ব্রণ একটি কমন স্বাস্থ্য সমস্যা‌ যা ছেলে ও মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই হতে দেখা যায়। তবে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা বেশি রয়েছে। ব্রণের কারণ ও রিস্ক ফ্যাক্টর (ঝুঁকির কারণ) সম্পর্কে ধারণা থাকলে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা এড়ানো যেতে পারে। ব্রণ সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য একটি রোগ যার জন্য যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

এই অনুচ্ছেদে ব্রণের কারণ, রিস্ক ফ্যাক্টর, লক্ষণ, ব্রণের ধরন এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা বেশি কেন সেই সম্পর্কে জানতে পড়তে থাকুন। 

ব্রণ কি?

ত্বকের উপরিভাগে থাকা চুল বা লোমের গোড়া হেয়ার ফলিকল নামে পরিচিত। আর এই হেয়ার ফলিকলে অতিক্ষুদ্র আকৃতির সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড থাকে যা থেকে সেবাম নিঃসৃত হয়।

সেবাম (একধরনের তৈলাক্ত পদার্থ) ত্বকের শুষ্কতা প্রতিরোধ করে।‌ কোনো কারণবশত অতিরিক্ত পরিমাণ সেবাম নিঃসৃত হলে বা ত্বকের মৃত কোষ জমে হেয়ার ফলিকল বন্ধ হয়ে গেলে প্রদাহের সৃষ্টি হয় এবং ত্বকের উপরিভাগে ফুলে উঠে যাকে ব্রণ বলা হয়। 

কি কি কারণে ব্রণ হয়?

নানাবিধ কারণে ব্রণ হয়ে থাকে যা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।

শরীরে হরমোনের পরিবর্তন

ব্রণ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো শরীরে হরমোনের পরিবর্তন।‌ বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে যার ফলে টিনেজারদের ক্ষেত্রে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। 

ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের শরীরে হরমোনের পরিবর্তন বেশি ঘটে। বিশেষ করে প্রতি মাসে পিরিয়ডের আগে ও পরে শরীরে হরমোনের মাত্রা কম-বেশি হয়‌ে থাকে।‌

এছাড়াও জন্মনিরোধক পিল সেবন করা, গর্ভকালীন সময় এবং মেনোপজের ফলে শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে। তাই ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ব্রণ হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

ত্বকের যত্নে অবহেলা বা অজ্ঞতা 

ধুলাবালি, মেকআপ ও রোদের তাপ ত্বকের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এছাড়াও ত্বক পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে বেশি ঘষামাজা করা হলে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ সেবাসিয়াস গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত সেবাম দূর হয়ে যায় যা ত্বক ভালো রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অতিরিক্ত মেকআপ ব্যবহার করা যাবে না। ত্বক পরিষ্কার করার জন্য ভালো ফেসওয়াশ ব্যবহার করতে হবে যেন তা ত্বকের ক্ষতি না করে। এছাড়াও সূর্যরশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ত্বক রক্ষা করার জন্য ত্বকে সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে।‌  

অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

খাদ্যাভ্যাসের সাথে ব্রণ হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। বিশেষ করে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার, চিপস, কোমল পানীয়, ফাস্টফুড ইত্যাদি খাওয়ার অভ্যাস ব্রণ হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।  

ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার, ফলমূল, শাকসবজি, বাদাম, মাছ ও প্রোবায়োটিকস সমৃদ্ধ খাবার (ইয়োগার্ট ও টক দই) খাওয়ার অভ্যাস ব্রণ হওয়ার প্রবণতা অনেকাংশেই কমিয়ে দেয়।

অন্যান্য কারণ

  • ত্বকে অতিরিক্ত প্রদাহের ফলে এবং ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে ব্রণ হতে পারে। 
  • স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ব্রণ হতে পারে। 
  • পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবের সাথে ব্রণ হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। 

ব্রণ হওয়ার রিস্ক ফ্যাক্টর

acne risk factors

যেকোনো বয়স ও লিঙ্গের মানুষের ক্ষেত্রে ব্রণ হতে পারে। তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা বেশি রয়েছে। এছাড়াও ব্রণ হওয়ার অন্যান্য ঝুঁকির কারণ বা রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো হলোঃ (Burke, 2023) 

  • যাদের পরিবারের সদস্যদের ব্রণ হওয়ার প্রবণতা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ব্রণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।  
  • যাদের ধুমপানের অভ্যাস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ব্রণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে।  
  • যারা অতিরিক্ত মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। 
  • ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তি এবং যাদের শরীরের ওজন বেশি তাদের ক্ষেত্রে ব্রণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে। 
  • পিসিওএস (পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম) নামক রোগে আক্রান্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। 

পিসিওএস একটি হরমোন জনিত রোগ যা মেয়েদের হয়ে থাকে। এই রোগের অন্যান্য লক্ষণগুলো হলো নিয়মিত মাসিক না হওয়া‌, শরীরের বিভিন্ন স্থানে (মুখ, ঘাড়, বুক ও পিঠে) অবাঞ্ছিত লোম গজানো, শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। পিসিওএস এর লক্ষণ দেখা দিলে একজন গাইনী ডাক্তার অথবা হরমোন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।  

ব্রণের উপসর্গ গুলো কি কি?

