কারপাল টানেল সিন্ড্রোম (Carpal tunnel syndrome) হলো হাতের কব্জির প্রদাহ জনিত একটি রোগ যা বর্তমানে অনেক মানুষের ক্ষেত্রে হতে দেখা যায়। যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগ হতে পারে তবে পুরুষদের তুলনায় নারীদের ক্ষেত্রে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।  

এই অনুচ্ছেদে কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের কারণ, লক্ষণ, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

এছাড়াও মহিলাদের ক্ষেত্রে কেন এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে সেই বিষয়ে জানতে মনোযোগ সহকারে পড়তে থাকুন।  

কারপাল টানেল সিন্ড্রোম (Carpal tunnel syndrome) কি?  

মানুষের প্রত্যেক হাতের কব্জিতে ছোট ছোট ৮ টি হাড় থাকে যাদেরকে কারপাল বোন বলা হয়। কারপাল বোনের পাশ দিয়ে ছোট টানেল বা সুরঙ্গ পথ রয়েছে যার ভেতর দিয়ে মেডিয়ান নার্ভ (Median nerve) নামক একটি নার্ভ হাতের আঙ্গুল পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। এই নার্ভ ছোট আঙ্গুল (Little finger) বাদে বাকি ৪ টি আঙ্গুলে ছড়িয়ে রয়েছে। 

কোনো কারণ বশত এই টানেলে অতিরিক্ত চাপ পড়লে তথা মেডিয়ান নার্ভে চাপ পড়ে প্রদাহের সৃষ্টি হলে তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় কারপাল টানেল সিন্ড্রোম বলা হয়। এই রোগ যেকোনো এক হাত অথবা দুই হাতের কব্জিতেই হতে পারে। 

কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের কারণ  

কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের কারণগুলো হলোঃ (Morrison, 2019) 

কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের ঝুঁকির কারণ 

কারপাল টানেল সিন্ড্রোম যাদের ক্ষেত্রে হওয়ার অনেক বেশি ঝুঁকি রয়েছে তা হলোঃ 

  • যারা দীর্ঘসময় মাউস ও কিবোর্ড দিয়ে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে হাতের কব্জিতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে বা আঘাত লাগে যা কারপাল টানেল সিন্ড্রোম হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। 
  • ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকি রয়েছে। কারণ এই বয়সে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। 
  • যারা ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে Anastrozole ওষুধ সেবন করেন তাদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি ঝুঁকি রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই ওষুধ সেবনের সাথে কারপাল টানেল সিন্ড্রোম হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। 
  • এছাড়াও লাইফস্টাইলের সাথে এই রোগের যোগসূত্র রয়েছে। যেমনঃ ধুমপানের অভ্যাস, অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, অলস জীবন যাপন করা, শরীরের অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদি। 

পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ক্ষেত্রে কারপাল টানেল সিন্ড্রোম হওয়ার ৩ গুণ বেশি ঝুঁকি রয়েছে। এর কারণ হলো মহিলাদের কারপাল টানেল তুলনামূলক সরু (Narrow) প্রকৃতির হয়ে থাকে।

কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের লক্ষণ 

কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ 

  • ইলেকট্রনিক শকের মতো ব্যথা কব্জি থেকে প্রথম চারটি আঙ্গুলে ছড়িয়ে পড়ে। 
  • হাত ঝিনঝিন বা অবশ মনে হয়। 
  • হাতের দুর্বলতা দেখা যায় অর্থাৎ হাত দিয়ে কিছু ধরে রাখা যায় না।  
  • ব্যথা ও প্রদাহ রাতে বেশি হয়।  

কারপাল টানেলের লক্ষণগুলো প্রথমদিকে মৃদু প্রকৃতির হয়ে থাকে। তবে পরবর্তীতে তীব্র আকার ধারণ করে।

কখন ডাক্তার দেখাতে হবে?  

কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের লক্ষণ অবহেলা না করে বরং যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। অন্যথায় দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার জটিলতা হিসেবে কব্জির নার্ভ ও পেশী ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে। 

কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের চিকিৎসার জন্য সর্বপ্রথম একজন অর্থোপেডিক ডাক্তার দেখাতে হবে। পরবর্তীতে ফিজিওথেরাপি নেওয়ার প্রয়োজন হলে ফিজিওথেরাপিস্ট এর শরণাপন্ন হতে হবে।  

কারপাল টানেল সিন্ড্রোম কিভাবে নির্ণয় করা হয়? 

কারপাল টানেল সিন্ড্রোম কিভাবে নির্ণয় করা হয়?

 

কারপাল টানেল সিন্ড্রোম চিকিৎসার প্রথম ধাপ হলো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগের কারণ ও তীব্রতা সম্পর্কে জানা। এর জন্য চিকিৎসক রোগীর রোগ লক্ষণের বর্ণনা শোনা, শারীরিক পর্যবেক্ষণ করা এবং যেসব টেস্ট করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন তা হলোঃ 

  • কব্জির এক্সরে 
  • আল্ট্রাসনোগ্রাফি 
  • Nerve conduction studies 

চিকিৎসা  

প্রাথমিক পর্যায়ে কারপাল‌ টানেল সিন্ড্রোম নিরাময়ের জন্য হাতের বিশ্রাম, ব্যথা নাশক ওষুধ সেবন, ঠান্ডা বা গরম সেঁক দেওয়া, কব্জির সাপোর্ট বা স্প্লিন্ট (Wrist splint) ব্যবহার করা, ফিজিওথেরাপি ইত্যাদি বেশ উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। (Mayo Clinic, 2022) 

