নারিকেলের ইংরেজি প্রতিশব্দ Coconut অর্থাৎ শেষে জুড়ে দেওয়া হয়েছে Nut শব্দটি যার অর্থ হলো বাদাম। নারিকেলের মতো শক্ত খোলস বিশিষ্ট কাঠবাদাম ও আখরোট রয়েছে যা বাদামের অন্তর্ভুক্ত। তাহলে কি নারিকেল একধরনের বাদাম হিসেবে বিবেচিত হবে? উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা নারিকেলের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে এটিকে ফলের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন যে পরিচিত নারিকেল সম্পর্কে কত ধাঁধা বা অজানা তথ্য রয়েছে। হ্যা! আজকে আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেব নারিকেলের কিছু বৈশিষ্ট্য এবং পুষ্টিগুণের সাথে যা হয়তোবা অনেকের কাছেই অজানা। সবুজ ডাব এবং নারকেলের মধ্যে পার্থক্য সহ কোনটি বেশি স্বাস্থ্যকর কচি ডাব নাকি নারকেল সেই সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
কচি ডাব কি?
নারিকেল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Cocos nucifera যার অপরিপক্ক ফল হলো কচি ডাব। গাছে ফল ধরার ৬ মাসের মধ্যে কচি ডাব সংগ্রহ করা হয় যার মধ্যে পানি ছাড়া আর কিছু থাকে না।
৮ থেকে ১০ মাসের দিকে ডাবের বর্ণ সবুজ থেকে আস্তে আস্তে বাদামী হওয়া শুরু হয়। এই সময়ে ডাবের পানির মিষ্টি স্বাদ কিছুটা কমে যায় তবে ডাবের ভেতরে পানি ছাড়াও থকথকে জেলির মতো নরম শাঁস হয় যা খেতে খুব সুস্বাদু ও মজাদার।
নারকেল কি?
নারিকেল গাছের পাকা ফলকে নারিকেল বলে যা ফল ধরার ১১ থেকে ১২ মাস পর সংগ্রহ করা হয়। এই সময়ে নারিকেলের উপরিভাগ দেখতে বাদামী বা ধূসর বর্ণের হয় এবং নারিকেলের বাইরের আবরণ বা খোলস ডাবের তুলনায় বেশ শক্ত থাকে।
নারিকেলের ভেতরে পানির পরিমাণ কিছুটা কমে যায় তবে সাদা বর্ণ বিশিষ্ট অনেক শাঁস থাকে। এই শাঁস একটু শক্ত কিন্তু অনেক পুষ্টিগুণ ও ক্যালরি সম্পন্ন হয়ে থাকে বলে নারিকেল সবার কাছে বেশ পছন্দের একটি ফল।
কচি ডাব এবং নারকেল এর পুষ্টিগুণ কি কি?
কচি ডাব খাওয়ার উদ্দেশ্য থাকে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন পানি পান করা আর নারিকেল খাওয়া হয়ে থাকে শাঁসের জন্য। যদিও নারিকেলের ভেতরে পানি থাকে তবে তা স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বিবেচনায় ডাবের পানির তুলনায় অনেক পিছিয়ে। নিচের ছকে কচি ডাবের পানি (১০০ মিলি) এবং নারিকেলের শাঁসে (১০০ গ্রাম) বিদ্যমান পুষ্টিগুণ তুলে ধরা হয়েছে। (Lee, 2019)
পুষ্টিগুণ | কচি ডাবের পানি | নারিকেলের শাঁস |
ক্যালরি | ১৮ | ৩৫৪ |
প্রোটিন | ১ গ্রামের কম | ৩ গ্রাম |
ফ্যাট | শূন্য | ৩৩ গ্রাম |
শর্করা | ৪ গ্রাম | ১৫ গ্রাম |
ফাইবার | শূন্য | ৯ গ্রাম |
ম্যাঙ্গানিজ | ৭ শতাংশ* | ৭৫ শতাংশ |
কপার | ২ শতাংশ | ২২ শতাংশ |
সেলেনিয়াম | ১ শতাংশ | ১৪ শতাংশ |
ম্যাগনেসিয়াম | ৬ শতাংশ | ৮ শতাংশ |
ফসফরাস | ২ শতাংশ | ১১ শতাংশ |
আয়রন | ২ শতাংশ | ১৩ শতাংশ |
পটাশিয়াম | ৭ শতাংশ | ১০ শতাংশ |
সোডিয়াম | ৪ শতাংশ | ১ শতাংশ |
*শতাংশ বলতে দৈনিক চাহিদার কতটুকু পূরণ করতে পারে সেটা বোঝানো হয়েছে।
অর্থাৎ একজন মানুষের দৈনিক যে পরিমাণ মিনারেলস বা খনিজ উপাদান গ্রহণ করা দরকার তা ১০০ মিলি ডাবের পানি অথবা ১০০ গ্রাম নারিকেলের শাঁস খাওয়ার ফলে কতটুকু পূরণ হবে তার পরিমাণ শতকরা অনুপাতে উল্লেখ করা হয়েছে।
