বর্তমানে একটি বড় সংখ্যক মানুষ ঝুকছে স্কিনকেয়ারের দিকে। আর স্কিনকেয়ার প্রেমীদের কাছে আজকাল বেশ পরিচিত ও জনপ্রিয় একটি নামই হচ্ছে “রেটিনল”। নামে পরিচিত হলেও এখনো অধিকাংশ মানুষই রেটিনল ও রেটিনলের বেসিক খুঁটিনাটি সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা রাখেন না। সবার ত্বকের ধরন তো আর একই রকম নয়। এই ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ত্বকের ভিন্নতার মধ্যে, কোন ত্বকের জন্য কখন রেটিনল মানানসই, তা সঠিকভাবে জানেন না অনেকেই।

এই জানা অজানার মধ্যে আঁটকে থেকে, স্কিনকেয়ারের এই জাদুকরী উপাদানটির জাদু থেকে যেন আপনার ত্বককে বঞ্চিত হতে না হয়। তাই আজকের আলোচনা “রেটিনল” নিয়েই। 

ভিটামিন-এ  এর একটি রূপ হচ্ছে রেটিনল। মানব দেহের সেল তৈরির হার নিয়ন্ত্রণের পেছনে দায়ী ভিটামিন-এ। যার সূত্র ধরেই আবিষ্কার ‘রেটিনল’ এর। 

কীভাবে কাজ করে রেটিনল?

How Retinol Works

যেহেতু মানুষের শরীরের সেল তৈরির পেছনে ভূমিকা রাখে ভিটামিন-এ, যা আবার রেটিনলের মূল উপাদান। সেক্ষেত্রে নিশ্চিতরূপে বলাই যায় যে, ত্বকের কোষের আভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্য ভালো রাখতে রেটিনল অবশ্যই কার্যকর। কোন ক্ষত, ব্রন থেকে হওয়া দাগ হালকা করা, রোদে ক্ষতিগ্রস্ত ত্বকের পোড়াভাব দূর করে উজ্জ্বলতা ফেরাতেও বেশ কার্যকরী রেটিনল। ত্বকের সেল তৈরিতে রেটিনল ভূমিকা রাখে বলেই এসব ক্ষতিগ্রস্ত ত্বকের কোষ ও সেল দ্রুত পূনর্গঠনের মাধ্যমে আগের অবস্থায় ফেরত নিতে সাহায্য করতে পারে এটি। 

ত্বকের সেল উৎপাদন ও গঠনের পাশাপাশি এটি ত্বকে কোলাজেনের স্বাভাবিক উৎপাদনও বাড়ায়। মানবদেহের একটি অন্যতম প্রয়োজনীয় প্রোটিন ‘কোলাজেন’, যা আমাদের পেশি, মাংস, টেন্ডন, রক্তনালী, অস্থি, টিস্যু, ত্বকসহ আরো অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্বাস্থ্যকর গঠনের জন্য বৃহৎ আকারে দায়ী। 

বয়সের সাথে শরীরে ও ত্বকে কোলাজেন উৎপাদনের স্বাভাবিক উৎপাদন মাত্রা কমতে থাকে। যার অভাবে দেখা দেয় চামড়া কুচকানো, বলিরেখা, ত্বক ফাটার মতো সমস্যা। সাথে শারীরিক অন্যান্য সমস্যা তো আছেই। 

ত্বকে কোলাজেনের মাত্রা বাড়ানোর মাধ্যমে বলিরেখা, চামড়ার ভাঁজ, বয়সের ছাপ, দাগ, রিংকেল ইত্যাদি সমস্যা দূর করে রেটিনল। কাজ করে বয়সের ছাপ দূরীকরণ বা এন্টি-এজিং এর। 

রেটিনল কাজ করতে কতক্ষণ সময় লাগে?

বাহ্যিকভাবে ত্বকে ব্যবহার করার সাথে সাথেই মূলত রেটিনল কোষের অভ্যন্তরে কাজ করা শুরু করে দেয়। তবে সেই কাজের ফলাফল নজরে পড়ার জন্য ও হাতে অনুভব করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত। এমনকি, ত্বকে রেটিনল ব্যবহার শুরুর প্রথম কিছুদিন ত্বকের অবনতিও দেখা দিতে পারে। তবে এতে ভয়ের কিছুই নেই। এই পরিবর্তন রেটিনলের কার্যপ্রক্রিয়ারই অংশ। 

রেটিনল কেন ব্যবহার করবেন?

