হাঁপানি কি? হাঁপানি বা অ্যাজমা (Asthma) হলো ফুসফুসের প্রদাহজনিত দীর্ঘমেয়াদী একটি রোগ যা ছোট বড় যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে হতে পারে। অ্যাজমা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে শ্বাস গ্রহণের সময় ফুসফুসের ভেতরে থাকা সুক্ষ্ম বায়ু নালী (Bronchioles) সঠিকভাবে প্রসারিত হয় না। যার ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তথা অ্যাজমার নির্দেশক লক্ষণগুলো দেখা যায়। 

হাঁপানি কেন হয়, কাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, হাঁপানির প্রকারভেদ, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।   

হাঁপানি রোগের কারণগুলি কি কি? 

হাঁপানি রোগীদের ক্ষেত্রে সুক্ষ্ম বায়ু নালীতে প্রদাহ, মিউকাস জমা হওয়া বা বায়ু নালী সরু হয়ে যাওয়ার ফলে শ্বাস গ্রহণের সময় বায়ু চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। ঠিক কেন এমন হয় অর্থাৎ হাঁপানি রোগের প্রকৃত কারণ কি তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। 

তবে কতিপয় বিষয়কে এই রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী মনে করা হয় যার মধ্যে অন্যতম হলো ধুমপানের অভ্যাস। যারা ধুমপান করেন তাদের ক্ষেত্রে হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এছাড়াও এলার্জি জনিত কারণে এবং বায়ু দূষণের ফলে হাঁপানি হয়ে থাকে। মানসিক চাপ, ফুসফুসে ভাইরাসের সংক্রমণ ও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলেও হাঁপানি হতে পারে। 

মানসিক চাপ কিভাবে কমানো যায় তা জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।  

কাদের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকি রয়েছে? 

মা বাবা অথবা ভাই বোনদের মধ্যে কারো হাঁপানি থাকলে সেই সন্তান বা সহোদরের ক্ষেত্রে হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এছাড়াও যাদের শরীরের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি তাদের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকি রয়েছে। 

বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের বেলায় হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তবে ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের বেলায় অধিক ঝুঁকি রয়েছে।    

হাঁপানি রোগের প্রকারভেদ

লক্ষণের তীব্রতা অনুযায়ী হাঁপানি রোগ মৃদু থেকে তীব্র প্রকৃতির হয়ে থাকে। তবে এই রোগের প্রকৃত প্রকারভেদ কারণ অনুযায়ী করা হয়ে থাকে যা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো। (Cleveland Clinic, 2022) 

  • এলার্জি জনিত (Allergic asthma): হাঁপানির সবচেয়ে কমন ধরন যা মূলত এলার্জি জনিত কারণে হয়ে থাকে। অর্থাৎ এলার্জিক খাবার গ্রহণ করা বা এলার্জিক বস্তুর (ধুলাবালি, পশুর লোম ও পরাগরেণু) সংস্পর্শে গেলে হাঁপানির সমস্যা দেখা যায়। 
  • নন-এলার্জিক (Non-allergic): এই ধরনের হাঁপানির ক্ষেত্রে এলার্জির কোনো প্রভাব থাকে না। অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ফুসফুসে ভাইরাসের সংক্রমণ, ব্যায়াম করা ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে হাঁপানির সমস্যা হয়ে থাকে। 
  • Childhood asthma: ৫ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের হাঁপানি হয়ে থাকে। 
  • Adult-onset asthma: ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে এই ধরনের হাঁপানি হয়।   
  • Occupational asthma: পোশাক শিল্প অথবা রাসায়নিক উপাদান নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের হাঁপানি হয়ে থাকে। 
  • Asthma-COPD overlap syndrome: হাঁপানি ও COPD (Chronic obstructive pulmonary diseases) এর সংমিশ্রণে সৃষ্ট সমস্যা। COPD হলো ফুসফুসের একটি রোগ। 

এলার্জির কারণ, লক্ষণ ও ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

হাঁপানি রোগের লক্ষণ কি কি? 

Asthma - Syndromes

হাঁপানি রোগের লক্ষণগুলো হলোঃ (Goodwin, 2021) 

  • রাতে কাশি হওয়া 
  • হাসাহাসি ও ব্যায়ামের সময় কাশি 
  • অল্প পরিশ্রমের ফলেই ক্লান্ত হওয়া 
  • শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া 
  • ঘন‌ ঘন‌ শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া
  • বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভব করা 
  • দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ 
  • কথা বলতে বা ঘুমাতে সমস্যা 

হাঁপানির ধরন ও রোগী ভেদে লক্ষণের ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়।

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন?  

