বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, দিনে (২৪ ঘন্টায়) ৩ বার বা তার বেশি সময় পাতলা পায়খানা হলে তাকে ডায়রিয়া (Diarrhea) বলা হয়। ডায়রিয়া খুব কমন একটি রোগ বিশেষ করে গ্রীষ্মকালীন সময়ে আমাদের দেশে অনেক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন। তবে এটি তেমন কোনো জটিল রোগ নয় এবং সাধারণত মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় না। আর তাই ডায়রিয়ার জন্য ডাক্তারের কাছে না গিয়ে বরং রোগীকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। তবে এর জন্য রোগীর খাবার বা পথ্য, প্রাথমিক চিকিৎসা, কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরী।
আজকের অনুচ্ছেদের মূল বিষয় হলো ডায়রিয়া রোগীকে কি ধরনের খাবার দিতে হবে এবং কোন খাবার গুলো বর্জন করা উচিত। সেই সাথে ডায়রিয়া কেন হয়, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ডায়রিয়া প্রতিরোধে করণীয় বিষয়াবলী সম্পর্কে জানতে অনুচ্ছেদটি পড়তে থাকুন।
Table of Contents
ডায়রিয়ার কারণ
সাধারণত পরিপাকতন্ত্রে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবীর (Parasite) সংক্রমণের ফলে ডায়রিয়া হয়ে থাকে এবং এই ধরনের ডায়রিয়া সংক্রামক (Contagious) প্রকৃতির হয় অর্থাৎ একজন অসুস্থ ব্যক্তি থেকে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
দূষিত পানি পান করা, খাবারে মাছি বসা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনীহা, ফলমূল ও শাকসবজি ভালোভাবে ধুয়ে না খাওয়া, কম সিদ্ধ মাছ ও মাংস খাওয়া ইত্যাদির ফলে ডায়রিয়ার সংক্রমণ হয়ে থাকে।
আরেক ধরনের ডায়রিয়া রয়েছে যা অসংক্রামক (non-contiguous) প্রকৃতির অর্থাৎ অসুস্থ ব্যক্তি থেকে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে না। এই ধরনের ডায়রিয়া কোনো রোগ বা ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে হয়ে থাকে। যেমনঃ
- ডাইভার্টিকুলাইটিস
- পায়ুপথ বা অন্ত্রের ক্যানসার
- আইবিএস (IBS- irritable bowel syndrome)
- আলসারেটিভ কোলাইটিস
- অ্যান্টাসিড, এন্টি বায়োটিক ও জোলাপের ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
ডায়রিয়ার লক্ষণ
ডায়রিয়া হলে ঘন ঘন পাতলা সহ আরো যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ
- পেট ব্যথা
- জ্বর ও শীত বোধ
- দুর্বলতা ও ক্লান্তি
- শরীরে ব্যথা অনুভূত হওয়া
ডায়রিয়ার মতো কলেরার (Cholera) ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম লক্ষণ গেলেও এই দুইটি সম্পূর্ণ আলাদা রোগ। তবে ডায়রিয়া হোক অথবা কলেরা, দুই ক্ষেত্রেই প্রাথমিক পর্যায়ে একই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ডায়রিয়া হলে যেসব খাবার খেতে হবে
খাবার স্যালাইন
ডায়রিয়ার রোগীর প্রথম ও প্রধান খাবার হলো খাবার স্যালাইন যাকে ডায়রিয়ার ঔষধ বলা যেতে পারে। পাতলা পায়খানার সাথে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বের হয়ে যায় এবং সেই সাথে ইলেকট্রোলাইটের (Electrolytes) ভারসাম্য নষ্ট হয়। খাবার স্যালাইন খাওয়ার মাধ্যমে শরীরে পানি স্বল্পতা ও ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা দূর হয়ে যাবে।
বাজারে খাবার স্যালাইন কিনতে পাওয়া যায় যা প্যাকেটের গায়ে থাকা নির্দেশনা অনুযায়ী পানিতে গুলিয়ে ঘন ঘন খেতে হবে। নির্দেশিত পরিমাণের চেয়ে কম পানিতে স্যালাইন গুলিয়ে খাওয়া যাবে না।
কচি ডাবের পানি
স্যালাইনের পরিবর্তে কচি ডাবের পানি পান করা যেতে পারে। এতে শরীরে পানি স্বল্পতা দূর হওয়ার পাশাপাশি ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষা হবে। কারণ, ডাবের পানিতে বিভিন্ন মিনারেলস (পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি) রয়েছে। এছাড়াও ডাবের পানিতে সামান্য পরিমাণে শর্করা রয়েছে যা শরীরে ক্যালরি সরবরাহ করবে।