আসুন জেনে নেই, ত্বকের কোন কোন সমস্যা গুলোর জন্য রেটিনল ব্যবহার সবচেয়ে কার্যকরী।  

Why Us Retinol

১. একনি ও ব্রন দূর করতে 

একনি বা ব্রনের সমস্যার জন্যই সাধারনত বাংলাদেশের চর্মরোগের ডাক্তার বা ডার্মাটোলজিস্টরা রেটিনল ব্যবহারের পরামর্শ দেন। ত্বকের খোলা লোমকূপে অতিরিক্ত তেল, মৃত কোষ ও ময়লা, জীবাণু আঁটকে থেকেই মূলত ব্রন বা একনি, ব্ল্যাকহেডস, হোয়াইটহেডস সবচেয়ে বেশি হয়। ত্বকে রেটিনল ব্যবহারের মাধ্যমে ত্বকের অতিরিক্ত তেল ও সেবাম নিঃসরণ কমানো এবং লোমকূপ পরিষ্কার রাখা যায়। এতে অনেকাংশে কমে আসে ব্রেকআউটস বা একনি, ব্রনের সমস্যা। 

২. পুরনো ক্ষত ও একনির দাগ হালকা করতে 

অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ক্ষত বা একনি থেকে ত্বকে দাগ তৈরি হতে পারে। ত্বকের স্বাভাবিক রং থেকে ভিন্নও হয়ে যেতে পারে ত্বকের কোন একটি অংশের রং। কোন দাগ সময়ের সাথে হালকা হলেও, কোন দাগ আবার স্থায়িভাবে বসে যায় ত্বকে। এসব দাগ মূলত ত্বকের কোষ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ফলে হয়। রেটিনল নিয়মিত সঠিক নিয়মে ব্যবহার করলে, ত্বকের ওইসব ক্ষতিগ্রস্থ সেল ধীরে ধীরে সেরে উঠতে থাকে। এতে হালকা হতে থাকে পুরনো দাগও। 

৩. ত্বকের রঙের অসামঞ্জস্যতা দূর করতে 

একনি, এলার্জি, হরমোনাল সমস্যা, রোদে পোড়া ইত্যাদি নানান কারনে ত্বকের রঙ্গে অসামঞ্জস্যতা আসে অনেকের। ত্বকের কোন এক বা একাধিক স্থানের রং শরীরের স্বাভাবিক রঙের তুলনায় গাড়, লালচে বা কালচে দেখা দেওয়ার এই সমস্যাকে বলে হাইপারপিগমেন্টেশন। ত্বকের ওইসব যায়গায় ত্বকের রঞ্জক পদার্থ মেলানিন জমাট বেধে যাওয়াই মূলত এই হাইপারপিগমেন্টেশনের পেছনে দায়ী। ত্বকে রেটিনল সঠিক উপায়ে নিয়মিত ব্যবহার করলে, এই জমাট বাঁধা মেলানিনকে এটি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। হাইপারপিগমেন্টেশন দূর করে ত্বকের রঙের সামঞ্জস্যতা ফেরাতে ব্যবহার করা যায় রেটিনল। 

৪. লোমকুপ ছোট করতে 

আমাদের সবার ত্বকেই রয়েছে ছোট ছোট অসংখ্য লোমকূপ। এগুলো দিয়ে ত্বকের অভ্যন্তরে অক্সিজেন যাতায়াত করে, নিঃসরণ হয় ত্বকের অতিরিক্ত তেল। অতিরিক্ত গরম, এলার্জি, হরমোনাল সমস্যা, অতিরিক্ত মেকআপ, প্রসাধনীর ব্যবহার, অপরিস্কার ত্বক ইত্যাদি নানান পরিস্থিতির কারনে ত্বকের এসব লোমকূপ স্বাভাবিক থেকে বড় হয়ে যেতে পারে। এতে ত্বক যেমন টানটান ভাব, মসৃণতা হারায়, অন্যদিকে ত্বকের তেলের নিঃসরণ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত তেল, ময়লা, জীবাণু, মৃত কোষ ইত্যাদি লোমকূপে জমাট বেধে ত্বকে স্বাভাবিক অক্সিজেনের যাতায়াতও বাধাগ্রস্থ হয়। যা ত্বকের নানান সমস্যার পেছনে বড় কারণ।  

