সাদা-কালো মেশানো আঁচর দেয়ার মতো দাগ, কোথাও নিচু তো কোথাও উঁচু, এমনই দেখতে হয় এই স্ট্রেচ মার্কস। গর্ভবতী মায়েদের শরীরে স্ট্রেচ মার্কস দেখা দেওয়ার নানান কারণ রয়েছে, যেমন সন্তান জন্মদান পরবর্তী অবস্থা, হঠাৎ ওজন বেড়ে যাওয়া, কিংবা অতিরিক্ত ওজন হঠাৎ কমে যাওয়া।

শরীরের স্বাভাবিক মসৃণতা ও সৌন্দর্যকে ব্যহত করে বলে, স্ট্রেচ মার্কসের প্রতিকার খোজার মানুষের অভাব নেই। কেউ ডাক্তারের কাছে যান, তো কেউ ব্যবহার করেন নানান ক্রিম। তবে সবসময় সব প্রোডাক্টে এই স্ট্রেচ মার্কস কমানোর যাত্রা হয় না ফলপ্রসূ। অথচ, অনেক কিছু ব্যবহার না করে, অনেক অর্থ খরচ না করেও, ত্বকের অবস্থা বুঝে কিছু কার্যকরী উপাদানের সাহায্যে কিন্তু সহজেই কমিয়ে আনা যেতে পারে এই স্ট্রেচ মার্কসের দাগ। এগুলো নিয়েই আজকের আলোচনা। 

আমাদের শরীরের ত্বক যখন কোন কারনে অনেকখানি প্রসারিত হয়, তখন ত্বকের একদম উপরের লেয়ারে কোলাজেন ও ইলাস্টিসিটির পরিমাণ কমে যায়। ফলে ত্বকে ধরে ফাটল। সেই ফাটা দাগকেই আমরা বলি স্ট্রেচ মার্কস।  

১. ভিটামিন-এ

ত্বকের পরিচর্যায় ভিটামিন-এ এর যে রূপটি ব্যবহৃত হয়, সেটি হচ্ছে রেটিনল। মানব দেহের সেলের গঠন ও নতুন সেল তৈরির হার নিয়ন্ত্রণে যার রয়েছে ব্যপক ভূমিকা। যেহেতু ত্বকের উপরিভাগের সেল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েই দেখা দেয় স্ট্রেচ মার্কস। তাই সেইসব ফাটা যায়গায় নিয়মিত রেটিনল ব্যবহার করলে, ক্ষতিগ্রস্থ ত্বকের কোষ ধীরে ধীরে সেরে উঠে, কোলাজেনের উৎপাদন বাড়তে থাকে এবং হালকা হয়ে আসতে থাকে স্ট্রেচ মার্কসের দাগ।

গর্ভবতী, দুগ্ধদানকারী অবস্থায় রেটিনল ব্যবহার করা উচিত নয়।

২. হায়ারুলোনিক এসিড

ক্ষতিগ্রস্থ ত্বক সারাতে ও ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে আরেকটি বিশেষ উপাদান হচ্ছে হায়ারুলোনিক এসিড। প্রসারনের কারনে স্ট্রেচ মার্কসের ফাটা জায়গাগুলো পর্যাপ্ত আর্দ্রতা হারায়। রুক্ষতার কারনেও ত্বকের সেইসব ক্ষতিগ্রস্থ যায়গার ইলাস্টিসিটি বা টানটান ভাব ফেরত আসতে পারে না। আর কোলাজেনের অভাব তো থাকেই স্ট্রেচ মার্কসের যায়গায়। 

হায়ারুলোনিক এসিড যুক্ত ক্রিম, সেরাম বা লোশন স্ট্রেচ মার্কসের যায়গায় ব্যবহার করলে এটি ক্ষতিগ্রস্থ ত্বকের হারানো আর্দ্রতাকে ফিরিয়ে আনতে কাজ করে। রুক্ষতা দূর হয়ে ত্বক ভেতর থেকে সেরে উঠতে থাকে। স্ট্রেচ মার্কস হালকা হয়ে ধীরে ধীরে কমতে থাকে দাগ। 