হাঁপানি রোগের চারটি নির্দেশক লক্ষণ নিচে তুলে ধরা হলো। 

  • শ্বাস নিতে কষ্ট হয়  
  • বুকের মধ্যে সাঁই সাঁই শব্দ হওয়া 
  • শুকনো কাশি হওয়া (বিশেষ করে রাতের বেলায় বেশি কাশি হয়)  
  • বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভব করা  

নির্দেশক লক্ষণ দেখা গেলে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।

রোগ নির্ণয়

Asthma Disease

হাঁপানি নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক রোগীর কাছ থেকে লক্ষণ ও পারিবারিক ইতিহাস জানার পর শারীরিক পর্যবেক্ষণ (Physical examination) করেন। অতঃপর কতিপয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। যেমনঃ বুকের এক্সরে (Chest X-ray), এলার্জি পরীক্ষা (Allergy tests), Breathing tests (Spirometry) ইত্যাদি। 

চিকিৎসা 

হাঁপানি রোগ একদম সারিয়ে ফেলতে পারে এমন কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। তাছাড়া, হাঁপানি রোগ নিয়ন্ত্রণে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতিও রয়েছে। হাঁপানি রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো। 

মুখে ওষুধ সেবন 

এলার্জি জনিত হাঁপানি নিরাময়ের জন্য এন্টিহিস্টামিন গোত্রের ওষুধ রয়েছে। যথাঃ Cetirizine, Loratadine, Fexofenadine ইত্যাদি। এছাড়াও হাঁপানি নিরাময়ের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু ওষুধ (স্টেরয়েড সহ) রয়েছে যা শুধুমাত্র চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী সেবন করতে হবে।

রোগীর বয়স ও রোগের তীব্রতা অনুযায়ী ওষুধের ধরন ও মাত্রা কম বেশি হয়ে থাকে। আর তাই কোনো অবস্থাতেই চিকিৎসকের নির্দেশনা ব্যতীত ওষুধ সেবন করা যাবে না। 

এন্টিহিস্টামিন ওষুধের ব্যবহার ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

ইনহেলার ব্যবহার

Use Of Inhaler

হাঁপানি রোগীদের জন্য আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা হলো ইনহেলার ব্যবহার করা। হাঁপানির লক্ষণ নিরাময়ের ক্ষেত্রে ইনহেলার খুব কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। 

দুই ধরনের ইনহেলার রয়েছে। একটি হলো হাঁপানির লক্ষণ প্রতিরোধের জন্য প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবহার করতে হয়। আর অন্যটি হলো জরুরী ভিত্তিতে ব্যবহার করার জন্য অর্থাৎ সবসময়ের জন্য রোগীর হাতের নাগালে রাখতে হবে যেন হঠাৎ করে হাঁপানির লক্ষণ শুরু হলে ব্যবহার করা সম্ভব হয়।  

ইনহেলার ব্যবহারের সঠিক নিয়ম 

প্রথমে শ্বাস ত্যাগ করে ফুসফুসের বাতাস বের করে দিতে হবে। অতঃপর ইনহেলারের মাউথপিসের ঢাকনা খুলে মুখে নিয়ে দাঁতের ফাঁকে রেখে ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরতে হবে।‌ এবার একইসাথে ইনহেলারে চাপ দিতে হবে এবং লম্বা শ্বাস (বুক ভরে) নিতে হবে। ওষুধ যেন ফুসফুসে জমা হতে পারে তার জন্য মুখ থেকে ইনহেলার সরিয়ে নেওয়ার পর ৫ থেকে ১০ সেকেন্ড শ্বাস বন্ধ করে রাখতে পারলে ভালো। দুইবার ইনহেলার ব্যবহারের মধ্যবর্তী সময়ের দূরত্ব ৩০ সেকেন্ড অথবা ১ মিনিট হওয়া উচিত। 

হাঁপানির লক্ষণ প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত স্টেরয়েড জাতীয় ইনহেলার ব্যবহার করার পর ভালোভাবে কুলি করতে হবে। কারণ এই জাতীয় ওষুধ মুখে জমে থাকলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। 

ইনহেলার ব্যবহারের পূর্বে কয়েকবার ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে নিতে হবে। সর্বাবস্থায় চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে ওষুধ সেবন করতে হবে এবং ওষুধ বন্ধ রাখার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

References

Cleveland Clinic. (2022, January 19). Asthma. Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/6424-asthma

Goodwin, M. (2021, October 27). Asthma: Symptoms, Treatment, and Prevention. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/asthma

Last Updated on November 5, 2023