হরমোন (Hormone) হলো জৈব-রাসায়নিক তরল যা শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করে। শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসরণ হয়। কোনো কারণে গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসরণের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হলে অর্থাৎ শরীরে হরমোনের মাত্রা কম-বেশি হলে নানাবিধ সমস্যা দেখা যায়।

হরমোন জনিত একটি কমন সমস্যা হলো অতিরিক্ত চুল পড়ে যাওয়া। শরীরের কোন কোন হরমোন চুল পড়ার সাথে সম্পর্কিত, হরমোন জনিত চুল পড়ার প্রাকৃতিক সমাধান এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

কোন কোন হরমোন চুল পড়ার জন্য দায়ী?

শরীরের যেসব হরমোনের মাত্রা কম-বেশি হওয়ার সাথে অতিরিক্ত চুল পড়ার যোগসূত্র রয়েছে তা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। 

অ্যান্ড্রোজেন হরমোন (Androgen hormones) 

অ্যান্ড্রোজেন হরমোনকে পুরুষের যৌন হরমোন বলা হয়। তবে এটি নারী ও পুরুষ উভয়ের শরীরে থাকে।    

অ্যান্ড্রোজেনের অন্তর্ভুক্ত প্রধান দুটি হরমোন হলো টেস্টোস্টেরন ও ডিহাইড্রোটেস্টোস্টেরন বা সংক্ষেপে ডিএইচটি। কোনো কারণবশত শরীরে স্বাভাবিকের তুলনায় ডিএইচটির এর মাত্রা বেড়ে গেলে অতিরিক্ত পরিমাণে চুল পড়তে দেখা যায় যাকে অ্যান্ড্রোজেনিক অ্যালোপেসিয়া বলা হয়।  

পুরুষের যৌনাঙ্গ গঠনের ক্ষেত্রে ডিহাইড্রোটেস্টোস্টেরন হরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে ডিএইচটি এর তেমন কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। ডিএইচটি বেড়ে যাওয়ার প্রকৃত কারণ অজানা।‌ তবে জিনগত প্রভাব (পারিবারিক ইতিহাস) রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। 

নারীদের শরীরে খুব সামান্য পরিমাণে অ্যান্ড্রোজেন হরমোন থাকে যা ইস্ট্রোজেন হরমোন উৎপাদন, যৌন স্বাস্থ্য রক্ষা এবং হাড়ের গঠন মজবুত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

পলিসিস্টিক ওভারী সিনড্রোম (পিসিওএস) রোগে আক্রান্ত নারীদের ক্ষেত্রে শরীরে অতিরিক্ত মাত্রায় অ্যান্ড্রোজেন হরমোন উৎপন্ন হয়। যার ফলে চুল পড়ে যাওয়া সহ নানাবিধ সমস্যা দেখা যায়। যেমনঃ অনিয়মিত পিরিয়ড হওয়া, শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া, মুখে লোম গজানো, ব্রণ হওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি।   

থাইরয়েডের সমস্যা 

Thyroid-Issue

থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসরণ হয় যা বিপাক প্রক্রিয়া সহ শরীরের বিভিন্ন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে কম মাত্রায় হরমোন নিঃসরণ হলে তাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলা হয়। এটি খুব কমন একটি সমস্যা যার ফলে অতিরিক্ত চুল পড়ে যেতে থাকে।

নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে। তবে নারীদের ক্ষেত্রে প্রবণতা বেশি দেখা যায়। হাইপোথাইরয়েডিজম এর লক্ষণগুলো হলো চুল রুক্ষ হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত চুল পড়া, শুষ্ক ত্বক, দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ, শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া, বিষন্নতা ইত্যাদি। 

থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় হরমোন নিঃসরণ হলে তাকে হাইপারথাইরয়েডিজম বলা যায়। এটি কমন সমস্যা নয়, তবে এর ফলেও অতিরিক্ত চুল পড়তে পারে। হাইপারথাইরয়েডিজম এর লক্ষণগুলো হলো অস্থিরতা বোধ, হার্ট রেট বেড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, শরীরের ওজন কমে যাওয়া, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি। 

ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন 

নারীর শরীরের প্রধান যৌন হরমোন হলো ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন। ডিম্বাশয় (ওভারী) থেকে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোন নিঃসরণ হয়ে পিরিয়ড, গর্ভধারণ, যৌন স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ সহ শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করে। 

নারীর শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোনের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হলে পিরিয়ডের সমস্যা, যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া, ব্রণ হওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত চুল পড়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়। 

সাধারণত প্রসব পরবর্তীকালীন সময় এবং মেনোপজের পর নারীদের শরীরে হরমোনের অস্বাভাবিকতা জনিত অতিরিক্ত চুল পড়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা যায়।

কর্টিসল হরমোন 

অতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলে অ্যাডরেনাল গ্ল্যান্ড থেকে কর্টিসল হরমোন নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যায়। অতিরিক্ত কর্টিসল হরমোনের সাথে চুল পড়ে যাওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। (Chakravorty, 2022) 