ত্বকের লোমকূপ ছোট রাখতে ব্যবহার করা যেতে পারে রেটিনল। ত্বকের সেলের উৎপাদন ও গঠন বৃদ্ধির মাধ্যমে রেটিনল ত্বকের ওইসব খোলা লোমকুপ ছোট ও ভরাট করতেও ভূমিকা রাখে। 

৫. মেছতার দাগ দূর করতে 

মেছতা বা মেলাসমা- কপালে, গালে বা নাকের উপর স্বাভাবিক ত্বকের রং থেকে একটু গাঢ় ছোপ ছোপ দাগ। ত্বকের হাইপারপিগমেনটেশন জাতীয় সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের নারী ও পুরুষ উভয়েই আক্রান্ত হতে পারেন এতে। এর পেছনের কারণও ত্বকের রঞ্জক পদার্থ মেলানিনের অসামঞ্জস্যতা। যা হতে পারে সান প্রটেকশন ছাড়া অতিরিক্ত রোদে থাকা, হরমোনাল সমস্যা, বা জেনেটিক কারনেও। 

মেছতার দাগ পুরোপুরি মুছে দিতে পারে না রেটিনল। তবে, ত্বকের সব যায়গায় মেলানিনের সামঞ্জস্যতা ঠিক রাখার মাধ্যমে ধীরে ধীরে মেছতার দাগ হালকা করে দিতে পারে এটি। 

৬. চামড়ার ভাঁজ ও বলিরেখা দূর করতে 

বয়স বাড়ার সাথে সাথে ত্বকের কোলাজেন ও ইলাস্টিনের স্বাভাবিক মাত্রা কমতে থাকে। ত্বকের মধ্যবর্তী লেয়ার পাতলা হতে থাকে বলে, ত্বক তার স্বাভাবিক আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে না। ফলাফল হিসেবে ত্বক হারায় মসৃণতা, টানটান ভাব। ত্বকের বিভিন্ন স্থানের চামড়া ঝুলে পড়ে বা কুঁচকে যায়, ফেটে যায়, দেখা দেয় বলিরেখা বা রিংকেল। এইসব সমস্যারও সমাধান করতে পারে রেটিনল। ত্বকের ইলাস্টিসিটি বা টানটান ভাব ফেরায়, প্রতিরোধ করে বলিরেখা ও রিঙ্কেল। তাই ত্বকের দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করতে বা এন্টি-এজিং এর জন্য রেটিনল ব্যবহার খুবই কার্যকরী। 

৭. স্ট্রেচ মার্ক দূর করতে 

গর্ভাবস্থা ও তার পরবর্তী সময়ে শরীরে স্ট্রেচ মার্ক বা চামড়ায় ফাটা দাগ দেখা দেয়া একটি কমন সমস্যা। অতিরিক্ত মোটা বা ওজন বৃদ্ধি, কিংবা বেশি ওজন থেকে অনেক বেশি ওজন কমিয়ে ফেলা, এসব কারনেও শরীরে বিভিন্ন স্থানে দেখা দিতে পারে স্ট্রেচ মার্ক। এসব স্ট্রেচ মার্ক নিয়ে যারা দুশ্চিন্তায় আছেন, তারাও ত্বকের ওইসব স্থানে ব্যবহার করতে পারেন রেটিনল। রাতারাতি স্ট্রেচ মার্ক একদম গায়েব করে দিতে না পারলেও, ত্বকের কোষকে ধীরে ধীরে সারিয়ে তোলার মাধ্যমে রেটিনল ফাটা দাগগুলো হালকা করতে পারবে অনেকটাই। 

রেটিনল কখন ব্যবহার করবেন? 