চামড়া কুচকানো, ঝুলে পড়া, ত্বক ফাটার মতো নানান সমস্যার পেছনের অন্যতম কারণ, ত্বকে পর্যাপ্ত কোলাজেনের অভাব দেখা দেয়া। 

৩. সেনটেলা বা সীকা ক্রিম

সেনটেলা এসিয়াটিকা (Centella asiatica) কোরিয়ান স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টে বহুলভাবে ব্যবহার হওয়া একটি প্রাকৃতিক উপাদান। সেনটেলা যুক্ত ক্রিমগুলোকে বলা হয় সিকা ক্রিম (Cica Cream) । মূলত অনাকাঙ্ক্ষিত দাগ ও ক্ষতিগ্রস্থ ত্বক সারানোর জন্যই এই ক্রিম ব্যবহার করা হয়। ত্বকের ক্ষতিগ্রস্থ যায়গায় প্রদাহ কমিয়ে কোলাজেনের উৎপাদন হার বাড়াতেও এটি বেশ কার্যকরী। সিকা ক্রিমের এই ধর্মই স্ট্রেচ মার্কস কমাতেও কাজে লাগে বলা যায়।

কিছু গবেষণায় এমনটিও পাওয়া গেছে যে, গর্ভাবস্থায় সেনটেলা বা সিকা ক্রিম ব্যবহার করলে ব্যাপক হারে স্ট্রেচ মার্কসের দাগ হওয়াও প্রতিরোধ করা সম্ভব।

স্ট্রেচ মার্কসের প্রাকৃতিক প্রতিকার

স্ট্রেচ মার্কস দূর করতে যে শুধু বাজার থেকে কেনা দামী ক্রিম, লোশন বা ওষুধই লাগবে, তা কিন্তু নয়। ঘরে থাকা প্রাকৃতিক উপাদান দিয়েও কিন্তু এই অনাকাঙ্ক্ষিত দাগকে ধীরে ধীরে বিদায় দেয়া সম্ভব। আসুন জেনে নেই স্ট্রেচ মার্কস দূরীকরণে এমনই কয়েকটি কার্যকরী ঘরোয়া উপাদানের কথা।

১. এলোভেরা

যে কোন পোড়া, কাঁটা বা ক্ষত এর দাগ হালকা করতে প্রাকৃতিক মহৌষধ হিসেবে কাজ করে এলোভেরা।  স্ট্রেচ মার্কসের যায়গায় ফ্রেশ এলোভেরা পাতা থেকে বের করা জেলি ব্যবহার করলে, সেই স্থান রুক্ষতা কাঁটিয়ে আর্দ্রতা ফিরে পায়। এলোভেরার ত্বক মেরামত করার ক্ষমতা কোষের ভেতর থেকে ত্বকের ক্ষয়ক্ষতি সারিয়ে তুলতে থাকে। এতে ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসতে থাকে স্ট্রেচ মার্কসের দাগ। 

২. নারকেল তেল

আমাদের ত্বকের উপরিভাগের সুরক্ষা বলয়কে স্বাস্থ্যকর রাখার ক্ষমতা রয়েছে বিশুদ্ধ নারকেল তেলের মধ্যে। গভীর থেকে ত্বকের রুক্ষতা দূর করা ছাড়াও ত্বকের বিভিন্ন ইনফেকশন দূর করতেও কার্যকরী এই প্রাকৃতিক এন্টি-বায়োটিক নারকেল তেল। বেশ কিছু গবেষণাতেও প্রমান মেলে যে, ত্বকের কোন ক্ষত দ্রুত সারিয়ে তুলতে পারে নারকেল তেল।

ত্বকের প্রসারনে ক্ষতিগ্রস্থ ত্বকের ফলাফল স্ট্রেচ মার্কসের উপর নিয়মিত নারকেল তেল ম্যাসাজ করলে, এটি ক্ষতিগ্রস্থ ত্বককে পুনর্গঠিত করে স্ট্রেচ মার্কস দূর করতে সাহায্য করে। এমনকি গর্ভাবস্থায়ও নিয়মিত পেটে নারকেল তেল ম্যাসাজ করে স্ট্রেচ মার্কস প্রতিরোধ করাও সম্ভব। তবে নারকেল তেলে কারো এলার্জি থাকলে এটি এড়িয়ে চলাই ভালো। 