উপরের ছকে তুলনা বোঝানোর জন্য ডাবের পানি এবং নারিকেলের শাঁস দুটোই ১০০ মিলি এবং ১০০ গ্রাম অনুপাতে হিসাব করা হয়েছে। এই হিসাব অনুযায়ী ডাবের পানির তুলনায় নারিকেলের শাঁস বেশি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন (যদিও ক্যালরির পরিমাণ বেশি) কিন্তু প্র্যাকটিক্যালি চিন্তা করলে ১০০ মিলি ডাবের পানি সহজেই পান করা যায় কিন্তু ১০০ গ্রাম নারিকেলের শাঁস সহজে খাওয়া যায় না। আর তাই ডাবের পানি যে একদমই কম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন নয় তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
কোনটি বেশি স্বাস্থ্যকর কচি ডাব নাকি নারকেল?
কচি ডাবের পানি ও নারিকেলের শাঁসে ছকে উল্লেখিত পুষ্টিগুণ ছাড়াও সামান্য পরিমাণে ভিটামিন, বিভিন্ন এনজাইম ও এন্টি অক্সিডেন্ট (Antioxidants) রয়েছে যা শরীরের জন্য নানাবিধ উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। কচি ডাবের পানি পান করা এবং নারিকেলের শাঁস খাওয়ার মাধ্যমে শরীরের জন্য কি কি উপকার হবে তা ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হলোঃ
ডাবের পানির স্বাস্থ্য উপকারিতা
১। ডায়রিয়া, বমি, কলেরা ইত্যাদির ফলে শরীরে পানির ঘাটতি হয় এবং এমতাবস্থায় খাবার স্যালাইন খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। ডাবের পানিতে খাবার স্যালাইনের মতো ইলেকট্রোলাইট ও শর্করা রয়েছে যা শরীরে পানি স্বল্পতা দূর করার জন্য স্যালাইনের পরিবর্তে খাওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে বাচ্চারা স্যালাইন খেতে চায় না তবে ডাবের পানি পান করতে পছন্দ করবে।
২। ডাবের পানিতে পটাশিয়াম রয়েছে যা ব্লাড প্রেসার কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও নিয়মিত ডাবের পানি পান করলে তাদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।
৩। ডাবের পানি এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা শরীরে ফ্রি রেডিক্যালের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কোষের ক্ষতিগ্রস্ততা ঠেকায়। সেই সাথে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে যা সুস্থ থাকার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
৪। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ডাবের পানি পান করলে কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। এছাড়াও ডাবের পানি পান করার মাধ্যমে দৈনিক পানির চাহিদার কিছু অংশ মেটানো যায় যা হজমে সহায়তা এবং শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভূমিকা রাখে।
৫। ডাবের পানিতে কোনো ফ্যাট নেই এবং খুব সামান্য পরিমাণে ক্যালরি রয়েছে। আর তাই ডাবের পানি পান করলে তা শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৬। ব্যায়াম ও কঠোর পরিশ্রমের আগে অথবা পরে খাবার পানির তুলনায় ডাবের পানি পান করা বেশি উপকারী হবে। আগে ডাবের পানি পান করলে দীর্ঘসময় পর্যন্ত কাজ ও ব্যায়াম করার এনার্জি থাকে আর পরে পান করলে দ্রুত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
৭। নিয়মিত ডাবের পানি পান করা ত্বক ভালো রাখতে সহায়তা করে বিশেষ করে ত্বকে ও মুখে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না। এছাড়াও বাহ্যিকভাবে ত্বকে ডাবের পানি ব্যবহার করলে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা কমে যায়, রোদে পোড়া দাগ দূর করে, আদ্রর্তা বজায় রাখে এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করা সহ ত্বকের যত্নে নানাবিধ উপকারিতা বয়ে আনে।
নারিকেলের শাঁসের স্বাস্থ্য উপকারিতা
নারিকেলের শাঁস থেকে ক্রিম, দুধ ও তেল সংগ্রহ করে খাওয়া যায় আবার সরাসরি শাঁস খাওয়া যেতে পারে। নারিকেলের শাঁস সরাসরি খাওয়ার ফলে যেসব উপকারিতা পাওয়া যায় তা হলোঃ (Danahy, 2022)