রেটিনল বা রেটিনল যুক্ত যে কোন প্রোডাক্ট রাতে ব্যবহার করলেই সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। কারণ, সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মিতে এর কার্যকারিতা কমে যায়। ত্বকও সূর্যের আলোর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে যেতে পারে। তাই রাতের স্কিনকেয়ারে রেটিনল যুক্ত করাই সবচেয়ে উত্তম। 

কীভাবে বুঝবেন আপনার ত্বক রেটিনল ব্যবহারের জন্য উপযোগী? 

কখনোই তেমন স্কিনকেয়ারে অভ্যস্ত না এমন কেউ, হুট করেই রেটিনল ব্যবহার শুরু করে দিবেন না। যারা নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহার করেন, কেমিক্যাল এক্সফোলিয়েটর ব্যবহারে যাদের ত্বকে কোন সমস্যা হয় না, তাদের ত্বক সাধারনত রেটিনল ব্যবহারের উপযোগী। 

এছাড়াও, যাদের ত্বকে বলিরেখা, রিংকেলের মতো বয়সের ছাপ পড়ার আভাস দেখা যাচ্ছে, তারাও আগে ভাগে এন্টি-এজিং এর সতর্কতা হিসেবে রেটিনল স্কিনকেয়ারে যুক্ত করতে পারেন। 

এছাড়াও রেটিনল ব্যবহারের উপযোগী হতে হলে বয়স অবশ্যই ২৫ বছরের ঊর্ধ্বে হওয়া উচিত। কারণ, অন্তত ২৫ এর কম বয়সী, কিংবা বয়ঃসন্ধিকালের কারো ত্বক রেটিনল ব্যবহারের জন্য একেবারের উপযোগী বা পরিপক্ক নয়। ত্বকে কোন কাঁচা ক্ষত, ফাটা, র‍্যাশ, প্রদাহ থাকা অবস্থায়ও ত্বক রেটিনল ব্যবহারের উপযোগী নয়। 

কিছু সতর্কতা 

রেটিনলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেকের ক্ষেত্রে সাময়িক সময়ের জন্য ত্বকে জ্বালাপোড়া, শুষ্কতা, র‍্যাশ বা লালচে ভাব দেখা দিতে পারে। তবে, কিছু ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করলে এসব সমস্যাও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।

  • স্কিনকেয়ারে যুক্ত প্রোডাক্টগুলির মধ্যে একাধিক প্রোডাক্টে যেন রেটিনল না থাকে। 
  • প্রতিদিনের বদলে এক দিন পর পর রেটিনল ব্যবহার করা যেতে পারে। 
  • ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধোয়ার ৩০ মিনিট পর রেটিনল ত্বকে ব্যবহার করা উচিত।
  • অবশ্যই নিয়মিত কমপক্ষে ৩০ এসপিএফ এর সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। 
  • রেটিনল ব্যবহারে ত্বক শুস্ক হয়ে যেতে পারে। তাই এর সাথে আপনার ত্বকে মানানসই একটি ভালো ময়েশ্চারাইজারও ব্যবহার করা উচিত। 
  • রেটিনল ব্যবহারের সাথে একই সময়ে অন্য কোন একটিভ বা কেমিক্যাল এক্সফোলিয়েটর ব্যবহার করা উচিত নয়। 

কেউ উচ্চ মাত্রার রেটিনল ব্যবহার করতে চাইলে, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।   

মসৃণ, সুন্দর ও তারুণ্যে ভরপুর ত্বক তো সবারই কাম্য। তবে ত্বক সুন্দর রাখতে গিয়ে যেন ভুল প্রোডাক্টের গোলকধাঁধায় কাউকে পড়তে না হয়। রেটিনল নিয়ে আজকের আলোচনার মূল উদ্দেশ্য এটিই ছিলো যে, আপনি যেন আপনার ত্বকের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা বুঝে শুনে স্কিনকেয়ারে রেটিনল যুক্ত করতে পারেন।

Bibliography

Cleveland Clinic medical professional (2022, June 6) Retinol, Retrieved from cleveland clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/treatments/23293-retinol

Last Updated on October 31, 2023