শরীরের ওজন কমানোর উপায় হিসেবে হাঁটার উপকারিতা অপরিসীম। এটা প্রায় সবার কাছেই খুব সাধারণ এবং জানা কথা বলে মনে হবে। তবে এই অনুচ্ছেদে আপনি হাঁটার উপকারিতা কি সেই সম্পর্কে বিস্তারিত জানার‌ পাশাপাশি চমকপ্রদ কিছু বিষয় শিখতে পারবেন। যেমনঃ

  • ১ ঘন্টা হাঁটাহাঁটি করলে আপনার শরীরের ওজন কতটুকু কমবে?
  • ৫ মাসে ১০ কেজি ওজন কমানোর জন্য দৈনিক কত স্টেপস বা কদম হাঁটতে হবে?
  • দ্রুত হাঁটার উপকারিতা কত বেশি?
  • হাঁটার সময় কোন বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি?

হাঁটার উপকারিতা

সুস্থ জীবনের জন্য দৈনিক নিয়ম করে ব্যায়াম করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আর এই ব্যায়াম বলতে সবার আগে হাঁটাহাঁটি করাকে বোঝানো হয়ে থাকে। কারণ, এটাই দৈনন্দিন জীবনের সবচেয়ে সহজ এবং পরিচিত ব্যায়াম। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে অনেকের হাঁটার অভ্যাস কমে যায় এবং সারাক্ষণ শুয়ে বসে থাকতে বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু আপনি জানলে অবাক হবেন যে, সুস্থভাবে দীর্ঘায়ু নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য হাঁটার গুরুত্ব অপরিসীম। হাঁটার উপকারিতা সমূহ এর মধ্যে রয়েছে-

  •  শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
  • রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL- low density lipoprotein) কমায় এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL- high density lipoprotein) এর মাত্রা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে হার্ট ভালো রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
  • হাইপারটেনশন তথা উচ্চ রক্তচাপ এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে।
  • মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেকটাই কমিয়ে দেয়।

হাঁটার সঠিক নিয়ম (স্টেপ ক্যালকুলেশন সহ)

আমরা সারা জীবনে কতটুকু হাঁটি তার পরিমাণ হিসাব করা অসম্ভব। প্রতিনিয়ত আমরা কিছু না কিছু পথ হাঁটতে বাধ্য থাকি আর এই হাঁটাহাঁটি যদি সঠিক নিয়মে প্রতিদিনের ব্যায়াম হিসেবে করা যায়, তাহলে সহজেই ফিট থাকা সম্ভব। এছাড়াও যাদের শরীরে অতিরিক্ত ওজন রয়েছে তাদের জন্য হাঁটাহাঁটি হতে পারে ওজন কমানোর উত্তম উপায়।

আপনি শুধুমাত্র নিয়মিত হাঁটার মাধ্যমে এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন কমাতে পারেন। আর এই হিসেব অনুযায়ী মাত্র ৫ মাসে কোনো রকম ডায়েট করা ছাড়া অথবা জিম এ না গিয়ে আপনি সর্বোচ্চ ১০ কেজি পর্যন্ত ওজন কমাতে পারেন।

শরীরের ওজন বাড়তি কিনা কিভাবে বুঝবেন?

প্রথমত, হিসাব করতে হবে আপনার উচ্চতা অনুযায়ী শরীরের ওজন বাড়তি আছে কিনা। বিএমআই (BMI- Body mass index) দ্বারা এটা খুব সহজেই বের করা যায়। এর জন্য আপনার উচ্চতা মেপে তা মিটার এককে এবং শরীরের ওজন কেজিতে বের করে নিতে হবে। অতঃপর ওজনকে ভাগ করতে হবে উচ্চতার বর্গ দিয়ে। সূত্রটি হলোঃ

বিএমআই= ওজন÷উচ্চতা^২

এই মান যদি ১৮.৫ থেকে ২৪.৯ এর মধ্যে থাকে, তাহলে আপনার শরীরের ওজন একদম ঠিক আছে। আর ২৫ এর বেশি হলে তা বাড়তি ওজন এবং ৩০ এর পর থেকে স্থূলতা (Obesity) হিসেবে ধরা হয়। স্থূলতার ফলে আপনার দেহে ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগ সহ নানাবিধ জটিল রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