প্রতিবার পাতলা পায়খানা হওয়ার পরে শরীরে পানি স্বল্পতা দূর করার জন্য অন্তত ১ কাপ পরিমাণ খাবার স্যালাইন অথবা ডাবের পানি পান করতে হবে। স্যালাইন ও পানি স্বাভাবিক খাবার খাওয়ার সময় পান না করে বরং খাবার গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়গুলোতে ঘন ঘন পান করা উত্তম।
BRAT diet
এক্ষেত্রে BRAT দ্বারা B- Banana (কলা), R- Rice (ভাত), A- Apple (আপেল), T- Toast (টোস্ট) ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে।
ডায়রিয়ার রোগীদের জন্য সরল খাবার গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয় অর্থাৎ যে খাবার গুলো শরীরে সহজে হজম ও শোষণ হতে পারে। যেমনঃ কলা, আপেল, সাদা ভাত, টোস্ট ইত্যাদি খাবার খাওয়া যা ডায়রিয়া রোগীদের পাতলা পায়খানা দূর করা সহ শরীরে দ্রুত শক্তি যোগাবে। (Johnson, 2022)
ভাতের মাড় ও স্যুপ (Soup)
সহজপাচ্য তরল খাবার হিসেবে সামান্য লবণ মিশিয়ে ভাতের মাড় অথবা স্যুপ তৈরি করে খাওয়া যেতে পারে। পাতলা পায়খানা কমে গেলে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক খাবার খাওয়া শুরু করতে হবে।
আলু
সিদ্ধ আলু খোসা ছাড়িয়ে খাওয়া উপকারী হবে। তবে একবারে অনেক বেশি পরিমাণে খাওয়া যাবে না।
দ্রবণীয় ফাইবার (Soluble fiber)
দ্রবণীয় ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। যেমনঃ ডাল, শাকসবজি, ওটস, বার্লি, মটরশুঁটি, শিম ইত্যাদি।
শিশুদের খাবার
শিশুদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই দিনে ২ বা ৩ বার পায়খানা হয়ে থাকে এবং শিশুদের মল ততটা শক্ত হয় না বরং তরল প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাহলে শিশুদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া বোঝার উপায় কি? শিশুদের ক্ষেত্রে একদম পানির মতো পাতলা পায়খানা দিনের মধ্যে ৫/৬ বার বা তার বেশি সময় হলে তাকে ডায়রিয়া বলা হয়।
শিশুদের ডায়রিয়া হলে ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এছাড়াও বুকের দুধের পাশাপাশি খাবার স্যালাইন খাওয়ানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। তবে খাওয়ার প্রতি অনিহা, জ্বর, শিশু একদম নেতিয়ে পড়া, বমি হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে শিশু রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।
ডায়রিয়া হলে যেসব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে
ডায়রিয়া হলে যেসব খাবার বর্জন করতে হবে তা হলোঃ (NDTV, 2018)
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এতে ল্যাকটোজ রয়েছে যা অন্ত্রে প্রদাহ বাড়িয়ে দেয় এবং ডায়রিয়ার লক্ষণ আরো খারাপ করে দিতে পারে। বিশেষ করে আইবিএস রোগীদের ক্ষেত্রে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার সব সময়ের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে। তবে সোয়া মিল্ক (Soya milk) ও ইয়োগার্ট (Yogurt) খাওয়া যেতে পারে। কারণ এতে অন্ত্রের ভেতর থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার
চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার এমনিতেই শরীরের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তার উপরে আবার ডায়রিয়া হলে তো কথাই নেই। ডায়রিয়া হলে চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার গুলো অবশ্যই বর্জন করতে হবে। কারণ এগুলো পেট ব্যথা, পেটে গ্যাস জমা, পাতলা পায়খানা বাড়িয়ে দিতে পারে।
চর্বিযুক্ত খাবার
ডায়রিয়া হলে ফাস্টফুড, অতিরিক্ত তেল, চর্বি ও মশলাযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। কারণ এই জাতীয় খাবার গুলো পেটের সমস্যা আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।
ফলের জুস
