁতুলের পুষ্টি উপাদান, তেঁতুল খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা, দৈনিক কতটুকু পরিমাণ তেঁতুল খাওয়া নিরাপদ, অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে কি কি সমস্যা হতে পারে, খাওয়া ছাড়া তেঁতুলের অন্যান্য ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়গুলো জানতে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়তে থাকুন।  

পুষ্টি উপাদান 

১০০ গ্রাম পাকা তেঁতুল থেকে ২৩৮ ক্যালরি পাওয়া যায়। এছাড়াও তেঁতুলে আরো যেসব পুষ্টি উপাদান রয়েছে তা হলোঃ (Shubrook, 2023) 

পুষ্টি উপাদানপরিমাণ 
কার্বোহাইড্রেট  ৬২.৫ গ্রাম
ফাইবার ৫.১ গ্রাম 
প্রোটিন ২.৩ গ্রাম
ফ্যাট ০.৬ গ্রাম 
ভিটামিন এ৯ মাইক্রোগ্রাম 
ভিটামিন বি৩ ১.৯ মিলিগ্রাম 
ভিটামিন বি৯ ১৪ মাইক্রোগ্রাম 
ভিটামিন সি ৩.৫ মিলিগ্রাম 
পটাশিয়াম ৬২৮ মিলিগ্রাম 
ক্যালসিয়াম ৭৪ মিলিগ্রাম 
ম্যাগনেসিয়াম ৯২ মিলিগ্রাম 
আয়রন ২.৮ মিলিগ্রাম 

এছাড়াও সামান্য পরিমাণে ভিটামিন বি১, বি২, বি৫ ও বি৬ সহ ভিটামিন কে, কপার, সোডিয়াম, ফসফরাস, সেলেনিয়াম ইত্যাদি রয়েছে। 

তেঁতুলের স্বাস্থ্য উপকারিতা 

তেঁতুল খাওয়ার ফলে যেসব স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যায় তা নিচে তুলে ধরা হলো।‌ (Jennings, 2021)

হার্টের জন্য উপকারী  

তেঁতুলে প্রচুর পরিমাণ ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস (বিশেষ করে পলিফেনল ও ফ্ল্যাভোনয়েড) রয়েছে যার এন্টিঅক্সিডেন্ট (Antioxidant) গুণাবলী রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের (LDL– low density lipoprotein) মাত্রা কমাতে এবং উপকারী কোলেস্টেরলের (HDL– high density lipoprotein) মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। রক্তে কোলেস্টেরল স্বাভাবিক মাত্রায় থাকলে হার্টের রোগে (হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম থাকে।  

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে 

Measuring Blood pressure

তেঁতুলে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম রয়েছে যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। প্রতিদিন অল্প পরিমাণে তেঁতুল খাওয়ার ফলে ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে হঠাৎ ব্লাড প্রেসার অনেক বেশি বেড়ে গেলে দ্রুত নিয়ন্ত্রণের জন্য তেঁতুল খাওয়া কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় না। বরং এমতাবস্থায় বিশ্রাম করতে হবে এবং ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণের ওষুধ খেতে হবে। 

প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে 

তেঁতুলে থাকা ফাইটোনিউট্রিয়েন্টসের প্রদাহ নাশক গুণাবলী রয়েছে যা শরীরের ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। বিশেষ করে বাত ব্যথা ও আর্থ্রাইটিসের রোগীদের জন্য তেঁতুল খাওয়া ব্যথা ও প্রদাহ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে প্রদাহ জনিত কোষের ক্ষতি ঠেকায় বা কোষের অকাল মৃত্যু রোধ করে।‌ 

লিভার সুস্থ রাখতে সাহায্য করে  

লিভার মানুষের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। তেঁতুলের এন্টিঅক্সিডেন্ট ও প্রদাহ নাশক গুণাবলী ফ্রি রেডিক্যালস (Free radicals) নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে লিভার ভালো রাখে তথা লিভারের রোগ প্রতিরোধ করে। এছাড়াও লিভার থেকে ক্ষতিকর বা দূষিত পদার্থ বের করে দেয় এবং লিভারের এনজাইমের মাত্রা ভালো রাখতে সাহায্য করে।  

তেঁতুল ও ডায়াবেটিস 

তেঁতুলের কার্বোহাইড্রেটের ধরন হলো সরল শর্করা বা চিনি। তবে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ তেঁতুলে থাকা এই সরল শর্করা ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না। কারণ তেঁতুলের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খুব কম অর্থাৎ তেঁতুল খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দ্রুত বেড়ে যায় না। আর তাছাড়া তেঁতুল খুব সামান্য পরিমাণে খাওয়া হয় বলে শর্করা খুব বেশি গ্রহণ করা হয় না। 

তেঁতুলের প্রদাহ নাশক ও এন্টি-ডায়াবেটিক (Antidiabetic) গুণাবলী সুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে‌‌ ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়।

ক্ষতিকর অণুজীব ধ্বংস করে  

তেঁতুলের রয়েছে এন্টিমাইক্রোবিয়াল (Antimicrobial) গুণাবলী। অর্থাৎ শরীরের ক্ষতিকর অণুজীব (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ফাংগাস) ধ্বংস করতে সহায়তা করে। 

ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে 

তেঁতুলের এন্টিঅক্সিডেন্ট গুণাবলী ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। বিশেষ করে কিডনির ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে।  

তেঁতুল কিভাবে ব্যবহার করবেন? 

