দেশি-বিদেশী নামীদামী কোম্পানির স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টে অনেক টাকা খরচ করলেও, ত্বকের নেই কোন হেরফের। কখনো তো আবার ত্বকের অবস্থার উন্নতির বদলে উল্টো ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এমন হলে অনেকে ভাবেন প্রোডাক্ট ভালো না, কিংবা নকল। অথচ ব্যাপারটা কিন্তু এমনও হতে পারে যে, প্রোডাক্টটি খুবই ভালো, কিন্তু সেটা আপনার ত্বকের জন্য মোটেও ভালো নয়!

বলছি ত্বকের ধরণের কথা। তৈলাক্ত, শুষ্ক, মিশ্র, সেনসিটিভ- একেক জন মানুষের ত্বকের ধরন কিন্তু একেক রকম। এমনকি একই মানুষের একেক বয়সেও দেখা দিতে পারে ত্বকের ভিন্নতা। এক ধরণের ত্বকের জন্য উপযোগী উপাদানযুক্ত প্রোডাক্ট আরেক ধরণের ত্বকে কাজ না করাটাই স্বাভাবিক। অথচ ত্বকের ভিন্নতার এই ব্যাপারটাই বেশিরভাগ মানুষ বুঝতে পারে না। 

ত্বকের এই নানান ধরণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন সেনসিটিভ ত্বকের অধিকারীরা। একটু উনিশ-বিশ হলেই সবচেয়ে বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা যায় এধরণের ত্বকেই। তাই তো, আলোচনা আজকে সেনসিটিভ ত্বকের আদ্যোপান্ত নিয়েই। 

স্কিন ডিজিজ নাকি স্কিন সেনসিটিভিটি?

অন্যান্য ত্বকের তুলনায় সেনসিটিভ ত্বকে যে কোন কিছুর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব দ্রুত হয়। যেমন অল্প গরমেই ত্বক লাল হয়ে যাওয়া, র‍্যাশ, জ্বালাপোড়া হওয়া, খুব ঘনঘন ব্রন, একনি বেড়িয়ে আসা ইত্যাদি। এমনকি রোদে সানবার্ন বা ত্বক পুড়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়াও সেনসিটিভ ত্বকে বেশি বেশি হয়। এইসব সমস্যার কারনে অনেকেই সেনসিটিভ ত্বককে কোন স্কিন ডিজিজ বা ত্বকের অসুস্থতার সাথে মিলিয়ে ফেলেন। এধরণের কষ্টকর প্রতিক্রিয়া ত্বকে খুব বেশি দেখা গেলে, ভালো কোন চর্মরোগের ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিশ্চিত হয়ে নেয়া উচিত যে, আসলেই ত্বকে কোন অসুখ আছে কি না। নাকি এগুলো শুধুই সেনসিটিভ ত্বকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। 

আপনার সেনসিটিভ স্কিন হলে কীভাবে বুঝবেন?

ঘরে বসেই যদি ধারণা নিতে চান আপনার ত্বকের ধরন, সেটারও আছে কিছু উপায়। না কোন ঘরোয়া টোটকা নয়, সেনসিটিভ ত্বক কি না বুঝতে হলে আপনার ত্বকের কিছু ব্যাপারের দিকে নজর দিতে হবে। 

১. ত্বক রিয়েক্টিভ বা প্রতিক্রিয়াশীল কি না

খেয়াল করে দেখুন, বিশেষ কিছু জিনিসের সংস্পর্শে আপনার ত্বক প্রতিক্রিয়া দেখায় কি না। যেমন, বিশেষ কোন উপাদান, সাবান, ডিটারজেন্ট, পারফিউম, ঘরে ব্যবহার্য কিংবা স্কিনকেয়ারের কোন পণ্য। এরকম বিশেষ কোন কিছুর সংস্পর্শে যদি আপনার ত্বকে র‍্যাশ, জ্বালাপোড়া, চুলকানির মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তবে হতে পারে আপনার ত্বক সেনসিটিভ। 

২. ত্বকে লালচে ভাব

সেনসিটিভ ত্বকের অধিকারী মানুষদের ত্বকে ঘনঘন লালচে ভাবের মুখোমুখি হতেই হয়। হতে পারে সেটা লালচে র‍্যাশ, লালচে ব্রন, লালচে বাম্প। অনেক ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট উপাদান ত্বকের সংস্পর্শ থেকে সরিয়ে ফেললে সেইসব লালচে র‍্যাশ বা দাগ চলে যায়। 

৩. ত্বকে অতিরিক্ত শুষ্ক ভাব

ত্বকের শুস্কতা সেনসিটিভ ত্বকের একটি বড় লক্ষণ। ত্বক ফেটে থাকা, বেশি বেশি ব্রন, একনি হওয়া এগুলোও ত্বকের অতিরিক্ত শুস্কতা থেকে হতে পারে। এই জন্য সেনসিটিভ ত্বকের মানুষেরা ঠাণ্ডা আবহাওয়া, ঠাণ্ডা বাতাসযুক্ত খোলা যায়গায় গেলেই ত্বক আরো শুষ্ক হয়ে নানান সমস্যা দেখা দেয়। শুষ্কতার কারনে ত্বক মলিন, অমসৃণ ও ফ্লেকি দেখায়। শুষ্ক ত্বকে অতিরিক্ত মৃত চামড়া হয় বলে, এধরণের ত্বকে চুলকানিও বেশি হয়।  

