বয়স্কদের ক্ষেত্রে চুল পেকে যাওয়া শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে অকালে চুল পাকা সমস্যা দেখা যায়। এশিয়ান মানুষদের ক্ষেত্রে ৩০ বছরের পর থেকে চুল পাকা শুরু হয়। 

কারো ক্ষেত্রে ৩০ বছরের আগেই চুল পাকলে সেটা অস্বাভাবিক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে যাকে মেডিকেলের ভাষায় Premature graying of hair বা চুলের অকাল-পক্কতা বলা হয়। 

অকালে চুল পেকে যাওয়ার কারণ সমূহ, প্রাকৃতিক প্রতিকার এবং চুল পাকা প্রতিরোধে করণীয় বিষয়াবলী সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

অল্প বয়সে চুল পেকে যাওয়ার কারণ  

অকালে চুল পেকে যাওয়ার সবচেয়ে প্রধান কারণ হলো জিনগত প্রভাব (Genetics) বা বংশগত কারণ। অর্থাৎ যাদের পরিবারের সদস্যের মধ্যে (বিশেষ করে মা বাবা বা ভাই বোন) অকালে চুল পেকে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে চুলের অকাল-পক্কতা হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। 

বংশগত কারণ ছাড়াও অল্প বয়সে চুল পেকে যাওয়ার আরো যেসব কারণ রয়েছে সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হয়েছে।

  • দুশ্চিন্তা, অবসাদ, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, রাতে ভালো ঘুম না হওয়া ইত্যাদি সমস্যাগুলোর সাথে চুলের অকাল-পক্কতার যোগসূত্র রয়েছে। (Higuera, 2023) 
  • থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশি মাত্রায় হরমোন নিঃসরণের ফলে চুলের অকাল-পক্কতা লক্ষণ দেখা দিতে পারে। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে কম মাত্রায় হরমোন নিঃসরণ হলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় হাইপোথাইরয়েডিজম বলা হয় যা খুব কমন একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। 
  • বিভিন্ন রোগের প্রভাবে অল্প বয়সে চুল পাকতে পারে। যেমনঃ এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা, শ্বেতী রোগ, অটোইমিউন ডিজিজ ইত্যাদি। 
  • শরীরে পর্যাপ্ত প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলের (ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি, ভিটামিন ই, ক্যালসিয়াম, আয়রন, কপার ইত্যাদি) অভাব হলে অকালে চুল পেকে যেতে পারে। 
  • শরীরে ফ্রি রেডিক্যালের (Free radicals) পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সাথে চুলের অকাল-পক্কতার যোগসূত্র রয়েছে। বিপাক প্রক্রিয়ার (মেটাবলিসম) উপজাত হিসেবে শরীরে ফ্রি রেডিক্যাল উৎপন্ন হয়। এছাড়াও বায়ু দূষণ, অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ধুমপান, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি ইত্যাদির ফলে শরীরে ফ্রি রেডিক্যালের সংখ্যা বেড়ে যায়। 
  • চুলে অতিরিক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করা এবং বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে চুল কালার করার ফলে চুলের অকাল-পক্কতা দেখা যায়। 

চুল পাকা প্রতিরোধ করা যাবে কি?

Vegetable

বংশগত কারণে চুল পাকার কোনো প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা নেই। তবে অন্যান্য কারণগুলো প্রতিরোধ করা যেতে পারে। এর জন্য করণীয় বিষয়াবলী সমূহ নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে।

এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ 

এন্টি-অক্সিডেন্ট (Antioxidants) শরীরে ফ্রি রেডিক্যালের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ফলমূল, শাকসবজি, অলিভ অয়েল, গ্রিন টি ইত্যাদি হলো প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার। (Barhum, 2023)

বিভিন্ন বর্ণের ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শাকসবজি যতটা সম্ভব কম তাপে রান্না করতে হবে। কারণ তাপে এন্টি-অক্সিডেন্ট নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। টমেটো, গাজর, শশা, কাঁচা পেঁপে, লেটুসপাতা ইত্যাদি সালাদ হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। এতে বেশি এন্টি-অক্সিডেন্ট পাওয়া সম্ভব হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা 

দুশ্চিন্তা ও অতিরিক্ত মানসিক চাপ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। বিশেষ করে ইয়োগা ও মেডিটেশন চর্চা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে।

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য রাতে ভালো ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। সন্ধ্যার পর চা ও কফি পান করা যাবে না। রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর আগে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