পাকা তেঁতুল সরাসরি খাওয়া যায়। তবে খেতে খুব টক স্বাদ বিশিষ্ট বলে অনেকেই সরাসরি খেতে পছন্দ করেন না। তাদের জন্য বিভিন্ন খাবার, সালাদ এমনকি চায়ের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। আবার রান্নার কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে।  

তেঁতুলের আচার তৈরিতে প্রচুর পরিমাণে চিনি ও লবণ যোগ করা যাবে না। কারণ অতিরিক্ত চিনি ও লবণ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। 

তেঁতুলের আচার সংরক্ষণের জন্য কাঁচের জার/পাত্র ব্যবহার করা উত্তম। কারণ এতে গুণাগুণ, স্বাদ ও গন্ধ অক্ষুণ্ন থাকে।  

বাজারে তেঁতুলের চাটনি কিনতে পাওয়া যায় যা খেতে খুব মজাদার লাগে। তবে এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে চিনি ও লবণ মেশানো থাকে। তাই এগুলো খাওয়া উচিত নয়।

খাওয়া ছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে তেঁতুল ব্যবহার করা যায়।‌ আর সেটি হলো ধাতব বস্তু, স্বর্ণ বা তামার তৈরি জিনিসপত্র পরিষ্কার করার কাজে তেঁতুল ব্যবহার করে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। তেঁতুলে থাকে টারটারিক এসিড (Tartaric acid) যা ধাতব বস্তু থেকে ময়লা দূর করতে সাহায্য করে। 

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া 

প্রায় সবার জন্যই তেঁতুল খাওয়া নিরাপদ। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া যাবে না। প্রতিদিন ১০ গ্রামের বেশি তেঁতুল খেলে তা অতিরিক্ত হিসেবে গণ্য হবে। এমতাবস্থায় যেসব সমস্যা দেখা দিতে পারে তা হলোঃ 

  • তেঁতুলের ল্যাক্সাটিভ (Laxative) বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অর্থাৎ অতিরিক্ত পরিমাণে তেঁতুল খাওয়ার ফলে ডায়রিয়া হতে পারে। 
  • ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য অতিরিক্ত পরিমাণে তেঁতুল খাওয়া যাবে না।‌ কারণ এতে রক্তে সুগারের মাত্রা কমে যেতে পারে। 
  • তেঁতুলে‌ থাকা টারটারিক এসিড দাঁতের এনামেল ক্ষয় করতে পারে। তাই তেঁতুল খাওয়ার পর তা যেন দাঁতের সাথে লেগে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।  
  • খালিপেটে তেঁতুল খাওয়ার ফলে এসিডিটি সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। 

এছাড়াও কারো ক্ষেত্রে তেঁতুল খাওয়ার ফলে এলার্জি (Allergy) দেখা দিলে তাদের জন্য তেঁতুল এড়িয়ে যেতে হবে। এলার্জির লক্ষণ হলো- ত্বকে র‍্যাশ, মুখমণ্ডল ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব ইত্যাদি। 

একসময় ম্যালেরিয়া সহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় তেঁতুল ব্যবহারের প্রচলন ছিল। তবে বর্তমানে ম্যালেরিয়া হোক অথবা অন্য কোনো রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসা হিসেবে তেঁতুল ব্যবহার করা যাবে না। বরং ওষুধের পাশাপাশি তেঁতুল খাওয়া যাবে কিনা সেই ব্যাপারে চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। কারণ এমন অনেক ওষুধ (এসপিরিন, আইবুপ্রোফেন, ডায়াবেটিসের ওষুধ ইত্যাদি) রয়েছে যেগুলো চলাকালীন সময়ে তেঁতুল খেলে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যাওয়া বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।  

মনে রাখবেন, তেঁতুল একটি ফল মাত্র। কোনো ওষুধ বা পথ্য নয়। তাই অতিরঞ্জিত ফলাফল প্রত্যাশা করে অতিরিক্ত পরিমাণে তেঁতুল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।‌

Bibliography

Jennings, K.-A. (2021, August 23). What Is Tamarind? A Tropical Fruit with Health Benefits. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/tamarind

Shubrook, N. (2023, March 17). Top 6 health benefits of tamarind. Retrieved from BBC Good Food: https://www.bbcgoodfood.com/howto/guide/top-6-health-benefits-of-tamarind/amp

Last Updated on October 31, 2023