৩. অলিভ অয়েল

আরেকটি প্রাকৃতিক তেল অলিভ অয়েল, যা স্ট্রেচ মার্কস কমাতে কার্যকরী। অলিভ অয়েলে আছে ভিটামিন-ই, যা ত্বককে রুক্ষ হতে দেয় না, মোলায়েম ও কোমল রাখে। গর্ভাবস্থায় নিয়মিত অলিভ অয়েল ম্যাসাজ করে ত্বককে নরম রাখলে, অতিরিক্ত প্রসারনেও চামড়ায় মাত্রাতিরিক্ত ফাটা দাগ বা স্ট্রেচ মার্কস পড়ে না। আর স্ট্রেচ মার্কস হয়ে যাওয়ার পরবর্তী অবস্থাতেও নিয়মিত অলিভ অয়েল ব্যবহার করা গেলে, এতে থাকা ভিটামিন-ই ক্ষতিগ্রস্থ ত্বককে পুনর্গঠিত হতে সাহায্য করার মাধ্যমে স্ট্রেচ মার্কস কমিয়ে আনতে পারে। 

৪. আলুর রস

অনেক সময় স্ট্রেচ মার্কসের চামড়ার ফাটাগুলো কমে গেলেও, কালো কালো আচড়ের মতো দাগগুলো রয়ে যায়। এমনটা হয় ক্ষতিগ্রস্থ ত্বকের নিচে মেলানিনের অসামঞ্জস্যতা ও জমাট বাঁধার জন্য। এই ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে আলুর রস। 

কারণ আলুর রস হচ্ছে প্রাকৃতিক ব্লিচ। যা ত্বকের নিচে জমাট বাঁধা মেলানিনকে কমিয়ে ত্বকের কালো দাগ ও হারানো উজ্জ্বলতা ফেরাতে সাহায্য করে। 

আলু বেটে বা ব্লেন্ড করে তার থেকে রস চিপে বের করে নিতে হবে। তারপর তুলা বা আঙ্গুল দিয়ে স্ট্রেচ মার্কসের উপর লাগাতে হবে। অবশ্যই রাতারাতি দাগ গায়েব হয়ে যাবে না। তবে নিয়মিত ব্যবহারে পরিবর্তন দেখতে পাবেন নিজেই। 

স্ট্রেচ মার্কস জিনিসটা কিন্তু বেশ নাছোড়বান্দা। একবার এই দাগ শরীরে দেখা দিলে, একে রাতারাতি দূর করার আশা করাও ভুল। তবে, সময়সাপেক্ষ হলেও, শরীরের এসব অনাকাঙ্ক্ষিত দাগ থেকে মুক্তি পেতে কে না চায়! তাই আপনাদের সুবিধার্থে ক্যামিকাল ও প্রাকৃতিক, দুই ধরনেরই কিছু উপাদানের নাম ও কাজ জানানর চেষ্টা করলাম। যেগুলোর সাহায্য নিয়ে স্ট্রেচ মার্কস দূর করার প্রক্রিয়া আপনার জন্য কিছুটা হলেও সহজ হবে। তবে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যে উপাদানই ত্বকে ব্যবহার করবেন না কেন, অবশ্যই নিশ্চিত হয়ে নিবেন সেটা আপনার ত্বকের জন্য উপযুক্ত কি না। এবং প্যাচ টেস্ট করতে ভুলবেন না।

Bibliography

Cobb C. (2023, May 8) How to Get Rid of Stretch Marks: 11 Ingredients to Try, Retrieved from Healthlone: https://www.healthline.com/health/home-remedies-for-stretch-marks 

Barode S. (2022, November 10) Natural Home Remedies for Stretch Marks, Retrieved from Pharmeasy: https://pharmeasy.in/blog/home-remedies-for-stretch-marks/

Last Updated on October 31, 2023