৪. ত্বকে ঘন ঘন র‍্যাশ বা এলার্জি জাতীয় সমস্যা

সেনসিটিভ ত্বকে সব ধরণের উপাদান সহ্য হয় না। ত্বকের সাথে মানানসই না এমন কোন উপাদানের সংস্পর্শে আসার সাথে সাথেই সেনসিটিভ ত্বকে র‍্যাশ, চুলকানি, জ্বালাপোড়া বা এলার্জির মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যা খুবই অস্বস্তিকর। কারো কারো ক্ষেত্রে আবার ত্বক এতোই পাতলা হয়ে যায় যে, ত্বকের উপর দিয়ে শরীরের শিরাও দেখা যায়।

৫. অতিরিক্ত একনির আক্রমণ

অনেকে ভাবেন শুধুমাত্র তৈলাক্ত ত্বকেই একনি ও ব্রন বেশি হয়। যা সত্য নয়। সেনসিটিভ ত্বকও ভয়ংকর একনি ও ব্রনের হামলার আশঙ্কায় থাকে। শুধু তাই নয়, সব ধরণের একনি, ব্রন বিরোধী প্রোডাক্ট বা ফেসওয়াশেও এগুলো দূর হতে চায় না। উল্টো সেনসিটিভ ত্বকে উপযুক্ত নয় কোন উপাদান থাকলে সেগুলো ব্যবহারে ত্বকের অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে। 

৬. অল্পতেই ত্বকে সানবার্ন 

অন্যান্য ত্বকের তুলনায় সেনসিটিভ ত্বকের অধিকারীরা রোদ ও গরমে একটু বেশিই সংবেদনশীল। সেনসিটিভ ত্বকের মানুষেরা একটু গরম বা রোদে বের হলেই দেখা যায় ত্বক পুড়ে লালচে হয়ে যায়, র‍্যাশ হয়ে যায়, এমনকি গরম আবহাওয়া বা রোদের সংস্পর্শে আসার অল্প সময়ের মধ্যেই শুরু হতে পারে চুলকানি, জ্বালাপোড়া।  

করণীয় কী?

ত্বকের ধরন তো আর রাতারাতি বদলে ফেলা সম্ভব না। তবে কিছু ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে সেনসিটিভ ত্বক থেকে হওয়া যন্ত্রনা ও ভোগান্তি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। জেনে নেই সেনসিটিভ ত্বকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দূর করতে করনীয় কী। 

  • ডিওডোরেন্ট (Deodorant) বা দুর্গন্ধনাশক যে কোন কিছু ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • কৃত্রিম সুগন্ধিযুক্ত সাবান, ফেইসওয়াশ, ক্রিম ইত্যাদি ত্বকে ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • উচ্চ মাত্রায় ক্ষার আছে এমন সাবান বা ক্লিনজার ত্বকে ব্যবহার করা যাবে না। 
  • মুখ পরিস্কারের জন্য সাবান বাদ দিয়ে লিকুইড ক্লিনজার ব্যবহার করতে হবে, যা মৃদু। 
  • খুব গরম বা খুব ঠান্ডা পানি ত্বকে লাগানো যাবে না। 
  • ত্বকে পারফিউম বা পারফিউম যুক্ত কিছুর সংস্পর্শে আনা বাদ দিতে হবে।
  • ত্বকের শুস্কতা রোধ করার জন্য ভালো মানের ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে, প্রতিবার মুখ ও ত্বক পরিস্কারের পর। 
  • কোন প্রোডাক্ট ত্বকে ব্যবহারের পর র‍্যাশ, চুলকানি, জ্বালাপোড়া দেখা দিলে দ্রুত সেটা ত্বক থেকে ধুয়ে ফেলতে হবে এবং পরবর্তীতে সেটা আর ব্যবহার না করাই ভালো। 
  • নতুন কোন কিছু ত্বকে ব্যবহারের আগে অবশ্যই প্যাচ টেস্ট করতে হবে। 
  • ত্বক অতিরিক্ত স্ক্রাবিং, ঘষাঘষি বা এক্সফোলিয়েট করা যাবে না। 
  • বাইরে বের হওয়ার আগে অবশ্যই অন্তত ৩০+ এসপিএফ (SPF) যুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। 

ত্বকে ব্যবহারের জন্য ময়েশ্চারাইজার, ক্লিনজার বা অন্য যে কোন কিছু কেনার আগে সেই প্রোডাক্টের গায়ে থাকা ইনগ্রিডিয়েন্টস বা উপাদানের লিস্ট ভালো করে দেখে নিতে হবে। সেই সব উপাদান সেনসিটিভ ত্বকের জন্য উপযুক্ত হলেই কেবল সেই প্রোডাক্ট ত্বকে ব্যবহার করতে হবে।