১। নারিকেলের শাঁসে প্রচুর পরিমাণে ম্যাঙ্গানিজ রয়েছে যা মেটাবলিসমে সাহায্য করে এবং রক্তে কোলেস্টেরলের ভারসাম্য বজায় রাখে। এছাড়াও হাড়ের ঘনত্ব ঠিক রাখতে এবং বয়স্কদের হাড় ক্ষয় রোগ (Osteoporosis) প্রতিরোধে সাহায্য করে।
২। কপার ও আয়রন রয়েছে যা রক্তস্বল্পতা দূর করে। এছাড়াও রয়েছে সেলেনিয়াম যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, চুল ও নখ ভালো রাখে এবং থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্রম ভালো রাখতে সাহায্য করে।
৩। অন্যান্য ফলের তুলনায় নারিকেলের শাঁসে খুব সামান্য পরিমাণ শর্করা তথা সুগার রয়েছে। পক্ষান্তরে অনেক বেশি পরিমাণে ফ্যাট ও ফাইবার বিদ্যমান যা রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
নারিকেলের শাঁসে বিদ্যমান ফ্যাটের ধরন হলো মিডিয়াম-চেইন ট্রাইগ্লিসারাইড (MCTs- medium-chain triglycerides) যা শরীরে দ্রুত হজম হয় এবং ক্যালরি সরবরাহ করে। অন্যান্য ফ্যাটের মতো এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। বিশেষ করে প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবারগুলোতে লং-চেইন স্যাচুরেটেড ফ্যাট (long-chain saturated fats) থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
৪। যারা শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে চান তাদের জন্য স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস হিসেবে নারিকেলের শাঁস খাওয়া যেতে পারে। এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত পেট ভরা রাখতে পারে। ফলে ঘন ঘন খাবার খেতে হবে না এবং শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
৫। নারিকেলের শাঁসে ফেনল (phenolic compounds) রয়েছে যার এন্টি অক্সিডেন্ট গুণাবলী শরীরে ফ্রি রেডিক্যাল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কোষের ক্ষতিগ্রস্ততা রোধ করে। এছাড়াও এন্টি অক্সিডেন্ট গুণাবলী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
৬। গবেষণায় দেখা গেছে যে, নারিকেলের শাঁসে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি প্রতিহত করার ক্ষমতা রয়েছে। তবে শরীরে ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশন হলে তা দূর করার জন্য কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে এই ব্যাপারে জানতে আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতা বিবেচনায় ডাবের পানি ও নারিকেলের শাঁস কোনোটি কারো চেয়ে পিছিয়ে নয়। শরীরের ক্লান্তি ও পানি স্বল্পতা দূর করার জন্য ডাবের পানি সেরা। তবে ক্ষুধা নিবারণ ও ক্যালরি পেতে চাইলে নারিকেলের শাঁস খাওয়া উচিত।
কিডনি বিকল রোগীদের (Chronic kidney disease) জন্য ডাবের পানি পান করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কারণ, ডাবের পানিতে প্রচুর পটাশিয়াম রয়েছে যা কিডনি বিকল রোগীদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে। আবার যাদের ক্ষেত্রে নারিকেলের শাঁস খেলে এলার্জি দেখা দেয় তাদের জন্য নারিকেলের শাঁস খাওয়া যাবে না।
References
Danahy, A. (2022, April 12). 5 Impressive Benefits of Coconut. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/nutrition/coconut-nutrition
Lee, J. (2019, August 02). All You Need to Know About Green Coconut. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/green-coconut#benefits
Last Updated on April 9, 2023
Leave A Comment