স্টেপ ক্যাল্কুলেশন

সাধারণত একজন মানুষ ১ ঘন্টায় ৪ মাইল পর্যন্ত হাঁটতে পারে এবং এতে প্রায় ৪০০ ক্যালরি পর্যন্ত খরচ হয়। এই হিসেবে আপনি যদি আরো বেশি হাঁটেন, তাতে প্রতি মাইলে অতিরিক্ত আরো ১০০ ক্যালরি খরচ হবে।

আপনি যদি প্রতি সপ্তাহে আপনার শরীরের ৫০০ গ্রাম তথা আধা কেজি ওজন কমাতে চান, তবে এর জন্য প্রায় ৩৯০০ ক্যালরি খরচ করতে হবে।

আর ১০০ ক্যালরি খরচ করতে আপনাকে হাঁটতে হবে ১ মাইল।

তাহলে ৩৯০০ ক্যালরি খরচের জন্য ১ সপ্তাহে আপনাকে হাঁটতে হবে ৩৯ মাইল।

১ মাইল প্রায় ২০০০ স্টেপস এর মতো।

সুতরাং ৩৯ মাইল = ৭৮,০০০ স্টেপস বা কদম, যা আপনাকে প্রতি সপ্তাহে ফেলতে হবে আধা কেজি ওজন কমানোর জন্য।

অর্থাৎ দৈনিক প্রায় ১১,০০০ স্টেপস আপনাকে নিতে হচ্ছে।

Step calculation

দৈনিক ১১,০০০ স্টেপস শুনতে খুব বড় অংক মনে হলেও আসলে তা কঠিন কিছু নয়। বরং সকালে ও বিকালে মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট করে হাঁটতে পারলে দিনের টার্গেট পূরণ করা সম্ভব।

এই হিসেব অনুযায়ী ১ ঘন্টায় ৪ মাইল হাঁটলে ৪০০ ক্যালরি ব্যয় হবে। যার জন্য শরীরের ওজন কমবে প্রায় ৫০ গ্রামের মতো। তবে একবার হেঁটে এসেই এই পরিবর্তন দেখা যাবে না। আর তাছাড়া ৫০ গ্রাম পরিমাণ নির্ণয় করাও কঠিন। তাই, মাসে একবার ওজন মেপে পরিবর্তন লক্ষ্য করুন।

প্রতিদিন কত কদম (স্টেপ) হাঁটলেন কিভাবে তা হিসাব রাখবেন?

আপনি ঠিক কতটুকু হাঁটলেন তা ‘স্মার্ট ওয়াচ’ ব্যবহার করে সহজেই জানতে পারবেন। এই ওয়াচ গুলো বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় এবং বাজারে অহরহ কিনতে পাওয়া যায়। স্মার্ট ওয়াচের পরিবর্তে মোবাইলে এপস ব্যবহারের মাধ্যমেও গণনা করা যেতে পারে। তবে স্মার্ট ওয়াচের কার্যকারীতা তুলনামূলকভাবে বেশি ভালো এবং নির্ভরযোগ্য। যা হোক, স্মার্ট ওয়াচ ও এপসের মাধ্যমে কত স্টেপস হাঁটলেন, কত গতি, কতক্ষণ সময় এমনকি কত ক্যালরি খরচ হলো তা জানা সম্ভব। এছাড়াও এটি ব্যবহারের ফলে আপনার দৈনিক হাঁটার ইচ্ছা এবং গতি দুটোই বৃদ্ধি পাবে।

জোরে হাঁটার উপকারিতা

গতি বিষয়ে কথা উঠলে যে প্রশ্নটি মনে আসে তা হলো, জোরে হাঁটার উপকারিতা কি অনেক বেশি? হ্যাঁ, কারণ আপনার শরীরের ওজন এবং হাঁটার গতি বেশি হলে ক্যালরি খরচ বেশি হবে। ধরুন, আপনার শরীরের ওজন ১৫০ পাউন্ড বা ৬৮ কেজি এবং আপনি হাঁটলেন ঘন্টায় প্রায় ৪ কিলোমিটার বেগে। এক্ষেত্রে ক্যালরি ব্যয় হবে প্রায় ২০৪ ক্যালরি। পক্ষান্তরে, হাঁটার গতি বেড়ে যদি ৫ কিলোমিটার হয়, সেক্ষেত্রে খরচ হবে ২৪৮ ক্যালরি।