শীত এবং গ্রীষ্মে সেনসিটিভ ত্বক রক্ষা করার কিছু টিপস

ঋতু ও আবহাওয়ার ভিন্নতায় সেনসিটিভ ত্বকের যত্নতেও আনতে হয় পরিবর্তন। নয়তো এধরণের ত্বকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভোগান্তি বাড়তে পারে আরো। 

শীতকালে সেনসিটিভ ত্বকের যত্ন

  • শীতকালে রোদের তাপ অতটা বোধ না করলেও, সানস্ক্রিনের ব্যবহার ছাড়া যাবে না মোটেও।
  • শীতের আবহাওয়ায় সেনসিটিভ ত্বক আরও বেশি শুষ্ক হয়ে ফেটে যেতে পারে। তাই সেনসিটিভ ত্বকের জন্য উপযোগী ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে ঘন ঘন। 
  • সেনসিটিভ ত্বককে ভেতর থেকে আর্দ্র রাখতে ময়েশ্চারাইজার থেকেও ভালো কাজ করতে পারে সেরাম। তাই স্কিনকেয়ারে ভালো মানের সিরাম যোগ করা যেতে পারে। 
  • শীতে ঠোট ফাটার সমস্যা সেনসিটিভ ত্বকের জন্য হতে পারে বেশি মারাত্মক। তাই ঘন ঘন লিপ বাম ব্যবহার করতে হবে। 
  • খুব বেশি গরম পানি ত্বকে ব্যবহার করা যাবে না। 

ঠোঁটের ত্বকে কোন তেলের গ্রন্থি থাকে না। যা ঠোটের শুষ্কতার কারণ।

  • এক্সফোলিয়েশন ত্বককে আরো শুষ্ক করে দেয়, যা শীতকালে সেনসিটিভ ত্বকের জন্য মোটেও কাম্য নয়। কিন্তু ময়েশ্চারাইজারকে ত্বকের গভীরে যেতে হলে, ত্বকে জমা মৃত কোষও পরিষ্কার করা জরুরী। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক মৃদু এক্সফোলিয়েটর যেমন, পেপে, আনারস, দুধ ইত্যাদি দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করা যেতে পারে। যা ত্বককে শুষ্ক করবে না। 

গরমকালে সেনসিটিভ ত্বকের যত্ন

  • গরমকালে অনেকেই একাধিকবার গোসল করেন। গোসল বার বার হলেও সেটা যেন অল্প সময়ের জন্য হয়। কারণ ত্বক যত বেশি সময় ভেজা থাকবে, তত বেশি শুষ্ক ও রুক্ষ হবে। যা সেনসিটিভ ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। 
  • খুব বেশি ঠাণ্ডা পানি ত্বকে ব্যবহার করা যাবে না।
  • গরম আবহাওয়াতে ত্বকে যত কম প্রোডাক্ট ব্যবহার করা যায় ততই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশংকা কমে। তবে সেনসিটিভ ত্বকের উপযোগী ক্লিনজার, ময়েশ্চারাইজার ও সানস্ক্রিন ব্যবহার করতেই হবে। 
  • যেহেতু সেনসিটিভ ত্বক রোদে খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাই বাইরে গেলে ত্বক যেন সরাসরি রোদ বা অতিবেগুনী রশ্মিতে উন্মুক্ত না থাকে। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে বড় ওড়না, হ্যাট বা টুপি। 
  • ঘামের সাথে শরীর ও ত্বক প্রচুর পানি হারায়। তাই ত্বকের কোষের ভেতর থেকে আর্দ্র রাখার জন্য পান করতে হবে প্রচুর পানি। 

সেনসিটিভ ত্বকের যত্ন নেয়া এবং ত্বকে ব্যবহারের জিনিসপত্র কেনা মোটেও সহজ নয়। এমনকি সাজগোজের ক্ষেত্রেও থাকতে হয় খুব সতর্ক। কোন মেকআপ ত্বকে মানানসই না হলে, সেজেগুজে বাইরে গিয়েও পড়তে হতে পারে মহা বিব্রতকর অবস্থায়। 

References

Jaliman D. (2022, November 16) 20 Common Questions About Sensitive Skin, Retrieved from Webmd: https://www.webmd.com/beauty/sensitive-skin-20-questions  

Kunin A. (2022, January) How to Treat Your Sensitive Winter Skin, Retrieved from Dermadoctor: https://www.dermadoctor.com/blog/how-to-treat-your-sensitive-winter-skin/ 

General. (2020, Jun 11) 8 Summer Skincare Tips For Sensitive Skin, Retrieved from Infinity Laser Spa: https://infinitylaserspa.com/blogs/blog/8-summer-skincare-tips-for-sensitive-skin

Last Updated on October 31, 2023