বিশ্রাম 

সম্ভব হলে অন্তত ২ সপ্তাহ পর্যন্ত হাতের কব্জিতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে কাজ করলেও কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘন ঘন অল্প সময়ের জন্য হাতের বিশ্রাম নিতে হবে। 

কাজের সময় হাতের কব্জি যেন স্বাভাবিক পজিশনে থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দীর্ঘসময় পর্যন্ত হাত দিয়ে ভারী বস্তু ধরে রাখা যাবে না। 

ঠান্ডা বা গরম সেঁক দেওয়া 

শরীরের যেকোনো অংশের ব্যথা নিরাময়ের প্রাকৃতিক, সহজ ও কার্যকরী একটি পদ্ধতি হলো ঠান্ডা বা গরম সেঁক দেওয়া। আপনার ক্ষেত্রে ঠান্ডা নাকি গরম সেঁক কোনটিতে ব্যথা কমে তা পরীক্ষা করে পরবর্তীতে ব্যথা কমানোর জন্য নিয়মিত সেঁক দিতে পারেন। 

ঠান্ডা সেঁক দেওয়ার জন্য একটি কাপড়ে বরফের টুকরো পেঁচিয়ে ব্যবহার করুন। আর গরম সেঁক দেওয়ার জন্য কাপড় গরম করে আক্রান্ত স্থানে সেঁক দিতে হবে।  

ব্যথা নাশক ওষুধ 

কারপাল টানেল সিন্ড্রোম জনিত কব্জির ব্যথা দূর করার জন্য মৃদু প্রকৃতির ব্যথা নাশক ঔষধ (Ibuprofen) সেবন করা যেতে পারে যা বাজারে নিম্নলিখিত নামে কিনতে পাওয়া যায়। 

  • Advel® 
  • Alflam® 
  • Arafa® 
  • Brofen®
  • Beflam®
  • Deprofen® 
  • Intaflam® 
  • Indoflam® 
  • Profen® 
  • Neurofen® 
  • Reumafen®
  • Uniflam® 

আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen) ওষুধটি ওটিসি (OTC- over the counter) মেডিসিনের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ এটি সেবন করার জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনার প্রয়োজন পড়ে না। 

ব্যথা নিরাময়ের জন্য আইবুপ্রোফেন ৪০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট দিনে বার ভরাপেটে সেবন করতে হবে। 

গর্ভবতী মহিলাদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত আইবুপ্রোফেন সেবন করা যাবে না।

রিস্ট স্প্লিন্ট (Wrist splint) 

রিস্ট স্প্লিন্ট (Wrist splint) 

 

বাজারে রিস্ট স্প্লিন্ট কিনতে পাওয়া যায় যা ব্যবহার করার ফলে কব্জিতে আঘাত লাগা বা অতিরিক্ত চাপ প্রশমিত করে। কারপাল টানেল সিন্ড্রোম রোগীদের জন্য রিস্ট স্প্লিন্ট ব্যবহার করা বেশ উপকারী ভূমিকা রাখে। 

ফিজিওথেরাপি 

কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের ব্যথা ও যন্ত্রণা নিরাময়ের জন্য একজন ফিজিওথেরাপিস্ট এর শরণাপন্ন হয়ে ফিজিওথেরাপি নেওয়া উপকারী হতে পারে। 

স্টেরয়েড (Steroid) 

কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের ফলে কব্জিতে তীব্র ব্যথা হলে সেক্ষেত্রে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ বা ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের ওষুধ অবশ্যই একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে গ্রহণ করতে হবে। কেননা সঠিক নিয়ম মেনে ওষুধ গ্রহণ না করলে নানাবিধ সমস্যা বা জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। 

সার্জারি 

কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের জটিল প্রকৃতির জন্য সার্জারির প্রয়োজন পড়ে। সার্জারির মাধ্যমে মেডিয়ান নার্ভের উপর অতিরিক্ত চাপ দূর করা হয়। সার্জারির পূর্বে একজন অর্থোপেডিক ডাক্তারের সাথে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা নেওয়া উত্তম।  

প্রতিরোধের উপায় 

কারপাল টানেল সিন্ড্রোম প্রতিরোধ করার শতভাগ কার্যকরী কোনো পন্থা নেই। তবে হাতের কব্জিতে অতিরিক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। 

  • একটানা দীর্ঘসময় পর্যন্ত মাউস ও কিবোর্ড ব্যবহার করা যাবে না। মাঝে মধ্যে বিরতি নিতে হবে।
  • কব্জিতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে এমন কাজ যতটা সম্ভব কম করা ভালো। 
  • সামনে পেছনে ধীরে ধীরে কব্জি নাড়াচাড়া করার মাধ্যমে কব্জির ব্যায়াম করতে হবে যা কারপাল টানেল সিন্ড্রোম হওয়ার সম্ভাবনা কমায়। 
  • ক্যালসিয়ামভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে যা কারপাল টানেল সিন্ড্রোম প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মাছ, ডিম, দুধ, শাকসবজি, বাদাম, ফলমূল ইত্যাদি রাখতে হবে।  

 

References

Mayo Clinic. (2022, February 25). Carpal tunnel syndrome. Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/carpal-tunnel-syndrome/diagnosis-treatment/drc-20355608

Morrison, W. (2019, March 08). Carpal Tunnel Syndrome. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/carpal-tunnel-syndrome

 

 

 

Last Updated on May 22, 2023