চুলের সঠিক যত্ন নেওয়া 

চুলে অতিরিক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করা যাবে না।‌ কারণ এতে চুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২ থেকে ৩ বার শ্যাম্পু ব্যবহার করা যাবে এবং প্রতিবার শ্যাম্পু ব্যবহারের পর কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হবে। 

নিয়মিত চুল আঁচড়াতে হবে। এতে চুলের গোড়ায় পুষ্টি সরবরাহ বেড়ে যায়। তবে ভেজা চুল আঁচড়ানো যাবে না। সপ্তাহে একদিন মাথার ত্বক ও চুলে নারকেল তেল ব্যবহার করা উপকারী হতে পারে।

পুষ্টি উপাদান

প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা বিভিন্ন খাবার থেকে পাওয়া যায়। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। যেমনঃ মাছ, ডিম, দুধ, মুরগির মাংস, বাদাম, ডাল, ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি।

শরীরে ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণের জন্য ত্বকে সরাসরি সূর্যের তাপ লাগাতে হবে। সপ্তাহে অন্তত ২/৩ দিন ৩০ মিনিট করে রোদ পোহাতে হবে। অন্যান্য ভিটামিন গুলো খাবার থেকে পর্যাপ্ত পাওয়া যায়। তবে কোনো ভিটামিন বা মিনারেলের ঘাটতি থাকলে সেক্ষেত্রে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে।‌ 

অন্যান্য 

  • থাইরয়েডের সমস্যা বা অন্য কোনো রোগের প্রভাবে চুল পাকার ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় পূর্বক যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 
  • রক্তস্বল্পতা দূর করার জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।
  • ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত যত্রতত্র ওষুধ সেবন করা যাবে না।
  • ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় যতটা সম্ভব বর্জন করতে হবে।  
  • ধুমপানের অভ্যাস থাকলে বর্জনের চেষ্টা করতে হবে। 

প্রাকৃতিক প্রতিকার

Natural Remedies For Hair Fall

পাকা চুলের প্রতিকার হিসেবে চুলে মেহেদী ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি চুল কালার করার সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি। মেহেদী পাতা বেটে মাথায় কিছুক্ষণ লাগিয়ে রাখলে সাদা চুল লাল বর্ণের হয়ে যাবে। 

এছাড়াও পাকা চুল যেন কাঁচা চুলের মতো কালো দেখায় সেজন্য চুলে কলপ বা কালো রং ব্যবহার করতে পারেন। তবে কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান রয়েছে এমন রং ব্যবহার করা উচিত নয়।‌ নিরাপদ রং খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অথবা বিউটিশিয়ানের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। 

পাকা চুল তুলে ফেলা চুলের অকাল-পক্কতার সমাধান হতে পারে না। তবে হঠাৎ গুটিকয়েক চুল পাকা দেখা গেলে সেগুলো তুলে ফেলা যেতে পারে। এতে বিশেষ কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

মাথার চুলে বাহ্যিকভাবে আমলকী, লেবুর রস, ব্ল্যাক টি ইত্যাদি ব্যবহার করা চুল পাকা প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। 

আমলকী পেস্ট বানিয়ে চুলে দিতে হয়। লেবুর রস তেলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্ল্যাক টি এর ক্ষেত্রে চা বানানোর প্রক্রিয়ায় গরম পানিতে চা পাতা বা টি ব্যাগ ভিজিয়ে রাখতে হবে। চা ঠান্ডা হলে ব্যবহার করতে হবে। 

বাহ্যিকভাবে চুলে আমলকী, লেবুর রস বা ব্ল্যাক টি ব্যবহারের ৩০ মিনিট পর মাথা ধুয়ে ফেলতে হবে। 

শেষ কথা 

অকালে চুল পেকে যাওয়া কোনো রোগ নয়, তবে সৌন্দর্যহানিকর একটি বিষয় যা কারোরই কাম্য নয়। দুঃখজনক বিষয় হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বংশগত কারণে চুলের অকাল-পক্কতা দেখা যায় যা প্রতিরোধ করা যায় না। 

অন্যান্য ক্ষেত্রে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা এবং চুলের সঠিক যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে অকালে চুল পাকা প্রতিরোধ করা যায়। এছাড়াও পাকা চুল কালার করার জন্য প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবে মেহেদী পাতা ব্যবহার অথবা নিরাপদ রাসায়নিক উপাদান সমৃদ্ধ কলপ ব্যবহার করা যেতে পারে।  

Bibliography

Barhum, L. (2023, March 15). What you should know about gray or white hair. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/320288

Higuera, V. (2023, April 29). What Causes White Hair? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/white-hair

Last Updated on December 20, 2023