ডায়রিয়া হলে শরীরে পানি স্বল্পতা দূর করার জন্য তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে ফলের জুস ও শরবত খাওয়া যাবে না। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে যা ডায়রিয়ার লক্ষণ আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে রাস্তাঘাটে অথবা বাজারে শরবত ও ফলের জুস কিনে খাওয়া থেকে সবসময় বিরত থাকতে হবে। কারণ জুস বানানোর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার হয়েছে কিনা সেই ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যায়।
কিছু কিছু সবজি
ডায়রিয়া হলে কিছু কিছু সবজি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হয়। যেমনঃ ব্রকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, কাঁচা পেঁয়াজ ইত্যাদি। এই খাবার গুলো পেটে গ্যাস জমা এবং ডায়রিয়ার লক্ষণ বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এছাড়াও মিষ্টি ফল, আঙ্গুর, মধু, খেজুর, বাদাম ইত্যাদি খাওয়া যাবে না।
চা ও কফি
ডায়রিয়া হলে চা ও কফি পান করা যাবে না। কারণ, এতে অন্ত্রে পানি ও পুষ্টি শোষণে ব্যঘাত ঘটে এবং সেই সাথে ডায়রিয়ার লক্ষণ বেড়ে যেতে পারে।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন
পর্যাপ্ত পরিমাণে স্যালাইন ও তরল খাবার খাওয়া, পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকা এবং খাবার গ্রহণের ব্যাপারে সব নির্দেশনা মেনে চলা সত্ত্বেও ডায়রিয়া নিরাময় না হলে অথবা নিচে উল্লেখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে সেক্ষেত্রে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। (MacGill, 2023)
- অবিরাম পাতলা পায়খানা হওয়া
- মলের সাথে রক্ত বা পুঁজ যাওয়া
- বার বার বমি হওয়া (Vomiting)
- শরীরে পানির পরিমাণ একদম কমে যাওয়া তথা পানিশূন্যতা
- দূর্বলতা ও শরীর একদম নেতিয়ে পড়া ইত্যাদি
চিকিৎসা ও প্রতিকার
ডায়রিয়ার জন্য রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সর্বপ্রথম শিরায় স্যালাইন দেওয়া হয় যা দ্রুততম সময়ের মধ্যে শরীরে পানি স্বল্পতা ও ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা দূর করে। এর পাশাপাশি এন্টি-ডায়রিয়াল (Antidiarrheal) ঔষধ দেওয়া হয়।
অতঃপর প্রয়োজনীয় টেস্ট (রক্ত ও মল পরীক্ষা) করার মাধ্যমে ডায়রিয়ার কারণ পরজীবী, ভাইরাস নাকি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ জনিত তা নির্ণয় করা হয়। ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবী ঘটিত ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে এন্টি-বায়োটিক ঔষধ সেবনের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। তবে ভাইরাস জনিত ডায়রিয়ার জন্য এন্টি-বায়োটিক কার্যকর হবে না।
ডায়রিয়া প্রতিরোধ
কয়েকটি নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমনঃ
- সবসময় খাবার ঢেকে রাখতে হবে যেন খাবারে মাছি বসতে না পারে
- টয়লেট ব্যবহারের পর এবং খাবার খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুতে হবে
- বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে
- ফলমূল না ধুয়ে খাওয়া যাবে না
- মাছ ও মাংস ভালোভাবে সিদ্ধ করতে হবে।
References
Johnson, J. (2022, December 15). What foods to eat if you have diarrhea. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/320124#foods-to-eat
MacGill, M. (2023, January 10). What you should know about diarrhea. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/158634#seeing-a-doctor
NDTV. ( 2018, August 24). Foods For Diarrhoea: 9 Foods To Avoid When You Have Loose Motions. Retrieved from NDTV FOOD: https://food.ndtv.com/health/9-foods-to-avoid-if-you-have-loose-motions-1734432
Last Updated on April 9, 2023
Leave A Comment