ব্রণের উপসর্গ বা লক্ষণ হলো ত্বকের উপরিভাগে ছোট ফুস্কুড়ির মতো ফুলে উঠে, লাল হয়ে যায়, ব্যথা করে, পুঁজ বা সাদা আঠালো জাতীয় পদার্থ বের হয় ইত্যাদি। 

ব্রণ শুধুমাত্র মুখমণ্ডলেই (কপাল, গাল, নাক ও থুতনিতে) হবে এমন কোনো কথা নেই।‌ বরং মুখমণ্ডল ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে (ঘাড়, গলা, বুক ও পিঠে) ব্রণ হতে পারে। তবে মুখে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।  

বিভিন্ন ধরনের ব্রণ

ব্রণের বিভিন্ন ধরন বা প্রকরণ রয়েছে এবং প্রকরণভেদে লক্ষণের তারতম্য হয়ে থাকে। (Johns Hopkins Medicine) 

  • হোয়াইট হেডস (Whiteheads): সবচেয়ে কমন প্রকৃতির ব্রণ যার লক্ষণ হলো খুব ছোট আকারের, ব্যথাহীন ও সাদা বর্ণের হয়ে থাকে। 
  • ব্ল্যাক হেডস (Blackheads): এই ধরনের ব্রণ খুবই ছোট আকারের এবং কালো বর্ণের হয়ে থাকে। সাধারণত ব্যথা ও ফোলা থাকে না।  
  • Papules: সামান্য ফোলা থাকে, ব্যথা হয় এবং লাল হয়ে যায়। 
  • Pustules: প্রদাহ হয় এবং ব্রণের উপরিভাগে ত্বকের নিচে পুঁজ দেখা যায়। ব্রণের গোড়ায় লাল থাকে। 
  • Cysts: প্রচন্ড ব্যথা থাকে, গভীর প্রকৃতির হয় এবং পুঁজ জমা থাকে। এই ধরনের ব্রণ ত্বকে ক্ষত বা দাগ সৃষ্টি করার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 
  • Nodules: বেশ বড়, শক্ত, ত্বকের গভীর থেকে সৃষ্টি হয় এবং প্রচন্ড ব্যথা থাকে। 

সাধারণত হোয়াইট হেডস, ব্ল্যাক হেডস ও Papules এর জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, এমনিতেই ঠিক হয়ে যায়। তবে Pustules, Cysts ও Nodules এর জন্য যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।

ব্রণের জন্য চিকিৎসা 

acne treatment

ব্রণের চিকিৎসার জন্য ডার্মাটোলজিস্ট বা চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। এছাড়াও প্রয়োজন সাপেক্ষে একজন হরমোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা লাগতে পারে। কারণ ব্রণের সমস্যার সাথে শরীরে হরমোনের যোগসূত্র রয়েছে। 

ব্রণের কারণ নির্ণয় করে সেই মোতাবেক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ নির্ণয়ের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা লাগতে পারে।

কারণ ও ব্রণের প্রকৃতি অনুযায়ী চিকিৎসক যেসব চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রদান করে থাকেন তা হলোঃ  

  • বাহ্যিকভাবে ত্বকে ক্রিম ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। 
  • ব্যাকটেরিয়া জনিত সমস্যা দূর করার জন্য এন্টি-বায়োটিক সেবনের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। 
  • প্রয়োজনে স্টেরয়েড জাতীয় ক্রিম ব্যবহার, মুখে ওষুধ সেবন করা বা ইনজেকশন লাগতে পারে। 
  • আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে লেজার চিকিৎসা রয়েছে যার মাধ্যমে ব্রণের দাগ সহ দূর করা সম্ভব হয়। তবে এই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি বেশ ব্যয়বহুল হয়ে থাকে।  
  • যদি ব্রণ হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ পিসিওএস‌ বা অন্য কোনো রোগ হয়,‌ তবে সেক্ষেত্রে সেই রোগের চিকিৎসা করতে হবে। রোগ সেরে গেলে ব্রণ ভালো হয়ে যাবে।  
  • খাদ্যাভ্যাস এবং ত্বকের যত্নের ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। 

শেষ কথা 

ব্রণ একটি কমন সমস্যা‌ যার জন্য চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্রণ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। তবে সহজে ভালো না হলে সেক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। 

নিয়মিত ত্বকের সঠিক যত্ন নেওয়া, ভালো ঘুম নিশ্চিত করা, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা, স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, ধুমপান বর্জন ইত্যাদির মাধ্যমে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা কমানো সম্ভব।  

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের উপায় জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।‌ 

Bibliography

Burke, D. (2023, 26 June). Everything You Want to Know About Acne. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/skin/acne

Johns Hopkins Medicine. (n.d.). Acne. Retrieved from Johns Hopkins Medicine: https://www.hopkinsmedicine.org/health/conditions-and-diseases/acne

Last Updated on January 7, 2024