একইভাবে, আপনার শরীরের ওজন যদি হয় ১৮০ পাউন্ড বা ৮২ কেজি, সেক্ষেত্রে ঘন্টায় ৪ কিলোমিটার বেগে হাঁটলেই খরচ হবে ২৪৬ ক্যালরি। অর্থাৎ আপনার শরীরের ওজন বেশি হলে অথবা জোড়ে হাঁটলে, ক্যালরি খরচ বৃদ্ধি পাবে যা ওজন কমানোর জন্য জরুরী। (Walle, 2020)

দৈনিক হাঁটার টার্গেট পূরণে সহজ টিপস

ওজন কমানোর জার্নিতে হাঁটার জন্য আলাদাভাবে সময় বের করতে না পারলেও দৈনিক ১১,০০০ স্টেপস ফেলতে নিচের টিপসগুলো কাজে লাগাতে পারেন-

  • দৈনিক বাচ্চাকে স্কুল বা কলেজে পায়ে হেটে নিয়ে যান
  • বাজার করতে রিকশায় না চড়ে বরং হেটে যাওয়ার অভ্যাস করুন
  • কর্মক্ষেত্র যদি কাছাকাছি হয় তবে পায়ে হেটে যান, অথবা দূরে হলে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত হেটে যান। আবার ফেরার পথে এক স্ট্যান্ড আগে নেমে হেঁটে বাসায় আসতে পারেন
  • মেঘলা ওয়েদার উপভোগ করার জন্য বাইরে হাঁটতে বের হওয়া
  • আশে পাশে পার্ক থাকলে দৈনিক কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করুন
  • লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি বেয়ে উঠা নামা করুন

যতটুকু সময় হাঁটবেন একটু সতর্ক থাকবেন যেন আপনার দেহভঙ্গি সঠিক ভাবে থাকে। এতে করে হাঁটার পুরো উপকারিতা টুকুই আপনি পেতে পারেন।

  • মাথা সোজা এবং হালকা উপরের দিকে রাখুন
  • দৃষ্টি ১০ ফিট সামনের দিকে রাখুন
  • লম্বা লম্বা পা ফেলুন এবং যতটা সম্ভব জোরে হাঁটুন
  • মেরুদণ্ড সোজা রেখে হাঁটুন
  • হাঁটার পরে পেটুকের মতো খাওয়া থেকে বিরত থাকুন
  • সমস্যা মনে হলে, সপ্তাহে একদিন রেস্ট নিতে পারেন
  • অথবা, প্রথম দিকে সপ্তাহে মিনিমাম ৩ দিন ১৫-২০ মিনিট করে হাঁটার অভ্যাস করুন। আস্তে আস্তে সময় বাড়িয়ে আধা ঘন্টা থেকে ১ ঘন্টা করুন।

সকালে হাঁটার উপকারিতা বেশি নাকি বিকালে হাঁটার উপকারিতা?

এই প্রশ্নের উত্তরে এক্সপার্টদের মতামত হলো, সকালে বা ভোরে হাঁটার উপকারিতা তুলনামূলক বেশি। তবে বিকেলে অথবা রাতে হাঁটার উপকারিতা একদম কম তা নয়। বরং হাঁটাহাঁটির ব্যাপারে নির্দেশনা হলো, আপনার সুযোগ এবং সুবিধামতো সময় কোনটি তা খুঁজে বের করে সেই অনুযায়ী হাঁটুন। (Gent, n.d.)

ওজন কমানোর উপায় কি তা জানার পর আশা করি সবাই হাঁটাহাঁটির অভ্যাস গড়ে তুলবেন। আপনার শরীরের ওজন যদি অতিরিক্ত নাও হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে হাঁটার মাধ্যমে আপনি সুস্থ থাকবেন এবং শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।

 

References

Gent, P. (n.d.). Which is best? Morning walk vs Evening walk | Pros & Cons for both. From walking academy: https://walkingacademy.com/which-is-best-morning-walk-vs-evening-walk-pros-cons-for-both/

Walle, G. V. (2020, May 25). Does Walking 1 Hour Every Day Aid Weight Loss? From Healthline: https://www.healthline.com/nutrition/can-you-lose-weight-by-walking-an-hour-a-day

 

Last Updated on April 12, 2023