চিকিৎসা 

হরমোন জনিত সমস্যার চিকিৎসার জন্য হরমোন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। তবে মহিলাদের জন্য গাইনী ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা গ্রহণ করা যেতে পারে। 

ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যথাযথ কারণ নির্ণয় করতে হবে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে হরমোনের মাত্রা সম্পর্কে জানা যায়। অতঃপর কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।‌ যেমনঃ 

অ্যান্ড্রোজেন হরমোন নিয়ন্ত্রণের জন্য ফেনাস্টেরাইড (Finasteride) জাতীয় ওষুধ সেবন করতে হবে। 

থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা থাকলে থাইরয়েডের চিকিৎসা নিতে হবে। মেনোপজের ক্ষেত্রে হরমোন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপ দূর করার জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট এর শরণাপন্ন হতে হবে। 

মহিলাদের ক্ষেত্রে সন্তান প্রসব পরবর্তীকালীন হরমোন জনিত চুল পড়া সমস্যার জন্য চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ এটি সাময়িক সমস্যা যা অল্প সময়ের মধ্যেই আপনাআপনি ভালো হয়ে যায়। 

চিকিৎসকের নির্দেশনা ব্যতীত হরমোন জনিত সমস্যার জন্য কোনো ওষুধ সেবন করা যাবে না। সঠিক ডোজ মেনে ওষুধ খেতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ সেবন বন্ধ রাখা যাবে না।

কিভাবে প্রাকৃতিকভাবে হরমোনজনিত চুল পড়া কমানো যায়? 

Foods for healthy hair

হরমোন জনিত অতিরিক্ত চুল পড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য কতিপয় প্রাকৃতিক পদ্ধতি অবলম্বন উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে।‌‌ (Syeda, 2023) 

সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা 

শরীরে হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখার ক্ষেত্রে খাবারের ভূমিকা রয়েছে। পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে এবং খাবার গ্রহণের ব্যাপারে সঠিক নিয়ম মেনে চলতে হবে। 

যেমনঃ অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে, কোনো বেলার খাবার বাদ‌ দেওয়া যাবে না, স্বাস্থ্যবিধি মেনে খাবার খেতে হবে, অস্বাস্থ্যকর খাবার বর্জন করতে হবে ইত্যাদি। 

চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার, অতিরিক্ত লবণ, ট্র্যান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার, পটেটো চিপস, ফাস্টফুড, কোমল পানীয় ইত্যাদি যতটা সম্ভব বর্জন করতে হবে।

প্রচুর পরিমাণ শাকসবজি ও ফলমূল খেতে হবে। এছাড়াও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার, ভালো মানের প্রোটিন (ডিম, দুধ, মাছ, মুরগির মাংস, বাদাম ও ডাল), স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ফ্যাট (সয়াবিন বা সূর্যমুখী তেল, অলিভ অয়েল) ইত্যাদি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। 

চুলের যত্ন 

চুলের সঠিক যত্ন নিতে হবে। যেমনঃ সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিনের বেশি শ্যাম্পু ব্যবহার করা যাবে না। কারণ অতিরিক্ত মাত্রায় শ্যাম্পু ব্যবহার করা চুলের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এছাড়াও শ্যাম্পু ব্যবহারের পর কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হবে। 

নিয়মিত (সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন) মাথায় তেল ব্যবহার করতে হবে। সবচেয়ে সহজলভ্য এবং চুলের জন্য সবচেয়ে উপকারী হলো নারিকেল তেল। মাথার ত্বকে ভালোভাবে ম্যাসাজ করে তেল দিতে হবে। 

সপ্তাহে একবার হেয়ার মাস্ক ব্যবহার করা চুলের জন্য উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। যেমনঃ ডিমের সাদা অংশ, লেবুর রস ও এলোভেরা, অলিভ অয়েল ও মধু ইত্যাদি। 

অতিরিক্ত রোদ থেকে চুলের সুরক্ষায় টুপি পড়া,‌ হিজাব ব্যবহার বা চুলের সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও ভেজা চুল হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহারের পরিবর্তে ফ্যানের বাতাসে শুকানো উত্তম। 

ব্যায়াম

শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। যেকোনো ধরনের ব্যায়াম (হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা, দড়ি লাফ, ভারোত্তোলন ইত্যাদি) করলেই হবে।  

তবে ইয়োগা ও মেডিটেশন চর্চা অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার ক্ষেত্রে অন্যান্য ব্যায়ামের তুলনায় সবচেয়ে বেশি উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। 

পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। গ্রিন টি পান করা উপকারী হবে। রাতে ভালো ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।

Bibliography

Chakravorty, A. (2022, September 19). How To Prevent Hair Loss Due To Hormonal Imbalance? Retrieved from vedix: https://vedix.com/blogs/articles/hair-loss-due-to-hormonal-imbalance

Syeda, A. (2023, September 06). Hormonal Hair Loss: Causes And How To Reduce It Naturally. Retrieved from Style Craze: https://www.stylecraze.com/articles/hormones-and-hair-loss/

Last Updated on December 20, 2023